‘আমারে ছেলেটারে কেউ খুঁজে দেন, এত দিন হলো ছেলেটারে দেখি না’

‘আমার একটাই মাত্র সন্তান। ও ছাড়া পৃথিবীতে আর কি নিয়ে বেঁচে থাকবো আমি। আমার ছেলেটারে কেউ খুঁজে দেন। ১৬ বছর যাবত একলা একলা বুকে আগলে রাখছি ওরে। কত কিছুই না করছি ওর জন্য। এত দিন হলো ছেলেটারে দেখি না।’

বায়ে ছেলে রাইয়ান, ডানে বাবা আরিফ

কথাগুলো বলতে বলতে চোখ বেয়ে গড়গড়িয়ে পানি ঝড়ছিল নাসিম আনোয়ার আরিফের। এক প্রতিবন্ধী ছেলের বাবা তিনি। রাইয়ান নামের সেই প্রতিবন্ধী ছেলেটি বিগত সাড়ে তিন মাস ধরে নিখোঁজ।

২০০৬ সালে স্ত্রীর সাথে ডিভোর্স হয়ে যায় নাসিম আনোয়ার আরিফের। তখন রাইয়ানের বয়স মাত্র ৫ বছর। ডিভোর্সের পর স্ত্রী অন্যত্র বিয়ে করে ঘর বাধলেও নিজের একমাত্র প্রতিবন্ধী ছেলে রাইয়ানকে নিয়ে একাই কাটিয়েছেন ১৬ বছর। সন্তানের কথা ভেবে দ্বিতীয় বিয়ে পর্যন্ত করেননি আরিফ।

একটি বেসরকারি এনজিওতে চাকরির পাশাপাশি ছেলের দেখাশোনা করেই পার করেছেন জীবনের স্বর্নালী দিনগুলো। বাবা ছেলের বিগত ১৬ বছর বেশ ভালোই কাটছিল।

ছেলেকে খাওয়ানো, গোসল করানো, ঘুম পাড়ানো সব কিছু নিজের হাতেই করতেন আরিফ। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা তেমন না থাকলেও তার ছেলে রাইয়ান ছিল বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। ছেলের খোঁজ রাখতে ট্র্যাকার মেশিন কিনে পকেটে রেখে দিতেন আরিফ। যাতে খুব সহজেই ছেলের অবস্থান বুঝতে পারেন তিনি।

ঘর থেকে একটু বাইরে বের হলেই ছেলের গলায় প্রতিবন্ধী লেখা একটি আইডি কার্ডও ঝুলিয়ে দিতেন যাতে কখনো হারিয়ে গেলে কোন মানুষ তার সঠিক ঠিকানা জানতে পারে এবং বাড়িতে খরব পাঠাতে পারে।

ডিভোর্স হয়ে যাওয়া মায়ের বিয়ে হয়েছে একই মহল্লাতে। মাঝেমধ্যে নিজের মায়ের কাছেও একা-একা দেখা করতে যেত রাইয়ান। মা অথবা মায়ের কোন স্বজন রাইয়ানকে তার বাবার বাসার কাছাকাছি পৌঁছে দিত।

মিরপুর কাফরুল থানা এলাকার ইব্রাহিমপুর বাজারে পাশেই ছয় বিল্ডিং রোডে ছেলে রাইয়ানকে নিয়ে একাই বসবাস করতেন বাবা নাসিম আনোয়ার আরিফ।

ছোটবেলা থেকে একই এলাকায় বড় হওয়ার বাসার আশেপাশের দোকানি, প্রতিবেশী, চাওয়ালা, রিকশাওয়ালাসহ অনেকেই চিনতো রাইয়ানকে।

বাসা থেকে একা-একাই বের হতো রাইয়ান। অনেকের সাথে কথা বলতো। হাসি ঠাট্টা করতো। গল্প করতো। রাস্তায় যাকে পেতো তার সাথেই কথা বলার স্বভাব ছিল রাইয়ানের। ছেলে প্রতিবন্ধী হওয়ায় বাবা আরিফ খুব বেশি নজরদারিতে রাখতেন ছেলেকে।

