আপনি পড়ছেন

মহান আল্লাহ্ তা’লা বলেন, ‘স্মরণ কর যখন তোমার রব ফিরিস্তাদের বললেন, আমি পৃথিবীতে খলিফা তথা প্রতিনিধি সৃষ্টি করছি।’ (সুরা বাকারা ২:৩০)। আল-কুরআনের শুরুতেই সুরা বাকারার ১-৪ রুকুতে মানবজাতির পরিচয় ও দুনিয়ার জীবনে তার দায়িত্ব-কর্তব্য বর্ণিত হয়েছে। সে দায়িত্ব-কর্তব্য পালনের জন্য তার অত্যাবশ্যক যোগ্যতাসমূহ বিস্তারিত বলে দেওয়া হয়েছে।

the holy quranপবিত্র আল কুরআন, ফাইল ছবি

আল-কুরআন আল্লাহ্পাক স্বয়ং সাজিয়ে দিয়েছেন। নাযিলের ধারাবাহিকতায় পঞ্চম-মক্কী সুরা, সুরা ফাতিহাকে প্রথম সুরা হিসেবে স্থান দেওয়া হয়েছে। তারপর নিয়ে আসা হয়েছে ৮৭ নম্বরে নাযিল হওয়া মাদানী সুরা বাকারাকে। সুরা ফাতিহা ও সুরা বাকারার বক্তব্য বিষয়ের মধ্যে অপূর্ব ধারাবাহিকতা দেখি আমরা। ফাতিহায় হেদায়াতের জন্য দোয়া করা হয়েছে। সেখানে মানবজাতিকে হেদায়াতের সঙ্গে সম্পর্কের ভিত্তিতে ৩ ভাগে ভাগ করা হয়েছে-

১। আন আমতা আলাইহিম - নেয়ামত প্রাপ্তগণ

২। দো-ললীন - বিভ্রান্ত জাতি গোষ্ঠী

৩। মাগদুবে আলাইহিম - গজবপ্রাপ্ত জাতিসমূহ

সুরা বাকারার শুরুতেই পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, মানুষ যে হেদায়াত চাচ্ছে সেই হেদায়াতের জন্য তাকে আল-কুরআনের কাছে আসতে হবে। অতঃপর ফাতিহায় উল্লিখিত ৩ শ্রেণির মানুষের পরিচয় ও পরিণাম বর্ণনা করা হয়েছে বাকারার প্রথম ২ রুকুতে। ৩ ও ৪ রুকুতে মানবজাতির দায়িত্ব-কর্তব্য এবং সে সংশ্লিষ্ট বিষয় ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

সুরা বাকারার ৩য় রুকুর শুরুতেই ২১ আয়াতে মানুষের মূল পরিচয় বর্ণিত হয়েছে যে, তারা আল্লাহর বান্দা। মানবজাতিকে আল্লাহর বন্দেগী কবুল করে নেওয়ার জন্য আহবান জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে, এই বন্দেগীর মাধ্যমেই মানুষ মনুষ্যত্বের কাঙ্খিত বৈশিষ্ট্য তাকওয়া অর্জন করতে সক্ষম হবে। বিষয়টি আমরা গতকাল সংক্ষেপে উপস্থাপন করেছি।

মানুষ আল্লাহর খলিফা

সুরা বাকারার ৩০ আয়াতে মানুষের বৈশিষ্ট্যমন্ডিত পরিচয় বর্ণিত হয়েছে। সে আল্লাহর খলিফা। বস্তুত খলিফা হিসেবেই তার সৃষ্টি। জগতের সব সৃষ্টিরই মূল পরিচয় যে, তারা আল্লাহর বান্দা। কেবল মানুষকেই তিনি খলিফা করে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত ও মর্যাদাবান করেছেন।

খলিফার তাৎপর্য

খলিফা শব্দের সরল অর্থ প্রতিনিধি, সে মালিক নয়। মালিকের পক্ষ থেকে নির্ধারিত দায়িত্ব পালনের জন্য তাকে নিযুক্ত করা হয়েছে। আল্লাহর বান্দা হিসেবে তার কাজ হল আল্লাহর পাকের অনুগত হয়ে জীবন যাপন করা। আর আল্লাহ্ সুবাহানাহু ওয়া তালার প্রতিনিধি হিসেবে তার দায়িত্ব আল্লাহর আনুগত্যের ভিত্তিতে এই বিশ্ব জগতের পরিচালন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। এই লক্ষ্যে সাধ্যমতো প্রচেষ্টা চালানো। নিজে তো আল্লাহর বন্দেগীর ভিত্তিতে চলবেই, সমস্ত মানবকুল ও সৃষ্টিজগত যেন আল্লাহর অনুগত হয়ে চলতে পারে সেই লক্ষ্যে সে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবে।

প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব পালনে অপরিহার্য যোগ্যতাসমূহ

আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলো তাকে অর্জন করতে হবে-

প্রথমত, তাকে আল্লাহর বন্দেগী কবুল করতে হবে। মানুষের মূল পরিচয় সে আল্লাহর দাস, গোলাম। এজন্য শুরুতে (৩য় রুকুতে) আল্লাহর বন্দেগী কবুলের নির্দেশ এসেছে। এ বিষয়টা অনেকে উপেক্ষা করে যান। দ্বীনের পথে যারা কাজ করেন, তারা অনেকেই এ বিষয়ে গাফিল। ফলে দ্বীনের কাজ করতে গিয়ে নানা নামে দ্বীন বহির্ভূত পদক্ষেপ কার্যক্রম নিতে দেখা যায়।

দ্বিতীয়ত, তাকে জ্ঞানগত শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে হবে। এই জ্ঞান দ্বীন সম্পর্কে; এই জ্ঞান দুনিয়ার যাবতীয় কাজ পরিচালনা সম্পর্কে। ৪র্থ রুকুতে উল্লিখিত আদম (আ.)-কে যাবতীয় নাম শিক্ষা দেওয়ার মধ্যে এই নির্দেশনা রয়েছে। আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য জ্ঞানের ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকলে চলবে না। বর্তমান উম্মাহর অধঃপতনের অন্যতম প্রধান কারণ এটি। মুসলিম উম্মাহ বিশ্বকে নেতৃত্ব দিয়েছে জ্ঞানগত শ্রেষ্ঠত্বের ভিত্তিতে। বর্তমান বিশ্বের তাবৎ বৈজ্ঞানিক উৎকর্ষের মূলে রয়েছে মুসলিম উম্মাহর পূর্ব পুরুষদের রেখে যাওয়া জ্ঞান-বিজ্ঞান।

যেদিন মুসলমানরা বিশ্ব পরিচালনার দায়িত্বকে বোঝা মনে করলো, আরাম-আয়েশে ডুবে থাকার মধ্যে জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজে নিল এবং ফলশ্রুতিতে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা বর্জন করলো, সেদিন থেকেই তাদের অধঃপতন শুরু হলো। মনে রাখতে হবে, জ্ঞানগত শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের পরই ফিরিস্তাকুলকে নির্দেশ দেওয়া হল আদমকে সিজদা করতে (বাকারা ৩৩-৩৪)। মুসলিম উম্মাহ যতদিন শরীয়তের খুঁটি-নাটি চর্চাকেই জ্ঞান চর্চা বলে বিবেচনা করবে ততদিন তাদের উন্নতির আশা করা যায় না।

তৃতীয়ত, চারিত্রিক ও নৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব। আদম (আ.) ও ইবলিস উভয়কেই একটি করে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। উভয়েই তা প্রতিপালনে ব্যর্থ হয়। ইবলিস অহংকার করে, আল্লাহর নির্দেশ বুঝে-শুনে প্রত্যাখ্যান করে। আর আদম ব্যর্থ হন ইবলিসের ওয়াসওয়াসা, উচ্চাকাঙ্খা ও গাফিললিতে পড়ে। ইবলিস তার অহংকারের কারণে বিতাড়িত হয়। পক্ষান্তরে আদম (আ.) তার অনুগত মানসিকতার কারণে আল্লাহর সাহায্য ও ক্ষমা লাভ করেন (বাকারা ৩৪-৩৭)। আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য চারিত্রিক উৎকর্ষ ও উন্নত নৈতিক চরিত্র অপরিহার্য। অহংকার, হিংসা, আত্মম্ভরিতা, মিথ্যাচার, সৃষ্টিকর্তার প্রতি উদ্ধত আচরণ ইবলিসের পতন ডেকে আনে। তার চিন্তাধারা ও আচরণকে প্রত্যাখ্যান করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে (বাকারা: ২০৮)।

বিপরীত দিকে আদম (আ.) এর সরলতা, অনুতপ্ত মানসিকতা, নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ, অন্যায়কে কোনোভাবেই জাস্টিফাই করার চেষ্টা না করাকে আল্লাহ্ তা’লা পছন্দ করেছেন। ইসলামকে যারা সঠিকভাবে জীবনে বাস্তবায়িত করতে চায়, তাদের নৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে হবে।

চতুর্থত, ওহীর সাথে সম্পর্ক। আল্লাহ তা’লা মানবসত্ত্বায় বস্তুজ্ঞান অর্জনের মৌলিক যোগ্যতা দান করেছেন: তবে দুনিয়ার জীবনে তার দায়িত্ব পালনের হেদায়েত তিনি নিজের কাছেই রেখেছেন। বলেছেন,

‘অতঃপর যখন আমার পক্ষ থেকে হেদায়াত আসবে তখন যারা আমার হেদায়াত অনুসরণ করবে, তাদের কোনো ভয় নাই এবং তারা দুঃখিত হবে না।’ (বাকারা: ৩৮)

দুনিয়ায় প্রেরণের সময় চরম দুশ্চিন্তাগ্রস্ত আমাদের আদি পিতা ও মাতা তথা আদম-হাওয়াকে আল্লাহ্ তা’লা এই নির্দেশ দিয়েছেন। জানিয়ে দিয়েছেন, তার হেদায়াতের ‘ইত্তেবা’ তথা অনুসরণ করলে দুনিয়া-আখিরাতে ভয় ও দুশ্চিন্তা থাকবে না। হেদায়াত অনুসরণ করতে বলা হয়েছে, কেবল না বুঝে তেলাওয়াত করতে নয়। দুর্ভাগ্যজনক, মুসলমান আজ কুরআন জানা-বুঝা বাদ দিয়ে শুধু সুর করে তিলাওয়াত, তিলায়াতের প্রতিযোগিতা, বুঝহীন হিফয ইত্যাদি কর্মকান্ডে লিপ্ত হয়েছে। যার কোনো শিক্ষা কুরআন-হাদীসে পাওয়া যায় না।

রমজান আমাদের সামনে এই বৈশিষ্ট্যগুলি অর্জনের সুবর্ণ সুযোগ নিয়ে এসেছে। আত্মসংশোধন, নৈতিক উৎকর্ষ, চারিত্রিক ত্রুটিসমূহ দূর করা ও কুরআনের সাথে গভীর সম্পর্ক গড়ার মওসুম রমজান। মহান আল্লাহ্ তা’লা আমাদের সকলকে দুনিয়ার জীবনে আমাদের অবস্থান ও পরিচয় উপলব্ধি করার সুযোগ দিন। সাধ্যমতো সেগুলো আঞ্জাম দেওয়ার যোগ্যতা ও তাওফীক দিন।

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর