ক্ষুধার যন্ত্রণায় স্বাধীনতার অর্থ ফিকে হয়ে আসছে জাইগুলদের কাছে

আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ তালেবানের হাতে যাওয়ার আগেও খুব একটা ভালো অবস্থায় ছিলেন না আফগান নারী জাইগুল ও তার পরিবার। তখনো দুমুঠো খাবার জোগাড় করতে প্রাণপাত করতে হতো জাইগুল ও তার স্বামী নাসিরকে। অন্যের বাসায় কাজ করতেন জাইগুল। আর তার স্বামী বিভিন্ন নির্মাণ সাইটে কাজ করে অর্থ উপার্জন করতেন।

জাইগুল ও তার অসহায় পরিবার

কিন্তু এখন আর তাদের জীবন চলছেই না। পশ্চিমারা বিশেষ কতরে যুক্তরাষ্ট্র ভালো ভালো কথা বললেও আফগানিস্তানের নিজস্ব অর্থছাড়ের ব্যাপারে তাদের অবস্থান বিন্দুমাত্র পাল্টায়নি। ফলে আফগানিস্তানজুড়ে স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা নেমে এসেছে। সব ধরনের উন্নয়ন কাজ থেমে গেছে।

এর প্রভাব পড়েছে জাইগুল-নাসিরের মতো মানুষদের জীবনে। ক্ষুধা মেটানোর খাবার, শীত মেটানোর প্রয়োজনীয় গরম বস্ত্র কোনোকিছুরই সংস্থান হচ্ছে না তাদের। এ অবস্থায় তাদের কাছে স্বাধীনতার অর্থ ফিঁকে হয়ে আসছে।

জাইগুলের মতো অসংখ্য মানুষের দেখা মিলছে আফগানিস্তানের বিভিন্ন প্রান্তে

রাজধানী কাবুলের কাছে অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের (আইডিপি) জন্য নাসাজি ক্যাম্পে বাস করেন নানগারহার প্রদেশের ৩২ বছর বয়সী গৃহবধূ জাইগুল। আগেও তাদের জীবনে অর্থকষ্ট ছিল। কিন্তু তালেবানের ক্ষমতায় ফিরে আসার পর থেকে, ব্যাংকগুলোতে নগদ অর্থের অভাব এবং রাষ্ট্রীয় কর্মচারীদের কয়েক মাস ধরে বেতন না পাওয়ার কারণে দেশটি নজিরবিহীন অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক বিলিয়ন ডলারের আফগান সম্পদ আটকে দেওয়া এবং আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলির তহবিল স্থগিত করা, কয়েক দশকের যুদ্ধ এবং দখলদারিত্ব ভঙ্গুর অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রায় পতন ঘটিয়েছে। লাখো আফগানের মতো জাইগুল-নাসিরের হাতেও কোনো কাজ নেই। আশরাফ ঘানির পশ্চিম-সমর্থিত সরকারের পতন এবং আগস্টে মার্কিন বাহিনীর বিশৃঙ্খল প্রত্যাহারের পর বেশিরভাগ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়েছে।

জাইগুল বলেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হল আর্থিক সমস্যা। আপনি স্বাধীনতা ছাড়া বাঁচতে পারেন, কিন্তু আপনার যদি খাওয়ার কিছু না থাকে তবে আপনি বাঁচতে পারবেন না।

তিনি বলেন, গত আগস্টের পর থেকে অধিকাংশ নির্মাণ প্রকল্প বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা কেউই আর কাজ খুঁজে পাচ্ছি না। সবচেয়ে মৌলিক জিনিস খাবার, গরম কাপড় এবং ঘর গরম রাখার জন্য একটি হিটারের অভাব অনুভব করছি আমরা।

জাইগুলের দুই কিশোরী মেয়ে তার পাশে কুঁকড়ে ছিল। সবচেয়ে ছোট সন্তান সানার পা ছিল খালি। চরম ঠাণ্ডা সত্ত্বেও তার জামাকাপড়গুলো খুব কমই তার ছোট শরীরকে ঢাকতে সক্ষম হয়েছিল। ঠাণ্ডা পাথরের মেঝেতে পড়ে থাকা কয়েকটি জীর্ণ গদি ছাড়া জাইগুলের এক কক্ষের বাড়িটি ছিল পুরোটাই খালি। দিনের বেলায় যা গদি হিসেবে ব্যবহৃত হতো, রাতে তাই রূপান্তরিত হতো বিছানায়। আর কোণে, একটি খালি আটার থলি একটি মরিচা পড়া চুলার পাশে বসেছিল, যেটিতে তারা রুটি বানাতেন।

জাইগুল বলেন, এখন আমার বাচ্চারা আবর্জনা সংগ্রহ করতে যায়। সেগুলো আমরা বিক্রির চেষ্টা করি অথবা সেগুলো পুড়িয়ে নিজেদের গরম রাখি। মাঝে মাঝে আমি ভিক্ষা করতে রাস্তায় যাওয়ার কথা ভাবি।

পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞাগুলো যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিকে একটি বড় ধরনের সমস্যার মুখে ফেলে দিয়েছে। কারণ এ নিষেধাজ্ঞার ফলে আন্তর্জাতিক এনজিওগুলো তাদের কার্যক্রম বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে।

এর ফলে জাইগুল একা নয়, তার মতো হাজারো লাখো আফগান পরিবারে নেমে এসেছে অন্ধকারের অমানিশা। পশ্চিমা দেশগুলো আফগানিস্তানে নারীদের অধিকার, তাদের স্বাধীনতা নিয়ে সোচ্চার। কিন্তু তাদের যে প্রাণই ওষ্ঠাগত, তার খবর নেওয়ার মতো কেউ নেই। ক্ষুধার যন্ত্রণায় ক্রমশই স্বাধীনতার অর্থ, অধিকারের অর্থ ফিকে হয়ে আসছে জাইগুলদের কাছে।

গত মঙ্গলবার জাতিসংঘ জানায়, প্রায় ২২ মিলিয়ন মানুষ, যা আফগানিস্তানের জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি তীব্র ক্ষুধার সম্মুখীন। এ অবস্থায় মানবিক বিপর্যয় এড়াতে বিশ্বের কাছে দেশটির জন্য প্রায় ৫০০ কোটি ডলার সহায়তা চায় সংস্থাটি।

সূত্র: আল জাজিরা