কিন্তু ২০২১ সালের ২১ নভেম্বর সকাল ৯ টায় বাসা থেকে বেরিয়ে আর ফিরে আসেনি রাইয়ান। ছেলের সন্ধান পেতে মাইকিং, প্রচারণা, থানায় জিডির পাশাপাশি জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ছেলের ছবি বুকে নিয়েও দাঁড়িয়ে ছিলেন বাবা আরিফ। ঘটনার সাড়ে তিন মাস পার হলেও আজও খোঁজ মেলেনি রাইয়ানের। পাগলের মতো ছেলের খোঁজ পেতে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন বাবা আরিফ।

আরিফ বলেন, '২১ নভেম্বর সকাল ৯টায় বাসা থেকে বের হয় রাইয়ান। এরপর আর বাসায় ফেরে নাই। সকালে নাকি ওর মায়ের কাছে গিয়েছিল। আমার সাথে ডিভোর্স হওয়া পর আমার বাসার কাছেই আরেকটি বিয়ে করেন আমার সাবেক স্ত্রী। তার বাসাও আমাদের বাসার কাছাকাছি। সেখানে মাঝেমধ্যে যেতো রাইয়ান।'

তিনি আরও বলেন, 'ঘটনার দিন বেলা সাড়ে ১১টার দিকে তার এক বোন তাকে আমার বাসার গেটের কাছাকাছি রেখে গিয়েছিল। কিন্তু রাইয়ান বাসায় ঢুকে নাই। সারাদিন তাকে মাইকিং করে খুঁজেছি। বহু লোকজন একসাথে হয়ে পুরো এলাকা খোঁজাখুজি করেছি। পরে খোঁজ না পাওয়ায় কাফরুল থানায় গিয়ে একটি জিডি করেছি। জিডি নম্বর-১৩৬৪।'

এর আগে কি কখনো এভাবে হারিয়ে গিয়েছিল রাইয়ান এমন প্রশ্নের জবাবে বাবা আরিফ বলেন, 'একবার হারিয়েছিল। সারাদিন খোঁজাখুজি করে রাতের বেলা মিরপুর ১৪ নম্বর হোপের গলিতে পেয়েছিলাম তাকে৷ সে আসলে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী হলেও এলাকার ওলিগলি চিনতো ঘোরাফেরা শেষে একাই বাসায় ফিরে আসতো।"

নিখোঁজ হওয়ার পরের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, 'রাইয়ানের নিখোঁজ হওয়ার পরের দিন অর্থাৎ ২২ নভেম্বর শ্যাওড়াপাড়ায় দেখা গেছে বলে এক রিকশাওয়ালা আমাকে জানায়। আসলে ওই রিকশা চালক আগে থেকেই রাইয়ানকে চিনতো। কিন্তু সে যে আগের দিন হারিয়ে গেছে এটা রিকশা চালক বুঝতে পারে নাই। এরপর বিষয়টি জানার পর আমি নিজেও শ্যাওড়াপাড়া এলাকার অনেক খোঁজাখুঁজি করেছি কিন্তু কেউ বলতে পারেনি রাইয়ান কই।"

আমার মনে তো এখন অন্য ভয়। রাইয়ান কোন খারাপ মানুষ বা খারাপ চক্রের হাতে পড়ে নাই তো। আমার ছেলের কিডনি, লিভার অঙ্গ পাচারকারীদের হাতে পড়ে নাই তো, বলতে বলতেই হু হু করে কান্না শুরু করেন নিখোঁজ রাইয়ানের বাবা আরিফ।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে কাফরুল থানার উপ পরিদর্শক (এসআই) এস এম সাদ্দাম হোসেন বলেন, নিখোঁজ রাইয়ানের সন্ধানে সব রকমের চেষ্টা করা হচ্ছে। সকল থানায় মেসেজ পাঠানো হয়েছে। ডিএমপির মিডিয়া সাইটসহ একাধিক সোসাল মিডিয়াতে প্রচার করা হয়েছে।

রাইয়ানের নিখোঁজের পেছনে অন্য কোন রহস্য লুকিয়ে আছে কি না তাও তদন্ত করে দেখা হচ্ছে বলে জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা।