আপনি পড়ছেন

রসূল (স.) বলেন, ‘সিয়াম ও কুরআন বান্দার জন্য কিয়ামতের দিন সুপারিশ করবে। সিয়াম বলবে, ‘হে আমার রব, আমি তাকে দিনের বেলায় পানাহার ও কামাচার থেকে বিরত রেখেছিলাম। সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন।’ আর কুরআন বলবে, ‘আমি তাকে রাতের বেলা নিদ্রা থেকে বিরত রেখেছিলাম, সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন।’ নবীজি (সা.) বলেন, ‘অতঃপর তাদের উভয়ের সুপারিশ গ্রহণ করা হবে।’ (মুসনাদে আহমাদ-৬৬২৬)।

the holy quaran study

রমজান মাসের দুই প্রধান নেয়ামত হল সিয়াম ও কুরআন। মানুষের জীবনকে সুন্দর করার জন্য প্রয়োজন সুন্দর চরিত্র ও সঠিক নিয়ম বিধান। আল্লাহ্ তা’লা সিয়ামের বিধান দিয়েছেন মানব চরিত্রকে সুন্দর করার জন্য। আর কুরআন দান করেছেন তার জীবনের সর্বক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গ, সঠিক ও ভারসাম্যপূর্ণ বিধানের জন্য। আজকের নিবন্ধে এই দুটি বিষয়ে আমরা দৃষ্টিপাত করবো।

মানব আত্মার বিভিন্ন দিক

দেহ ও আত্মার সমন্বয়ে মানুষ। বস্তুতঃ মানুষের আত্মাই তার মূল সত্ত্বা। দেহ এর বাহন। আত্মাবিহীন দেহ তাই ‘অমুকের লাশ’। সেই ব্যক্তি আর নেই। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বর্তমান তথাকথিত সেকুলার সমাজে দেহ ও এর বৈষয়িক চাহিদা চর্চা ও পরিচর্যা করার নানা উদ্যোগ থাকলেও আত্মার চাহিদা পরিপূর্ণ উপেক্ষিত। আত্মার স্বীকৃতি দিলে যে ধর্মের কাছে ফিরে যেতে হয়। ধর্মের কাছে ফিরে গেলে যে নয়-ছয়ের অর্থনীতি যে আর চলবে না। এটা কোনো নতুন বা তথাকথিত আধুনিক চিন্তা নয়। সেকুলারিজমও কোনো আধুনিক মতবাদ নয়—

‘তারা বললো, হে শুয়াইব! তোমার সলাত কি তোমাকে নির্দেশ দেয় আমাদের পিতৃপুরুষ যার ইবাদাত করতো (অর্থাৎ ধর্মীয় নীতি-আদর্শ মানতো) তা বর্জন করতে হবে অথবা আমাদের ধন-সম্পদ সম্পর্কে যা করি তা-ও’ (সুরা হুদ ১১ : ৮৭)

শুয়াইব (আ.)-এর জাতি আনুমানিক খৃস্টপূর্ব ১৫ শতকের একটা শক্তিশালী জাতি ছিল। তাদের মূল পেশা ছিল ব্যবসা। বর্তমানকালের পরাশক্তিগুলির মতো অন্য জাতিগুলো লুট-তরাজ এবং অন্যায় ব্যবসায়িক সুবিধা আদায় তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মূল ভিত্তি ছিল। ব্যবসায় তারা নেয়ার সময় শক্তি খাটিয়ে বেশি নিত এবং দেয়ার সময় কম দিত। তিন সাড়ে তিন হাজার বছর আগের নোংরা শোষণের নীতি অনুসরণ করে নিজেদের আধুনিক ভাবতে লজ্জা হওয়া উচিত আমাদের।

যাহোক যেকথা বলছিলাম আমরা, আত্মার চাহিদা আজ উপেক্ষিত। দেহসর্বস্ব চিন্তাধারা, মতবাদ ও শিক্ষাব্যবস্থার কল্যাণে অনৈতিকতা বর্তমান কালের সবচেয়ে বড় মহামারি হিসেবে দেখা দিয়েছে। আত্মা সুস্থ ও সুষ্ঠু থাকলে মানব চরিত্র সুন্দর হবে। আত্মার সুষ্ঠুতার জন্যই ঈমান ও ইবাদাত অপরিহার্য। ঈমান মানুষকে দেয় সঠিক মূল্যবোধ ও জীবনবোধের বুঝ ও দিকনির্দেশনা। আর ইবাদাত মানুষকে দেয় সেই বোধ অনুযায়ী চলার বাস্তব প্রশিক্ষণ।

মানব আত্মা বিকাশের অন্তরায়

মানুষের আত্মাকে সুন্দর ও পবিত্র করার পথে বাধা দুটি—

(১) শাহাওয়াত তথা কামনা বাসনা: মানব চরিত্রের নেতিবাচক বৈশিষ্ট্যগুলি যেমন- লোভ-লালসা, সম্পদ ও ক্ষমতা অর্জন জীবনের মুখ্য উদ্দেশ্যে পরিণত হওয়া।

(২) শুব্বুহাত তথা দ্বিধা-সন্দেহ: যা জন্ম নেয় জীবন সম্পর্কে অপূর্ণ বা ভুল ধারা হতে; ইসলাম সম্পর্কে ত্রুটিপূর্ণ বুঝ থেকে। ফলে ঈমানে পূর্ণতা ও দৃঢ়তা আসে না, মানুষ গুনাহে লিপ্ত হয়। পরিণামে তার ঈমান পর্যন্ত নষ্ট হয়ে যেতে পারে।

শাহাওয়াত তথা কামনাবাসনার মোকাবেলায় সিয়াম

আত্মাকে কলুষিত করে যেসব জিনিষ তার মধ্যে প্রধান হল:

১. অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকর কথাবার্তা;

২. অবাধ, অসংযত ও অনিয়ান্ত্রিত যৌনতা ও যেসব কাজ সেদিকে মানুষকে ঠেলে দেয়;

৩. অতি ভোজন;

৪. অসৎ সংসর্গ তথা সর্ম্পক, বন্ধুত্ব, সংঘ ইত্যাদি

৫. মাত্রাতিরিক্ত আরাম-আয়েশ

সিয়াম বা রোজা এ সমুদয় ক্ষতিকর বিষয় থেকে বান্দাকে রক্ষার এক মহা ব্যবস্থা। এ জন্য হাদীসে রসূল (স.)-এ সিয়ামকে ঢাল হিসেবে বলা হয়েছে।

সিয়াম বৈধ খানা-পিনা, যৌন সম্পর্কে আরাম-আয়েশের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। সিয়াম অবস্থায় মেজাজের ভারসাম্য রক্ষা, অসংযত কথা-বার্তা ও আচরণকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। দীর্ঘ একমাস কেউ সচেতনভাবে দিনের বেলা বৈধ পানাহার ও স্ত্রী সম্ভোগ হতে বিরত থাকে। রাতে অতিরিক্ত ইবাদাত-বন্দেগীতে লিপ্ত হয়। গায়ে পড়ে ঝগড়া-ফাসাদে জড়ায় না। কেউ জড়াতে আসলে সসম্মানে তা বর্জন করে। এমনিভাবে প্রতিবছর নিয়মিত একমাসের কঠোর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সিয়াম আত্মাকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করে।

বিশ্বাসের ভিত্তি ও দৃঢ়তার উৎস কুরআন

আত্মার দুর্বলতার দ্বিতীয় দিক হল সন্দেহ, নিশ্চিত জ্ঞানের অভাব। মানবাত্মার চিরন্তন প্রশ্ন-

- আমি কে? কোথা থেকে এসেছি?

- কেন এসেছি? এ জীবনের আসল উদ্দেশ্য কি?

- আমার জীবনের গন্তব্য কোন দিকে? কোথায় নিয়ে যাচ্ছে আমায় এ বহমান সময়? এ জীবনের শেষ প্রান্তে কি?

প্রশ্নগুলো চিরন্তন। সব যুগে, সব দেশে ও জাতিতে দার্শনিক ও ধর্মবেত্তারা এর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু দেখুন, কোনো স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেননি তারা। তাদের যাবতীয় চিন্তা অনুমান নির্ভর। দ্বৈততায় ভরপুর। বাস্তবতায় তা অনুপস্থিত, পালিত নয়, পালনযোগ্যও নয়। যতটুকু অনুসৃত হয় তা তার অনুসারী ও সমসাময়িক মানুষ ও বিশ্ব প্রকৃতির জন্য চরম ক্ষতিকর।

মানব আত্মার চিরন্তন এ সব প্রশ্নের জবাব হিসেবে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্ তা’লা যুগে যুগে হেদায়াত পাঠিয়েছেন। সর্বশেষ হেদায়াত আল কুরআন সকল মানুষের পূর্ণাঙ্গ ও ভারসাম্যপূর্ণ জীবনবিধান।

