আপনি পড়ছেন

মহান আল্লাহ তা’লা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের জন্য সিয়ামের বিধান দেয়া হল- যেমন তোমাদের আগেকার লোকদের দেয়া হয়েছিল, যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পার।’ (বাকারা ২: ১৮৩)

laylatul qadr 2021ফাইল ছবি

এ আয়াতগুলি নাযিল হয়েছিল দ্বিতীয় হিজরীর শাবান মাসে। অর্থাৎ পরের মাসেই রমজানের রোজা রাখার বিধান আসলো, তবে প্রথম বছর হিসেবে কিছু ছাড় দেয়া হয়েছিল। সামর্থ থাকা সত্ত্বেও রোজা না রেখে ফিদিয়া দেয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছিল (বাকারা ১৮৪)। যদিও পরের বছরের রোজার পূর্বেই তা রহিত করা হয় (বাকারা ১৮৫)। প্রথম বছর এই ছাড় সাহাবাদের মধ্যে কতজন বা কে কে গ্রহণ করেছিলেন তা জানা যায় না। বুঝা যায় অধিকাংশ রোজা রেখেছিলেন।

চলুন না, কিছু সময়ের জন্য ওই সময়ে আমরা ফিরে যাই। এই নিদর্শন যাদের উপর নাযিল হল তারা কারা? প্রথমত: ছিলেন মুহাজিররা, যারা এই মাত্র কিছুদিন হয় বাড়ি-ঘর, পরিবার-পরিজন সর্বস্ব ছেড়ে দ্বীনের স্বার্থে মক্কা ছেড়ে মদিনায় হিযরত করেছেন। আর ছিলেন মদীনার আনসাররা। তাদের বেশীরভাগই এই ক’দিন হল ইসলাম কবুল করেছেন। গোটা বিশ্বের বিরোধিতা মাথায় নিয়ে রসুল (স.)-ও সাহাবীদের আশ্রয় দিয়েছেন। নিজেদের শহরকে ইসলামের হেড কোয়াটার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে গোটা বিশ্বের শত্রুতার লক্ষ্যে পরিণত হয়েছেন। তাদের মধ্যে সমস্যার শেষ নেই। পারস্পরিক বোঝাপড়া কেবল শুরু হয়েছে। সেই সাথে ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-মুনাফিকদের চক্রান্ত। ইহুদীদের বিরোধিতা। নিজেদের চারিত্রিক ও নৈতিক বিকাশ এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে। মদ, জুয়া এখনো পুরোপুরি হারাম হয়নি। মুসলমানদের অনেকেই এখনো মদপান করছেন। এমনকি মদ পান করে নামাজেও আসছেন। সেজন্য কিছুদিন পর সুরা নিসায় মদ্যপ অবস্থায় নামায আদায়ে নিষেধাজ্ঞা আসলো (নিসা: ৪৩)।

এই যখন অবস্থা তখন তাদের বলা হল আগামী মাসে গোটা মাস দিনের বেলা খানা-পিনা ও স্ত্রী সম্ভোগ বন্ধ। আজকের মানুষ হলে হয়তো বলতো, ‘This is asking too much’ বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। বলে যে নাই তাই বা বলি কিভাবে। মুনাফিকরা নিশ্চয়ই নিজেদের মধ্যে বলাবলি করে থাকবে। কিন্তু আনসার আর মুহাজিররা সন্তুষ্ট চিত্তে তা মেনে নিয়েছেন। রোজা তো রেখেছেনই, ১২/১৪ দিন রোজা রাখার পর যখন বদর অভিযানের নির্দেশ এল তখন ১৭ রমজান তারিখে কাফির বাহিনীর এক তৃতীয়াংশ, অপ্রস্তুত ও অভুক্ত মানুষগুলো বিশ্বের ইতিহাস বদলে দিলেন।

বাহ্যিক বিবেচনায় অসময়োচিত বা কৌশলগত দৃষ্টিকোণ থেকে অগ্রহণযোগ্য এই সিদ্ধান্ত সাহাবায়ে কেরাম মেনে নিলেন- তার মূলে ছিল তাদের ঈমান যে, আল্লাহ তা’লার নির্দেশ তাঁর বান্দাদের জন্য শুধুই কল্যাণ বয়ে আনবে। আর সত্যই তারা সেই কল্যাণ লাভ করলেন। রোজার হুকুম দিয়ে আল্লাহ বললেন, ‘তিনি তোমাদের জন্য যা সহজ তা চান, তিনি তোমাদের জন্য কঠিন করতে চান না।’ (বাকারা ১৮৫)

‘সহজ করতে চান’ দুভাবে: প্রথমত: বিধান পালনে সহজতা দান, যেমন অসুস্থ বা সফরে থাকলে পরে আদায়। আবার চিররুগ্নের জন্য ফিদিয়া দেয়ার মাধ্যমে।

দ্বিতীয়ত: আল্লাহর হুকুম পালন বান্দার মধ্যে এমন যোগ্যতা তৈরি করবে, যা দ্বীনের পথে চলা তার জন্য সহজ করে দিবে। একটা কল্যাণময় আদর্শবাদী জাতির মধ্যে থাকা দরকার-

-সততা

-ধৈর্য্য

-কষ্ট সহিষ্ণুতা

-সংযম

-মেজাজের ভারসাম্য

-কল্যাণকামীতা

-দায়িত্বশীলতা

-নিয়মানুবর্তিতা

আর দেখুন, রোজা এসবগুলো গুণ সৃষ্টির এক দীর্ঘমেয়াদী প্রশিক্ষণ। একনাগাড়ে অবিরাম কাজগুলি করার মাধ্যমে আমাদের মধ্যে এই যোগ্যতাগুলি তৈরি হওয়ার কথা ছিল, যেমন হয়েছিল সাহাবায়ে কেরাম (রা.) এর মধ্যে। কিন্তু হচ্ছে না। হলেও খুবই কম। ধরে রাখতে পারছি না। কারণ সিয়ামের উদ্দেশ্যই আমরা বদলে নিয়েছি।

আল্লাহ কেন্দ্রীক ও আল্লাহমুখী জীবনযাপনের জন্য তাকওয়ার গুণ অপরিহার্য। ভাল কাজগুলি করা এবং খারাপ কাজগুলি ছাড়ার যোগ্যতাই হল তাকওয়া। তাকওয়া সপন্ন মানুষের মানসিক প্রেরণা হল ভাল কাজ একটিও ছাড়বো না, মন্দ একটিও করবো না। এই লক্ষ্যেই সে অবিরাম প্রচেষ্টা (Strive) করে যায়। কুরআনী পরিভাষা হল ‘সা’আ’। বলা হয়েছে-
‘তোমাদের ‘সা’আ’ তথা চেষ্টা প্রচেষ্টা বিভিন্ন প্রকার। অতএব, যে দান করলো, তাকওয়ার নীতি আকড়ে ধরলো এবং সত্য সার্বিক জীবনব্যবস্থা ইসলামকে সত্য বলে মেনে নিল, আমি তার জন্য সহজ করে দিব জান্নাতের সহজ পথ। আর যে কৃপণতা করলো, নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ মনে করলো এবং সত্য সঠিক জীবনব্যবস্থা ইসলামকে অস্বীকার করলো, আমি তার জন্য সহজ করে দিব জাহান্নামের কঠিন পথকে।’ (সুরা লাইল ৯৪:১০)

বান্দা যে পথে চলতে চায় এবং চলার চেষ্টা করে আল্লাহ তা সহজ করে দেন। যে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও জান্নাত চায় সে তাকওয়ার পথে প্রচেষ্টা চালায়, রোজা তার ভিতরের সত্য ও সততার মানসিকতাকে জোরদার করে এবং কল্যাণের পথে চলার দৃঢ়তা দান করে। এটা এক দিন বা এক রমজানের বিষয় নয়। তাই বছর ঘুরে আবার রমজান। বান্দাকে শক্তিশালী করতে আল্লাহ হুকুম পালন ও তার উপরে দৃঢ়তা অবলম্বনকে তার জন্য সহজ করে দিতে চান। যেমন হয়েছিল সাহাবাদের। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে যেন তা হচ্ছে না।

বস্তুত: আল্লাহর হুকুম মেনে জীবন-যাপন করতে হবে এমন কোনো সিদ্ধান্তই বর্তমানের অধিকাংশ মুসলমানের নেই। রোজা রাখছি ধর্মের বিধান মানছি। ব্যস, এর থেকে বেশি কি ভাবার আছে। তাই দেখা যায়, সারাদিন রোজা রেখে মসজিদে মাগরিবের নামায আদায় করে ভাইরা সিগারেটে সুখটান দিচ্ছেন। আপারা বেপর্দা মার্কেটে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। দোকানিরা ভেজালের কারবার করছেন, তাতেও মাপে-ওজনে কম দিয়ে। মিথ্যায় সয়লাব চারিদিক। সবাই নিজ নিজ আমলে সন্তুষ্ট, কারোই যেন চিন্তার কোনো কারণ নেই। কিন্তু প্রিয় ভাই ও বোনেরা, চিন্তার বিষয় হল নবী (স.)-এর কথা-

‘যে রোজা রেখে মিথ্যা কথা ও মিথ্যার উপর আমল এবং জাহেলী কাজকর্ম ছাড়তে পারলো না তার খানা-পিনা ছেড়ে দেয়াতে আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।’ (বুখারী)

যিনি এই রোজার বিধান নিয়ে আসলেন তিনিই যখন এই হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তখন তাতে গভীর চিন্তার বিষয় আছে বৈকি। এটা তো আর আমাদের মতো হুজুরদের কথা না। যাদের ২ টাকায় কেনা যায়, যা ইচ্ছা তা বলানো বা করানো যায়। নবী (স.)-এর এই হুঁশিয়ারি আমাদের আমলে নিতে হবে। কোথায় গলদ খুঁজে দেখতে হবে। নিজেদের স্বার্থেই তাতে পরিবর্তন আনতে হবে। সবাই করে বলে আমরাও করি এ মানসিকতা বর্জন করি। এমনটাই চলে আসছে বলে তা-ই ঠিক এ মানসিকতা কত ভুল তা সবাই বুঝি।

আল্লাহ সুবহা’নাহু ওয়া তা’লার নির্দেশের তাৎপর্য নবী (স.)-এর সাবধানবানী অবশ্যই আমাদের পুণর্মূল্যায়ন করে দেখা দরকার। রোজা রাখছি তো তাকওয়া হচ্ছে না কেন, তা ভেবে দেখার জন্য সবার কাছে অনুরোধ রইলো।

কেন? এ প্রসঙ্গে ছোট্ট কথা হল আমাদের ঈমানী বুঝেই বড় রকম ফাঁক রয়ে গেছে। ঈমানের একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল আত্মপরিচয় ও দুনিয়ার জীবনের তাৎপর্য। আত্মপরিচয় প্রসঙ্গে কথা হল- ঈমানের প্রথম কথাই হল আমি কে? জবাবে সবাই বলবো আল্লাহর বান্দা।

কুরআনের দৃষ্টিতে এ কথার মধ্যে অসম্পূর্ণতা থাকলেও মৌলিকভাবে কথাটা সত্য। কিন্তু যদি জিজ্ঞাসা করেন কাউকে এই যে বলি আমরা আল্লাহর বান্দা-বান্দী- এর তাৎপর্য কি? অর্থাৎ এ দিয়ে আমার অবস্থানটা কি বলে মনে করছি? আমি বান্দা বা বান্দী - তাহলে কি আমার নিজের ইচ্ছামতো চলার অধিকার আমার আছে? নিজের জন্য, অন্যের জন্য নিয়মকানুন, রীতি পদ্ধতি, আইন-কানুন জানানোর ইখতিয়ার কি রাখি আমি? উত্তর হল ‘না রাখি না’। কিন্তু তেমনটিই করছি না সবাই? এজন্যই এ প্রশ্নটার সুরাহা হওয়া দরকার সবার আগে। মুমিন বান্দা বা বান্দির মুত্তাকি হয়ে উঠার জন্য নামায-রোজা ইবাদত-বন্দেগী। নিজেকে বান্দা বলে পরিচয় দেয় কিন্তু মালিকের মতো চলতে চায় না- এমন মানুষকে এ বিধানগুলি ফায়দা দিবে সামান্যই। তাই অবশ্যই নামায আদায় করবো, রোজা ছাড়বো না একটিও। সেই সাথে নিজের পরিচয়টা ঠিক করে নিব- এটাই হোক এই রমজানের মৌলিক সিদ্ধান্ত।

আর দ্বিতীয় প্রসঙ্গ হল দুনিয়ার জীবনের তাৎপর্য। দুনিয়ার জীবন একটা পরীক্ষা ক্ষেত্রঃ ‘পৃথিবীর উপর যা কিছু আছে আমি সেগুলিকে তার শোভা করেছি, মানুষকে পরীক্ষা করে দেখবার জন্য, তাদের মধ্যে কে ভাল কাজ করে।’ (সুরা কাহাফ ১৮: ৭)

দুনিয়া যার চূড়ান্ত লক্ষ্য, তাকওয়া তার জীবনের জন্য এক বাধা। যেন-তেন প্রকারে দুনিয়ার ভোগ-বিলাস হাসিলকে যে জীবনের মূল মাকসাদ বানিয়ে নিয়েছে সংযমের শিক্ষা তার জন্য অপ্রাসঙ্গিক। তাকওয়া দরকার তার, যে আল্লাহর সীমাগুলি পরোয়া করে চলতে চাচ্ছে। সেজন্য তাকে সুবহে-সাদিক ও সূর্যাস্তের সীমা মেনে চলার তালিম দেয়া হচ্ছে। প্রশিক্ষণ হচ্ছে- God consciousness তথা আল্লাহকে হাজির-নাজির জেনে জীবন যাপনের ভুলক্রমে বা গোপনেও যেন রোজার নিষিদ্ধ কোনো কাজ করে না ফেল। দুনিয়া পূজারীর ধীরে-স্থিরে কুরআন বুঝে বুঝে পড়ার দরকার কি? তার দরকার যত দ্রুত খতম করা যায়। ২৭ দিন সে বড় লম্বা সময়। রাতগুলিই তো নষ্ট হল। ১০ বা ৭ দিন হলে ভাল, দেখুন না এমনটাই কি মনে করছি না আমরা।

তাই কথা হল ঈমানের এই ত্রুটিপূর্ণ বুঝগুলি আমাদের ঠিক করে নিতে হবে। যেমন নিয়েছিলেন সাহাবীরা। বুঝে নেই ইসলাম ছাড়া দুনিয়া আখিরাতে কল্যাণের পথ নেই, মুক্তির পথ নেই। পরীক্ষা-নিরীক্ষা তো অনেক হল। এখনো কি দ্বিধা-সন্দেহে ভুগবেন? আর ঈমানের পরিস্কার বুঝ ছাড়া ইসলাম হয় না। ইসলামের পথে চলা যায় না। সাহাবায়ে কেরাম (রা.) শুরুতেই নিজেদের বুঝ ঠিক করে নিয়েছিলেন। ফলে আল্লাহ তাদের জন্য বড় বড় কাজ করাকে সহজ করে দিয়েছিলেন। তাদের কবুল করে নিয়েছেন। দুনিয়ায় থাকতেই জান্নাতের সু-সংবাদ দিয়েছেন। আমরাও সেপথে আগাই। আল্লাহ পাক আমাদের জন্যও তাঁর দ্বীনকে সহজ করে দিবেন। জান্নাতের পথ সহজ করে দিবেন। আল্লাহ তা’লা আমার-আপনার সবাইকে এ কল্যাণ দান করুন। আমীন।

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর