রাশিয়ার তেল কিনেই চলেছে যুক্তরাষ্ট্র, বেকায়দায় ইউরোপ

রাশিয়ার বিরুদ্ধে আরোপিত নিষেধাজ্ঞার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে ইউরোপের অর্থনীতিতে। ব্রিটেনসহ কয়েকটি দেশে জ্বালানি ও অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে। রাশিয়ার গ্যাস সরবরাহ ব্যাহত হলে জার্মানির শিল্প খাত মুখ থুবড়ে পড়বে বলে সতর্ক করেছেন সংশ্লিষ্টরা। এদিকে ইউরোপকে নিষেধাজ্ঞায় বাধ্য করে যুক্তরাষ্ট্র নিজেই রাশিয়া থেকে জ্বালানি কেনা বাড়িয়েছে বলে জানিয়েছেন রুশ কর্মকর্তারা।

রাশিয়ার বিরুদ্ধে আরোপিত নিষেধাজ্ঞার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে ইউরোপের অর্থনীতিতে

রাশিয়ার জাতীয় নিরাপত্তা পর্ষদের উপ-সচিব মিখাইল পোপভ বলেছেন, ইউরোপের দেশগুলোকে রাশিয়া-বিরোধী নিষেধাজ্ঞায় সাড়া দিতে বাধ্য করে যুক্তরাষ্ট্র নিজেই রাশিয়া থেকে তেল কেনা বাড়িয়েছে। গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়া থেকে আগের তুলনায় ৪৩ শতাংশ বেশি তেল কিনেছে। রাশিয়া থেকে গড়ে দৈনিক এক লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত তেল কিনছে যুক্তরাষ্ট্র, যদিও তারা ইউরোপের দেশগুলোকে এ সুযোগ নিতে দিচ্ছে না।

ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেছেন, রাশিয়ার বিরুদ্ধে অপরিণামদর্শী নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় যুক্তরাজ্যসহ কয়েকটি দেশকে ভুগতে হচ্ছে। যেমন ব্রিটিশ শেল কোম্পানি রাশিয়া থেকে গ্যাস কিনতে পারছে না স্রেফ লন্ডনের রাশিয়া-বিরোধী নীতির কারণে। রাশিয়া-বিরোধী সবকিছুতে লন্ডন নেতা হতে চায়। এমনকি তারা এক্ষেত্রে ওয়াশিংটনের চেয়ে আগে থাকতে চায়। এর মূল্য এখন দিতে হচ্ছে।

তিনি বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) চেয়ে একধাপ এগিয়ে গ্যাজপ্রমব্যাংকের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাজ্য। এ কারণে ব্রিটিশ কোম্পানিটি এখন রুবলেও রাশিয়ার গ্যাস কিনতে পারছে না। রাশিয়া থেকে গ্যাস কেনার ক্ষেত্রে রুবলে মুল্য পরিশোধের যে নিয়ম চালু হয়েছে, সেটা ধীরে ধীরে অন্য পণ্যের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে বলে পেসকভ জানান।

এদিকে ইউক্রেনে অভিযানের পরপর রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ইউরোপীয় দেশগুলোর যে রাজনৈতিক ঐক্য দেখা গেছে, মস্কোর জ্বালানি-অস্ত্র প্রয়োগের জেরে তাতে কিছুটা চিড় ধরতে দেখা যাচ্ছে। পূর্ব ইউরোপের দেশ মলদোভার প্রেসিডেন্ট মাইয়া সানদু রাশিয়া থেকে গ্যাস আনা অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়ে রেডিও ফ্রি ইউরোপকে বলেছেন, মলদোভা নিরপেক্ষ থাকবে এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে পাশ্চাত্যের আরোপিত নিষেধাজ্ঞায় যোগ দেবে না।

একইভাবে বেলারুশ ও স্লোভাকিয়ার সরকার রুবলে গ্যাসের মুল্য পরিশোধে প্রস্তুত বলে জানিয়েছে। স্লোভাকিয়ার অর্থমন্ত্রী রিচার্ড সুলিক বলেছেন, রাশিয়া থেকে আসা গ্যাসের সরবরাহ বন্ধ করা সম্ভব নয়। তারা যদি রুবলে গ্যাসের দাম পরিশোধের শর্ত দেয়, আমরা সেভাবেই কিনবো।

অবশ্য লিথুয়ানিয়ার জ্বালানি মন্ত্রণালয় বলেছে, এপ্রিলের প্রথম দিন থেকে লিথুয়ানিয়া রাশিয়ার গ্যাস আমদানি করছে না। তবে প্রতিবেশী দেশ হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ওরবান বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে কেনা বেশি দামের গ্যাসকে রাশিয়ার গ্যাসের স্থলাভিষিক্ত করা ইউরোপের পক্ষে সম্ভব হবে না।

এর আগে গত বৃহস্পতিবার রুবলে গ্যাসের মূল্য পরিশোধ-সংক্রান্ত এক আদেশ জারি করে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেন, ইউক্রেন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের ফাঁদে পা দিয়েছে ইউরোপ। রাশিয়ার গ্যাসের পরিবর্তে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বেশি দামে গ্যাস কিনতে বাধ্য হলে ইউরোপের শিল্প-কারখানাগুলোর প্রতিযোগিতা-সক্ষমতা কমবে। যুক্তরাষ্ট্র এর ফায়দা নেবে।

এদিকে জ্বালানি নিয়ে ইউরোপের জেরবার অবস্থার মধ্যেই রাশিয়া থেকে গ্যাস আমদানি বন্ধের প্রস্তাব দিয়েছেন জার্মানির প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ক্রিস্টিন ল্যামব্রেখট। রোববার জার্মানির রাষ্ট্রায়ত্ব সম্প্রচার সংস্থা এআরডির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নকে অবশ্যই রাশিয়ার গ্যাস আমদানি বন্ধের বিষয়ে আলোচনায় বসতে হবে।

এর আগে ল্যামব্রেখটের সহকর্মী জার্মান অর্থমন্ত্রী ক্রিশ্চিয়ান লিন্ডনার বলেছেন, ইউক্রেন পরিস্থিতি জার্মান নাগরিকদের স্বাচ্ছন্দ্য কমাবে। ক্রিশ্চিয়ান লিন্ডনারের কথা কতটুকু সত্য সেটা বুঝা যায় জার্মানির খুচরা বাজার পরিস্থিতি দেখলে। জার্মানির অন্যতম বৃহৎ রিটেইল চেইন আলডি সোমবার (৩ এপ্রিল) থেকে সব খাদ্যপণ্য ও খাবার আইটেমের মূল্য ২০ থেকে ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি করার ঘোষণা দিয়েছে।

ভোজ্য তেল সাশ্রয় ও গ্যাস সংকটের কথা মাথায় রেখে ফ্রেঞ্চ ফ্রাইসহ কয়েকটি বহুল বিক্রিত আইটেম উৎপাদন ও পরিবেশন বন্ধ করেছে জার্মানির অনেক রেস্তোরাঁ। বর্ধিত জ্বালানি মূল্যের প্রতিবাদে রোববার বার্লিনে গাড়ি মিছিলে অংশ নিয়েছে পাঁচ হাজারের বেশি যানবাহন।

রাশিয়া থেকে জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ হলে জার্মানির শিল্প খাত মুখ থুবড়ে পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ফেডারেল ইউনিয়ন অব জার্মান ইন্ডাস্ট্রির প্রেসিডেন্ট সিগফ্রিড রাসবুর্ম বলেছেন, রাশিয়া থেকে জ্বালানি সরবরাহ অব্যাহত না রাখলে জার্মানিতে শিল্পোৎপাদনে ধস নামবে। একইভাবে জার্মানির ও বিশ্বের বৃহত্তম কেমিক্যাল কোম্পানি বিএএসএফ-এর সিইও মার্টিন ব্রুডমুলার বলেছেন, রাশিয়া থেকে জ্বালানি সররবাহের উপর নিষেধাজ্ঞার যুক্তি নেই। এতে করে জার্মানি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে গুরুতর সংকটে পড়তে পারে।

এ পর্যন্ত রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞায় কাজ হচ্ছে না বলে মন্তব্য করেছেন পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মাতিউস মোরাওয়েস্কি। তিনি বলেন, রাশিয়ার বিরুদ্ধে আরোপিত নিষেধাজ্ঞাগুলো কাজ করছে না। রুশ মুদ্রা রুবল চাঙ্গা হওয়া থেকেই বিষয়টি বুঝা যাচ্ছে।