যে কারণে, যেভাবে ঘনিষ্ঠ হচ্ছে চীন ও তালেবান

আফগানিস্তান থেকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা সেনা প্রত্যাহারের চূড়ান্ত ঘোষণা আসার পর একের পর এক এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে তালেবান। তাদের এই অগ্রাভিযান ঠেকাতে বড় ধরনের অভিযান চালাচ্ছে দেশটির সরকারি বাহিনী। এমতাবস্থায় আফগান সরকারের সমর্থনে বিমান হামলা শুরু করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। পরিস্থিতি মোকাবেলায় চীনের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করছে তালেবান।

তালেবান নেতা ও চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী, সাম্প্রতিক ছবি

এ নিয়ে ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিসিসি একটি বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। যেখানে বিপরীত আদর্শ লালন করা চীন ও তালেবানের ঘনিষ্ঠতার কারণ, তালেবানের ওপর চীনের এত ভরসার কারণ, আফগানিস্তানে চীনের চাওয়া এবং আফগানিস্তান ও উইঘুর বিচ্ছিন্নতাবাদ নিয়ে বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তানের মাধ্যমে তালেবানের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রক্ষা করে আসছিল চীন। তার ফল হচ্ছে গোষ্ঠীটির শীর্ষ কোনো নেতা হিসেবে মোল্লাহ আব্দুল গনি বারাদার বেইজিং সফরে যান গত বুধবার। তিনি তালেবানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং কাতারের দোহাযর রাজনৈতিক শাখার প্রধান।

চীনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে তালেবান প্রতিনিধি দল, সাম্প্রতিক ছবি

চীন সীমান্তবর্তী আফগানিস্তানের বাদাকশান প্রদেশের গুরুত্বপূর্ণ জেলাগুলো তালেবান দখলে নেয়ার পর এই সফর হলো। চীনে পৌঁছেই উত্তরাঞ্চলীয় তিয়ানজিং শহরে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই’র সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে মিলিত হন মোল্লাহ আব্দুল গনি বারাদার। এর চারদিন আগে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরেশির সঙ্গে চেংডু শহরে দীর্ঘ বৈঠক করেন চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী। পরে এক যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতা নিশ্চিতে যৌথভাবে কাজ করবে বেইজিং ও ইসলামাবাদ।

আফগানিস্তানে অস্থিতিশীলতা বাড়ার প্রভাব প্রতিবেশী চীন ও পাকিস্তানে পড়বে উল্লেখ করে শি জিংপিং প্রশাসন বলছে, এ জন্য দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানো দরকার। আফগানিস্তানে নতুন গৃহযুদ্ধ ঠেকাতে বিবাদমান পক্ষগুলোর মধ্যে মীমাংসার আলোচনায় সাহায্য করবে বেইজিং। এ জন্য ৫ দফা কর্মপরিকল্পনাও ঘোষণা করা হয় চীন-পাকিস্তানের বৈঠক থেকে।

তালেবানের অগ্রাভিযান, ফাইল ছবি

এই তালেবানই সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমান রাশিয়া) বিরুদ্ধে এক দশক যুদ্ধ করে তৎকালীন পরাশক্তি রুশদের পরাজিত করে। তখন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা পেয়েছিল এই গোষ্ঠীটি, যারা এখন বর্তমান পরাশক্তিটির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে দুই দশক ধরে। এবার তাদের পরাজিত করার দ্বারপ্রান্তে এসে নতুন পরাশক্তি হতে চলা চীনের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে তালেবান।

এখন প্রশ্ন হলো- জন্ম থেকে লড়াইয়ের ময়দানে থাকা তালেবানের ওপর এত ভরসা কেন চীনের? সশস্ত্র গোষ্ঠীটি আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করতে চলেছে, সেই বার্তাই দিলো বেইজিং? এর উত্তরে মার্কিন বিশ্লেষক ডেরেক গ্রসম্যান বলছেন, তালেবানরা শিগগিরই আফগান শাসন করতে যাচ্ছে, এটাই মনে করছে চীন। তা ছাড়া এই ইসলামপন্থী গোষ্ঠটি অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার ঘোষণা দিয়েছে, তাতে আস্থা রাখা ছাড়া উপায় নেই জিনপিং প্রশাসনের।

কাতারের দোহায় তালেবান ও মার্কিন আলোচনা, ফাইল ছবি

মালয়েশিয়ার আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষক ড. সৈয়দ মাহমুদ আলী বলেন, তালেবান যে আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করতে যাচ্ছে, অথবা ক্ষমতার প্রধান শরীক হতে চলেছে, তা এখন যুক্তরাষ্ট্রসহ পুরো বিশ্ব মেনে নিয়েছে। সে কারণে তালেবানের সঙ্গে দোহায় আলোচনা করে ২০ বছরের যুদ্ধের অবসান ঘটিয়েছে ওয়াশিংটন। এখন তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে তৎপর হয়েছে চীন।

তালেবানের সাথে চীনের সম্পর্ক কীভাবে সম্ভব? এমন প্রশ্নের জবারে তিনি বলছেন, আল-কায়েদাকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়া তালেবান ২০ বছর পরে এসে এখন অনেক বেশি বাস্তববাদী। সাম্প্রতিক রাজতৈক ও কূটনৈতিক আলোচনা ও পদক্ষেপে সেটি প্রমাণিত। এ জন্য রাশিয়া এবং ইরানের সঙ্গে যেভাবে কথা বলেছে, অনেকটা সেভাবেই কমিউনিস্ট চীনের সাথেও ঘনিষ্ঠ হবে আফগানিস্তান।

অনেক পর্যবেক্ষক বলছেন, চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) প্রকল্পের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ আফগানিস্তানের অবস্থান। দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের হাতছাড়া হওয়ায় এই প্রকল্পে যুক্ত করার মোক্ষম সুযোগ পেয়েছে চীন। এ ছাড়া আফগানদের খনিজ সম্পদের ওপর চোখ তো কম-বেশি সবারই রয়েছে।