গরীবের হোটেল: ৩০ টাকায় গরুর মাংস, ডিম-সবজি, পেট চুক্তিতে ভাত

রাত তখন ১টা ১৫ মিনিট। রাজধানীজুড়ে কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস। শীতের রাতে পুরো রাজধানীবাসী লেপ-কম্বল মুড়ি দিয়ে হয়তোবা ঘুমিয়ে। শুধু ঢাকার প্রধান সড়কগুলোতে সিএনজি, প্রাইভেটকারসহ অল্প কিছু গাড়ি চলছে। মিরপুর ১০ নম্বর গোল চত্বর পেরিয়ে একটু সামনে এগিয়ে যেতেই চোখে পড়লো বট গাছের নিচে হালকা আলোতে ৬০ বছর বয়সী এক ব্যক্তি প্লেট পরিষ্কার করছেন। দেখেই বোঝা যাচ্ছিলো সবেমাত্র কেউ একজন ওই প্লেটে ভাত খেয়েছে। প্লেটটিতে লেগেছিল ডাল ভাতের উচ্ছিষ্ট অংশ।

আমি এটাকে গরীবের হোটেল নাম দিছি, যারা রেগুলার খায় তারাও গরীবের হোটেল নামেই ডাকে

কাছে যেতেই বয়স্ক ব্যক্তিটি জোরে জোরে বলতে লাগলেন, ‘মামা খাইবেন নাকি গরীবের হোটেলে’। তার কথা শোনার পর চোখ পড়লো একটি ভ্যান গাড়িতে কয়েকটি পাতিলে বেশ কিছু খাবার ঢাকনা দিয়ে ঢাকা রয়েছে। ভ্যানটির পাশেই রাখা আছে ৩টি প্লাস্টিকের টুল।

একটু পরেই সেখানে এসে থামলো একটি সিএনজি। সিএনজি চালক নেমে এসেই বলল, মামা তাড়াতাড়ি ভাত দেন। বলেই হাত ধুয়ে সেই প্লাস্টিকের টুলে বসে পড়লেন সিএনজি চালক।

অন্যদিকে ভ্যানের ওপরে রাখা প্লেটে ভাত ভরিয়ে তার ওপর গরুর মাংস, একটি ডিম ভাজি, একপাশে কিছু সবজি ও ডাল ঢেলে প্লেটটি সিএনজি চালকের হাতে তুলে দিলেন ‘গরীবের হোটেলের’ মালিক।

পরম তৃপ্তির সঙ্গে ভাতের প্লেটটি খালি করলেন সিএনজি চালক। এরপর বললেন, ‘আরেকটু ভাত আর মাংসের ঝোল দেন’। সাথে সাথেই প্লেটটি নিয়ে আবারও প্লেট ভর্তি ভাত ও একটু মাংসের ঝোল এবং  ডাল ঢেলে দিলেন গরীবের হোটেলের মালিক সেই ৬০ বছরের বৃদ্ধ। এবার খাবার শেষ করে দ্রুত বিল পরিশোধ করে চলে গেলেন সিএনজি চালক।

কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো, এতকিছু খাওয়ার পর মাত্র ৩০ টাকা দিয়ে চলে গেলেন তিনি। এরপর সেখানে এসে দাড়ালেন এক পাঠাও চালক। তিনিও পেট ভরে ভাত খেয়ে ৩০ টাকা দিয়ে চলে গেলেন।

এবার কৌতুহলী হয়ে কথা হলো সেই ‘গরীবের হোটেলের’ মালিকের সঙ্গে। তিনি জানালেন, তার নাম আব্দুর রহিম। গ্রামের বাড়ি ভোলা জেলায়। এখন থাকেন মিরপুরের একটি বস্তিতে। সংসারে ৪ মেয়ে ও ২ ছেলে রয়েছে ।

আব্দুর রহিম বলেন, ‘আগে আমি ইলেকট্রনিক এর ব্যবসা করতাম। দেশের বহু জায়গায় গেছি জিনিসপত্র বিক্রি করতে। এখন শরীরে বল নাই। তাই দৌড়াদৌড়ি করতে পারি না। অভাবের সংসারে এই ব্যবসা বেছে নিছি। লাভ খুব বেশি হয় না। কিন্তু আমার মত কিছু গরীবরে খাওয়াতে পারি; এ জন্য ভালো লাগে।’

গরীবের হোটেলে নাম কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার এখানে যারা খায় তারা সবাই রিকশাওয়ালা, সিএনজি চালক, রাস্তার ভিখারী, ফুটপাতে ঘুমায় এমন মানুষ। তারা সবাই গরীব। তাই আমি এটাকে গরীবের হোটেল নাম দিছি। যারা রেগুলার খায় তারাও গরীবের হোটেল নামেই ডাকে।

খাবার কোথায়, কীভাবে রান্না করা হয় জানতে চাইলে আব্দুর রহিম বলেন, আমার মেয়ে, বউ রান্না করে বাসাতে। আমি শুধু রাইতে এখানে বিক্রি করি। পুঁজি বেশি নাই, হাজার দেড়েক টাকার বাজার করি। কোনোদিন ২ হাজার, কোনোদিন ২৫০০ টাকা বিক্রি হয়।’

কিন্তু মাত্র ৩০ টাকায় কীভাবে গরুর মাংস, ডিমভাজি, সবজি, ডালসহ পেটচুক্তি ভাত খাওয়ান- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘গরুর মাংসের তো দাম অনেক। তাই মাথার ও ছাটের কিছু মাংস অল্প দামে কিনি। এরপর সামান্য মাংসে প্রায় এক পাতিল ঝোল দিয়ে রান্না করি। খাওয়ানোর সময় এক-দুই টুকরো মাংস দেই আর ঝোল দেই বেশি। গরীব মানুষ খায়, তাদের মাংসের ঝোল হলেই চলে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আর ডিম তো প্রতিজনের জন্য একটা করে দেই না। একসাথে অনেকগুলো ডিম ভেঙে একবারে ভাজি করি। সেখান থেকে কেটে একটু করে দেই। মনে করেন, একটা ডিম ভাজি চাইর জনকে খাওয়াই।’

এই ভাত বিক্রেতা বলেন, ‘ভাত তো এখন মানুষ তেমন একটা বেশি খেতে পারে না। আগের যুগে তো এক কেজি চালের ভাত একজনই খেয়ে ফেলতো। শুধু ভাত থাকে না, খিচুড়িও থাকে, মাছ থাকে যে যেটা খায়। তবে সবজির দামটা মাঝেমধ্যে কম-বেশি হয়। তবুও সব মিলে পোষায়ে নিতে পারি।’

ফুটপাতে মধ্যরাতে খাবার বিক্রি করেন, কাউকে কোন চাঁদা দিতে হয় কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না বাবা। আমি গরীব বয়স্ক মানুষ। অল্প টাকার ব্যবসা। তাও দিনের বেলা হইলে হয়তো অনেককেই টাকা দেয়া লাগতো। রাইতের বেলা সরকারি রাস্তায় ভাত বিক্রি করি কেউ টাকা পয়সা চায় না। তবে মাঝেমধ্যে কিছু হিরোইন্সি (নেশাখোর) পোলাপান এসে ভাত খাইতে চায়। ওরা টাকা পয়সা দেয় না তাও মানবতার জন্য খাওয়াই।’

ভবিষ্যতে এই ব্যবসা বড় করার কোনো ইচ্ছে আছে কি-না জানতে চাইলে গরীবের হোটেলের মালিক আব্দুর রহিম বলেন, ‘আমি নিজে গরীব, খাওয়াইও গরীবদের। তাই যেমন আছি তেমনই ভালো। প্রতি রাতে ১২টার দিকে ভাত তরকারি নিয়ে চলে আসি রাত ২-৩ টার মধ্যে সব বেইচা চলে যাই। আল্লায় ভালো রাখছে আর বেশি লাভের দরকার নাই। আমার এই গরীবের হোটেলই মৃত্যু পর্যন্ত চালাতে চাই।’