রমজান কুরআন নাযিলের মাস। কুরআন বেশি বেশি চর্চার মাস। রসূল (স.) সাহাবায়ে কেরাম (রা.) ও সব জামানার মুমিন-মুত্তাকীরা রমজানকে কুরআনের মাস হিসেবে গ্রহণ করেছেন। রসূলুল্লাহ্ (স.)-এর অনুকরণে রাত্রি জেগে কুরআন অধ্যয়ন করেছেন নামাযে ও নামাযের বাইরে। দুঃখজনক হলো বর্তমানে কুরআন চর্চার নামে চলছে যেন-তেন খতমের অসুস্থ প্রতিযোগিতা। কিছু লোক একে তাদের রিজিকের ধান্দায় পরিণত করেছে।

আল্লাহ্ কুরআন নাযিল করেছেন হেদায়েতের কিতাব হিসেবে। এটি মন্ত্রের কিতাব নয়। মন্ত্রের কিতাব হলে এতে রসূলুল্লাহ্ (স.)-কে দেওয়া সংশোধনী, সাহাবায়ে কেরামের ভুলের শাসন ও সংশোধন আর পূর্বেকার জাতিগুলোর বর্ণনা এতে কি করছে? চিন্তা করেছি কি আমরা কখনো? যারা খালি না বুঝে কুরআন পাঠ করেন, হিফজ করেন, কেরআত প্রতিযোগিতা করে বাহবা কুড়ান এবং ধার্মিক মানুষদের একাজেই ব্যস্ত রাখতে চান তারা কি একটু চিন্তা করবেন না?

আমরা এরকম বিভিন্ন রকম বিভ্রান্ত ও ধান্দাবাজদের কথাই বা চোখ বুঝে মেনে নিচ্ছি কেন? কুরআন বলছে, এতে রয়েছে সব সমস্যার সমাধান (সূরা ফুরকান ২৫: ৩৩)। রসুল বললেন, এই কুরআন তোমার পক্ষে অথবা বিপক্ষে দলিল (মুসলিম শরীফ)। জীবন সমস্যার সমাধান ও যাবতীয় কাজের দলিল না বুঝে পড়লে তা থেকে উপকার পাওয়া যাবে কিভাবে? এজন্যই রসূল (স.) কিয়ামতের দিন অভিযোগ দায়ের করবেন-

‘হে আমার রব! আমার এই জাতি এই কুরআনকে বর্জন করেছে।’ (সূরা ফুরকান ২৫: ৩০)

কুরআন আমাদের আত্মার সব প্রশ্নের জবাব, ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ ও পথনির্দেশ। কুরআনের আলোকে নিজেকে চিনি, চিনি বিশ্ব জাহানের রব আল্লাহ্ তা’লাকে, তাঁর রসূলকে, তাঁর বিশ্বব্যবস্থাকে। জানি আমাদের দায়িত্ব-কর্তব্য এবং কিভাবে তা আঞ্জাম দিতে হবে। কুরআন থেকে নিশ্চিতভাবে জেনে নেই এ জীবনের উদ্দেশ্য এর পরিণাম, সফলতা ও ব্যর্থতার প্রকৃত শিক্ষা।

কুরআন আমার আপনার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন। মহান আল্লাহ্ তা’লা তাঁর অসীম দয়ায় তা আমাদের দান করেছেন। কেউ ঘাবড়াবেন না। আস্তে আস্তে কুরআন বুঝে পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন। একটা তরজমা সংগ্রহ করে নিন। ভাল হয় তাফসীরসহ পড়তে পারলে। যতটুকু পারেন ততটুকুই পড়ুন। এই রমজান থেকে শুরু করুন। এখনো না করলে আজ থেকেই শুরু করুন। নেটে কত কুরআনী অ্যাপস আছে। যেকোনো একটা ডাউনলোড করে ধারাবাহিকভাবে পাঠ করা শুরু করুন। অগ্রসররা বেশি বেশি পাঠ করুন। সহায়ক বইগুলি বিশেষত, নবী (স.)-এর হাদীস ও সিরাত গ্রন্থগুলিও পাঠে অন্তর্ভুক্ত করুন। অগ্রসররা অন্যদের সহায়তা করুন।

আমরা সুন্দর জাতি চাই। দুনিয়ার জীবনে চাই সবাই মিলে শান্তিতে থাকতে। আর আখিরাতে সবাই জান্নাতী হতে। আত্মসংশোধন ও কল্যাণময় জাতি গঠনে এই রমজানে সিয়ামকে সুষ্ঠুভাবে আদায় করি। কুরআনকে শক্তভাবে আকড়ে ধরি। নবী (স.)-এর সুন্নাহ্ অনুসরণে কুরআনী ব্যক্তি, পরিবার ও জাতি গঠনে অগ্রসর হই। মহান আল্লাহ্ তা’লা সবার নেক প্রচেষ্টা কবুল করুন ও তাতে বারাকা দান করুন। আমীন।

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর