আপনি পড়ছেন

মহান আল্লাহতা’য়ালা বলেন: “আর আমি এই কুরআন নাযিল করেছি অল্প অল্প করে- যাতে তুমি তা মানুষের নিকট পাঠ করতে পার ক্রমে ক্রমে এবং আমি তা (পরিবেশ পরিস্থিতি অনুযায়ী) প্রর্যায়ক্রমে নাযিল করেছি।” (বনী ইসরাইল ১৭: ১০৬)

ramadan and al quaran

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা আরো বলেন,

“কাফেররা বলে, ‘সমগ্র কুরআন তার কাছে একবারে নাযিল হলো না কেন?’ এইভাবেই আমি তা নাযিল করেছি তোমার হৃদয়কে তার দ্বারা মজবুত করার জন্য এবং তা ক্রমে ক্রমে স্পষ্টভাবে আবৃত্তি করেছি।” (ফুরকান ২৫: ৩২)

আবু আব্দুর রহমান সুলামী (রহ.) বলেন, “আমাদেরকে আমাদের ওস্তাদগণ বর্ণনা করেছেন, যারা নবী (সা.)-এর ছাত্র ছিলেন তারা দশটি আয়াত শিখলে ততক্ষণ পর্যন্ত আর আগে বাড়তেন না, যতক্ষণ পর্যন্ত ওই দশ আয়াতের বর্ণিত ইলম ও আমল শিক্ষা করেছেন। তারা আরো বলেছেন, আমরা ইলম ও আমল উভয়ই (একই সময়ে) শিক্ষা করেছি।” (মুসনাদে আহমাদ, শায়েখ আব্দুল হামিদ ফাইজী, হাদীস সম্ভার, ১ম খণ্ড, ১৪৬৮)

কুরআন অধ্যয়নে বাধা:

কুরআন অধ্যয়ন বা বুঝে বুঝে তাফসীরসহ পাঠ করা কতটা জরুরী সে ব্যাপারে আমাদের সমাজে ব্যাপক ভুল ধারণার সাথে সাথে কুরআন অধ্যয়নে আরো কিছু সমস্যার সম্মুখীন হই আমরা। কুরআন পড়তে গিয়ে অনেকে ধাক্কা খান। তাদের বক্তব্য- কুরআন পড়ছি কিছুই বুঝছি না- ছাড়া ছাড়া কর্তাবার্ত, যুদ্ধ-হুকুম-ইতিহাস-ঈমান বারবার খাপছাড়াভাবে এসেছে। প্রকৃতপক্ষে পূর্ব ধারণার ভিত্তিতে কুরআন পড়তে গিয়ে তারা নিচের কয়েকটি সমস্যার সম্মুখীন হন-

১. আর সব বইয়ের মতো কুরআনকে মানবরচিত একটা বইয়ের মতো বিবেচনা করেন অনেকে। তাই আশা করেন ভূমিকা, বিষয়বস্তু, উপসংহার আকারে ধারাবাহিকভাবে আলোচন্য বিষয়গুলি থাকবে। তা- না পেয়ে দিশেহারা বা হতাশ বোধ করেন। বস্তুত: মহান আল্লাহতা’য়ালা মানুষকে যেভাবে গড়তে চান তার উপযোগী করেই কুরআনকে সাজিয়েছেন। প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো বারবার নিয়ে এসেছেন। বিষয়গুলোর মধ্যে গভীর আন্তঃমিল ও সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু অনভ্যস্ত দৃষ্টিতে তা খাপছাড়া বা সম্পর্কহীন মনে হয়।

২. অনেকে মনে করে ধর্মীয় কিতাব হিসেবে এতে শুধু ঈমান-আমল, নামায, রোজা, পবিত্রতা, হজ্জ-যাকাতের কথা, জান্নাত-জাহান্নামের কথা থাকবে। অনেকে প্রচলিত ফিকাহর বইয়ের মতো পবিত্রতা, নামায, রোজা এ রকম ধারাবাহিকতা আশা করেন কুরআনে। তা না হয়ে ঈমান, নামায, যুদ্ধ, সন্ধি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, মানবচরিত্র, বন্ধু-শত্রু, বৈজ্ঞানিক ও সামাজিক তত্ত্ব ও তথ্য, ঐতিহাসিক ঘটনাবলী ইত্যাদি বিষয়ে কুরআনে ব্যাপক আলোচনা দেখে হতভম্ব হয়ে পড়েন।

৩. কুরআন সমগ্র মানবজাতির জন্য আল্লাহ মনোনীত একমাত্র হেদায়াত। কিন্তু অনেকে মানুষের তৈরি করা বিশেষ কোনো মতের পক্ষে কুরআন থেকে দলিল খোঁজার জন্য কুরআন পড়েন। না পেয়ে কুরআন পড়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। বামপন্থী ঘরানার এক উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাকে তার অধঃস্তন কেউ এক কপি অর্থসহ কুরআন দেন পাঠ করার জন্য। দীর্ঘদিন পর তা পড়েছেন কি না- জিজ্ঞাসা করলে কর্মকর্তার জবাব- তোমাদের কুরআনে এমন ভাল কিছু দেখলাম না। কেবল একটা কথাই ভাল লাগলো যে, ‘শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগেই তার মজুরী দিয়ে দাও।’

দীর্ঘদিন আগের কথা, ঘটনাটা শুনেছিলাম যে ভদ্রলোক তার বসকে কুরআন পড়তে দিয়েছিলেন তার কাছ থেকেই। এখন পাঠক আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন যে, সে বেচারী কুরআন খুলেও সম্ভবত দেখেননি। তার বদ্ধমূল ধারণা থেকে তিনি মনে করতেন যে, কুরআনে মানব কল্যাণের জন্য কিছু নেই। নাউযুবিল্লাহ। কেবল তার কলিগকে জবাব দেয়ার জন্য- নবীজীর (সা.) একটা বহুল প্রচলিত হাদীস শুনিয়ে দায় সারতে চেয়েছেন। দুঃখজনক হলো সেটা যে কুরআনের কোনো আয়াত না এ ধারণাও এই জ্ঞানপাপীদের নেই। এটাই আমাদের উচ্চশিক্ষিত মহল ও বুদ্ধিজীবীদের অধিকাংশেরই ইসলাম ও কুরআন সম্পর্কে জ্ঞানের দৌড়।

কট্টর ইসলাম বিরোধীরা তাই খোলা মনে কুরআন পড়তে পারে না। তারা কুরআনকে সাম্প্রদায়িক, নারী বিদ্বেষী, স্বাধীনতা, প্রগতি ও আধুনিকতা বিরোধী একটা মধ্যযুগীয় ধর্মীয় কিতাব হিসেবে চিহ্নিত করে। যারা কম কট্টর- তারা ধর্মীয় গ্রন্থের সব কিছু বুঝা যায় না বলে সব কূল রক্ষার চেষ্টা করেন। এভাবে নিজ ধর্ম, সমাজ ও আধুনিকতার মধ্যে ব্যালেন্স করে চলতে চান।

৪. কেউ বা আবার কুরআন মজীদকে বাজারে প্রচলিত নেয়ামুল কুরআন বইয়ের মতো মুশকিল আসানিয়া মন্ত্রের বই মনে ভুল করেন। ফলে কুরআনের অর্থ পাঠের সময় ঈমান ও চরিত্র সংশোধন, ব্যক্তি ও জাতির সংস্কার বা ইসলামের বিরুদ্ধবাদীদের মোকাবেলায় প্রোগ্রাম দেখে হোঁচট খান।

৫. কুরআন বুঝার আরেকটা সমস্যা হল- কুরআন মানার চেষ্টা না করে, কুরআনী জিন্দেগী যাপন না করে ঘরে বসে বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের শ্রেণিকক্ষে বসে কুরআন বুঝার চেষ্টা করা। কুরআন তাত্ত্বিক আলোচনা বা দর্শনের কিতাব নয় যে ঘরে বসে একা একা পাঠ করে তার মর্ম বুঝা যাবে। কুরআন নাযিল হয়েছে বিশ্বকে বদলে দেয়ার জন্য, বিশ্বাস ও চিন্তায় বিপ্লব নিয়ে আসার জন্য, জীবনবোধ ও জীবনাচরণে ঐশী পরিবর্তন নিয়ে আসার জন্য। যা নাযিল হয়েছিল নবী (সা.)-এর ২৩ বছরের নবুয়তী জীবনে বিভিন্ন ঘটনা ও অবস্থার প্রেক্ষিতে। জীবন ও জাতিকে বদলে দেয়ার সেই কার্যক্রমে শরীক না থেকে, সেই পথের পথিক, শিক্ষক ও সহযাত্রীদের সোহবত-সংসর্গ গ্রহণ না করে, সেই পথে মক্কা-মদীনার স্টেশনগুলি নবীজীর (সা.) সাথে অতিক্রম না করে কুরআন বুঝা সম্ভব নয়। কুরআন দুনিয়া ও আখিরাতের জীবনকে সুন্দর করার পথ দেখায়। সে পথে না চলে কুরআন বুঝা যায় না।

-কুরআনী জীবন যাপনের জন্য কুরআনের সাথী হওয়ার স্বার্থে যে বিষয়গুলি আমাদের সাহায্য করবে তার উপর আগামী কিস্তিগুলিতে আলোকপাত করার ইচ্ছা রইলো ইনশাল্লাহ।

রমজান, লকডাউন ও ঈদ বাজার:

করোনা পরিস্থিতির অবনতিতে লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। মানুষজন, সরকার সবাই দিশেহারা। জীবন আগে না জীবিকা আগে? বেঁচে থাকব না বেচাকেনা করব- এই যেন জীবনের মূল ভাবনার বিষয়। শুধু যেনতেনভাবে বেঁচে থাকা বা উন্নত জীবনমান ধরে রাখাই যাদের আদর্শ তাদের জন্য বোধ করি তৃতীয় কোনো চিন্তার বিষয় নেই। কিন্তু মুমিনকে চিন্তা করতে হয়। চিন্তা করতে হবে। মহামারী, অতিমারী দুনিয়ায় এই প্রথম নয়। সাহাবীদের যামানায়ও মুসলিমরা এর সম্মুখীন হয়েছে। হাজার হাজার সাহাবী-তাবেঈ তাতে মারা যান। পরবর্তীতেও মুসলমানরা মহামারীর মুখোমুখি হয়েছে। বস্তুত: মহামারীতে কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশন এগুলো মুসলিম বিজ্ঞানীদেরই আবিষ্কার। পরবর্তীতে গুটি বসন্তের টিকা বা vaccine উসমানী খিলাফতের সময় মুসলিম বিজ্ঞানীরাই আবিষ্কার করেন (১৭১৫ সালে)। তা শতভাগ সফলভাবে প্রয়োগ করতেন সম্মানিত মুসলিম মহিলা ডাক্তার ও বিজ্ঞানীরাই। Letters by Lady Mary Wordley Montagu। মুসলমানদের কাছ থেকে এ জ্ঞান আয়ত্ত করে পাশ্চত্য বিজ্ঞানীরা অবলীলায় নিজেদের বলে চালিয়ে দিয়েছেন। সততার কি আদর্শ নমুনা! এরাই আমাদের আদর্শ সমাজের শিক্ষা দেয়। সত্যিই কি বিচিত্র!! তখন বোধকরি আমাদের এক শ্রেণীর ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের মতো মুত্তাকী (?!) লোকেরা ছিলেন না। যারা ফতোয়া দিয়ে বেড়াতেন যে, মেয়েদের ক্লাস থ্রি-ফোর পর্যন্ত ধর্মীয় শিক্ষাই যথেষ্ট। সুবহানাল্লাহ!

এ পথ ধরেই আমরা আজ অধঃপতনের এ পর্যায়ে এসে ঠেকেছি। রসুলুল্লাহ (সা.)-এর সময় মদীনায় শল্যচিকিৎসক (sergeon) ছিলেন বিশিষ্ট মহিলা সাহাবী রুফাইদা (রা.)। যার চিকিৎসার সুবিধার জন্য অস্থায়ী মেডিকেল ক্যাম্প স্থাপন করা হতো মসজিদে নববীতে, রসুল (সা.)-এর নির্দেশে। রসুলুল্লাহ (সা.), মা আয়েশা, ওহুদের বীরঙ্গনা উম্মে আম্মারা তথা নুসাইবা (রা.) প্রমুখকে এই মহীয়সী সাহাবীয়ার কাছ থেকে চিকিৎসা বিদ্যা শেখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। আধুনিকতাবাদের নাম করে যারা ইসলামের সংস্কার চান তাদের হাত থেকে– ইসলামকে হেফাজত করা দরকার, মহিলাদের হাতের লেখা দেখলে যাদের পর্দা ছুটে যায় এমন ধার্মিকদের হাত থেকেও ইসলামকে হেফাজত করা জরুরী।

কথা হচ্ছিল মহামারী অবস্থায় মুমিনের চিন্তাধারা নিয়ে। জীবন-জীবিকাকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। কিন্তু মুমিনের চিন্তাধারা সেসবকে ছাপিয়ে সব সময় আখিরাতমুখী থাকবে। করোনার কারণে যেমন বাজার পরিহার করা দরকার সাধ্যমত, রমজানের যাবতীয় ফযীলত হাসিলের জন্য সাধ্যমত বাজার থেকে দূরে থাকা দরকার। নতুন নতুন কথা আমাদের কানে ঢেলে দেয়া হচ্ছে। Revenge marketing বা প্রতিশোধমূলক মার্কেটিং ইত্যাদি- গত ঈদে মার্কেটিং করতে পারিনি তা এ ঈদে পুষিয়ে নিব। কি আশ্চার্য! একই সময় বলছি দুঃস্থ মানুষের পাশে দাঁড়াই সবাই। সেই সাথে বলছি যাদের বাড়তি টাকা আছে তা অপ্রয়োজনীয় মার্কেটিং করে উড়িয়ে আসি। সবাই আখিরাত নিয়ে চিন্তিত হই। করোনায় অনেকেই মারা গিয়েছেন, আর কতজন মারা যাবেন আল্লাহপাকই ভাল জানেন। আমিও তো তার মধ্যে হতে পারি। তখন এই নতুন জামা-কাপড় বা অন্যান্য সামগ্রী কি কাজে আসবে সবাই ভেবে দেখি। কবরের জিন্দেগীতে, হাশরের মাঠে যা কাজে লাগবে তা অর্জনের সুবর্ণ সুযোগ উপস্থিত এই রমজানে। সবাই তাতে মনোযোগী হই। কুরআন-হাদীস চর্চা বাড়াই। দ্বীনি জ্ঞান বৃদ্ধি করি। দোয়া, ইস্তেগফার-তওবা, নফল সালাত, সালাতে খুশুখুযু বাড়াতে চেষ্টা করি সবাই। সেই সাথে সাদাকার হাত বাড়িয়ে দেই। যাকাত-সাদাকা, নফল দান, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যথার্থভাবে হিসাব করে দুঃস্থ ভাই-বোনদের হাতে পৌঁছে দেই। রসুলের (সা.) হাদীস হল- “সাদাকা গুনাহকে মিটিয়ে দেয়।” সেই চেতনায় উজ্জীবিত হই সবাই। আল্লাহপাক তাওফীক দিন। কবুল করে নিন। আমীন।

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর