আপনি পড়ছেন

আল্লাহ্ তা’লা বলেন, ‘সেই সফলকাম হবে যে নিজেকে অর্থাৎ নিজের আত্মাকে পবিত্র করেছে। আর সে-ই ব্যর্থ হবে যে তার আত্মাকে কলুষাচ্ছন্ন করেছে।’ (সুরা শামস ৯১:১০)।

soul and the islamআত্মা যেন একটা ঘড়ির মতো সময় ফুরালে আর চলবে না, প্রতীকী ছবি

একজন স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ নানাভাবে তার শরীরের যত্ন নেন। কেউ জিম করেন, কেউ বা সকাল-বিকাল হাঁটেন, ফ্রি-হ্যান্ড ব্যায়াম করেন। খাওয়া-দাওয়া, ঘুম, পরিশ্রম প্রভৃতি বিষয়েও তারা নিয়ম মেনে চলেন। ফলে আল্লাহর রহমতে তাদের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, রোগ-বালাই কম হয়, দুশ্চিন্তা-টেনশন হ্রাস পায়। এছাড়া আরো বহুবিধ উপকারিতা তারা ভোগ করেন।

এই করোনাকালেও আমরা দেখেছি, খেটে খাওয়া মানুষ যারা দিবা-রাত্র রোদ-বৃষ্টিতে কাজ করেন তারা করোনা আক্রান্ত হয়েছেন কম। হলেও তার তীব্রতা ছিল না। আর আলহামদুলিল্লাহ, তারা দ্রুতই আরোগ্য লাভ করেছেন। বরং করোনায় সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছেন, কষ্ট পেয়েছেন এবং মৃত্যুবরণ করেছেন সমাজের উঁচু তবকার মানুষেরা যারা পরিশ্রম করেন কম, খান বেশি এবং আয়েশে বিলাসী জীবনযাপন করেন।

দেহকে সুস্থ ও কর্মক্ষম রাখার জন্য যেমন নানাভাবে তার পরিচর্যা প্রয়োজন, প্রয়োজন নিয়ম মেনে চলা, আত্মার সুস্থতার জন্যও তেমনি এর পরিচর্যা প্রয়োজন, প্রয়োজন আত্মার মালিক মহান আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’লার বেঁধে দেওয়া নিয়ম-কানুন অনুসরণ করা।

আত্মার নানারূপ

সুস্থ ও অসুস্থ দেহ যেমন এক নয়, তেমনি সুস্থ ও অসুস্থ আত্মাগুলিও এক নয়। একটা সুস্থ আত্মার অধিকারী মানুষের মধ্যে আমরা বিভিন্ন উন্নত নৈতিক বৈশিষ্ট্য দেখতে পাই। যেমন:

১. তাকওয়া বা পরহেজগারী যাকে ইংরেজিতে বলে God consciousness

২. দয়া-মায়া-সহানুভূতি

৩. সততা ও সত্যপ্রিয়তা

৪. বিশ্বস্ততা ও আমানতদারী

৫. আদল বা ন্যায়বিচার

৬. সংযম

৭. নমনীয়তা

৮. বিনয়

৯. অল্পে তুষ্টি

১০. মেজাজের ভারসাম্যতা

১১. দায়িত্বশীলতা

১২. লজ্জাশীলতা ও পবিত্র মনোভাব ইত্যাদি।

আর কারো মধ্যে এর বিপরীত বৈশিষ্ট্যগুলির প্রকাশ দেখলে আমরা বুঝি তার আত্মা কলুষিত হয়ে গেছে, তা রোগাক্রান্ত, অসুস্থ। ইসলামের দৃষ্টিতে রোগাক্রান্ত আত্মার মধ্যে নিম্নোক্ত ধরনের বৈশিষ্ট্য দেখা যায়:

১. শিরকী চিন্তা-চেতনা, অন্ততঃপক্ষে তাওহীদের প্রতি অনীহা ও বিতৃষ্ণা।

২. রসূল (সা.)-এর সুন্নাহর প্রতি অনীহা এবং বিদআতের প্রতি আকর্ষণ।

৩. আল্লাহর ইবাদাতের পরিবর্তে পার্থিব ভোগ-বিলাস ও আনন্দ-ফূর্তির প্রতি ঝোঁক।

৪. মিথ্যাচার।

৫. কপটতা বা মুনাফেকী।

৬. অশ্লীলতা ও এর বাহনগুলির প্রতি আকর্ষণ।

৭. আমানতের খিয়ানত।

৮. হারাম উপার্জনের প্রতি আকর্ষণ।

৯. অহংকার।

১০. হিংসা ও পরশ্রিকাতরতা।

১১. গীবত ও তোহমত।

১২. অসংযমী ও উদ্ধত আচরণ।

১৩. নীতি-নায্যতাকে প্রত্যাখ্যান ইত্যাদি।

দুঃখজনকভাবে, বর্তমান সময় আমরা প্রথম তালিকায় উল্লিখিত গুণগুলির চেয়ে দ্বিতীয় তালিকায় থাকা দোষগুলির সয়লাব দেখতে পাই। সমাজের সর্বোচ্চ স্তর থেকে শুরু করে সর্বনিম্ন স্তর পর্যন্ত মানুষের মধ্যে অসুস্থ মানসিকতার ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। চলমান বিভিন্ন ঘটনাবলী থেকে আমরা এর প্রমাণ পাই। সমস্যা হলো যারা এসব দোষের সমালোচনা করি, তারাও নিজ নিজ জীবনে কোনো না কোনোভাবে এসব ক্ষতিকর আত্মবিধ্বংসী কাজের সাথে জড়িত হয়ে পড়ছি।

নৈতিক অধঃপতনের নেপথ্যে

একটা ট্র্যাডিশনাল মুসলিম সমাজে এই সর্বব্যাপী নৈতিক অধঃপতনের কারণ কেউ হয়তো বলবেন ভোগবাদী চিন্তার প্রসার, আবার কেউবা ক্ষমতাসীন মহলকে দোষী করবেন। উভয়টিই সত্যি। তবে তা ছাপিয়ে সবেচেয়ে বড় কারণটা হয়তো ইসলাম সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতা ও উদাসীনতা।

মূলত: মুসলিম জাতির উৎপত্তি ও উত্থান হয়েছিল ইসলামের ভিত্তিতে। ইসলাম ছেড়ে দিয়ে যখন মুসলমানরা কুরআন-সুন্নাহ্ বিবর্জিত মতবাদ অনুসরণ করা শুরু করলো তখন থেকেই তাদের অধঃপতনের সূত্রপাত। আমাদের মূল পরিচয় আমরা মুসলিম। ইসলাম আমাদের জীবনব্যবস্থা। আল-কুরআন আমাদের জন্য আল্লাহর দেওয়া জীবন বিধান। রসূল (সা.) আল-কুরআনের বাস্তব রূপ। কুরআন-সুন্নাহর বাইরে কোনো ইসলাম নেই। কুরআন-সুন্নাহ্ বর্জন করে মুসলিম থাকা যায় না। জাতি হিসেবে যদি আমরা পুনরায় দাঁড়াতে চাই, বর্তমান অধঃপতিত অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে চাই তাহলে আমাদের ইসলামেই ফিরে আসতে হবে। ইসলাম নিয়েই আগাতে হবে।

ব্যক্তি ও জাতির সংশোধন ও পরিশুদ্ধির জন্য ইসলামের ব্যবস্থা

ইসলামই একমাত্র জীবনব্যবস্থা যা নৈতিকতার মানদন্ড ঠিক করে দেওয়ার পাশাপাশি নৈতিক পরিশুদ্ধির জন্য নিয়মতান্ত্রিক ব্যবস্থাপত্র দিয়েছে। মানবাত্মার পরিচর্যার জন্য নিয়মিত অনুসরণীয় কার্যক্রম নির্ধারণ করে দিয়েছে।
বস্তুত: পবিত্র ও পরিশুদ্ধ আত্মাই মানুষের মধ্যে কল্যাণময় চিন্তা-ভাবনা, কর্ম ও চরিত্র জন্ম দিতে পারে। পবিত্র ও নেক চরিত্রের মানুষ ছাড়া একটা কল্যাণময় সমাজ চিন্তা করা যায় না। পাশ্চাত্য সমাজ এবং বৃহত্তর অর্থে গোটা বিশ্ব আজ এর বাস্তব প্রমাণ। চরম বৈষয়িক উন্নতি সত্ত্বেও পাশ্চাত্য সমাজ আজ ভাঙন ও ধ্বংসের মুখোমুখি। সেখানে পরিবার ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, চারিত্রিক ও নৈতিক বিকৃতি চরম আকার ধারণ করেছে। অশ্লীলতার সয়লাব বয়ে যাচ্ছে সেখানে সর্বত্র।

আত্মার পরিচর্যা ও সংশোধনের জন্য ইসলামের বিধি ব্যবস্থার অন্যতম হল আমল বিল আরকান। সেগুলি হল—

(১) কালেমার ঘোষণা: তথা জীবনযাপনের পলিসি ডিক্লারেশন— ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ’। আমি আল্লাহ্ ছাড়া আর কাউকে আমার মালিক বলে মানি না, আমি একমাত্র তাঁরই দাসত্ব বা ইবাদত করি; তাঁর হুকুম মতো জীবনযাপন করি। আর তাঁর হুকুম মানার জন্য আদর্শ হিসেবে আমি শুধু মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ (সা.)-কেই মানি। আর কারো আদর্শ আমার নিকট গ্রহণযোগ্য নয়।

কালেমাকে বুঝে-শুনে যে এই ঘোষণা প্রদান করে এবং বাস্তবে তা মেনে চলার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করে সেই মু’মিন। একজন মু’মিন তার অবস্থা পরিবেশের কারণে ইসলামের অনেক বিধান হয়তো মেনে চলতে নাও পারে। কিন্তু বিশ্বাসের এই জায়গা থেকে সে কখনো সরে যায় না। মক্কায় ইসলামী বিধানসমূহ মানার কোনো অনুকূল পরিবেশ ছিল না। কিন্তু রসূল (সা.) ও সাহাবায়ে কেরাম (রা.)-এর বিশ্বাস ও চেতনার ভিত্তি ছিল এই কালেমা। এ ব্যাপারে কোন আপোষ ছিল না।

(২) সালাত কায়েম: ৫ ওয়াক্ত নামাজে আল্লাহর সামনে আনুগত্যের মস্তক নত করে দেওয়া। আনুগত্য ও দাসত্বের বলিষ্ঠ ঘোষণা— ‘ইয়্যাকানা’বুদু ওয়া ইয়্যাকানাস্তাঈ’ন’ অর্থাৎ আমরা কেবল আপনারই ইবাদাত বা দাসত্ব করি এবং আপনার কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করি।’ (সূরা ফাতিহা)

‘সচেতনভাবে সুন্নাহর অনুসরণে বুঝে বুঝে সালাত আদায় বান্দাকে অশ্লীল ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে।’ (সূরা আনকাবুত ২৯: ৪৫)।

(৩) যাকাত আদায়: সম্পদের ওপর আল্লাহর মালিকানার স্বীকৃতি এবং সমাজের দায়িত্বশীল সদস্য হিসেবে ভূমিকা পালন। (বাকারা: ২৬৫, হাশর: ৭)

(৪) সিয়াম পালন: হালাল খাদ্য, যৌনাচার ও আরাম-আয়েশের উপর আল্লাহর আরোপিত বিধি নিষেধ অনুসরণ করে হারাম বর্জনের যোগ্যতা অর্জন। যে কেউ রোজা রাখলো কিন্তু মিথ্যা কথা (মিথ্যা সাক্ষ্য, মিথ্যা ওয়াদা) ইত্যাদি এবং মিথ্যার উপর আমল তথা যাবতীয় অবৈধ আয় উপার্জন ও সম্পর্ক আর জাহেলী আচরণ তথা ইসলাম বিরোধী কাজ ও আচরণ ছাড়তে পারলো না তার খানা-পিনা পরিত্যাগে আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই (বুখারী)। এরূপ রোজা উপবাস ছাড়া কিছুই না।

(৫) হাজ্জ আদায়: দৈহিক আত্মিক ও আর্থিক ইবাদাতের চূড়ান্ত রূপ হাজ্জ। কাবা ও তৎসংলগ্ন পবিত্র স্থানসমূহ নির্দিষ্ট নিয়মে যিয়ারত— ‘যাতে তারা তাদের কল্যাণময় স্থানসমূহে উপস্থিত হতে পারে।’ (সুরা হাজ্জ ২২: ২৮)

ইব্রাহীম (আ.), ইসমাঈল (আ.) ও বিবি হাজেরার স্মৃতি বিজড়িত পূণ্যময় স্থানগুলি আল্লাহ্পাক নির্দেশিত পন্থায় যিয়ারত করে তাওহীদবাদী ও আল্লাহ্ কেন্দ্রীক সংগ্রামী জীবনযাপনের চেতনায় উজ্জীবিত হওয়াই হাজ্জের মূল উদ্দেশ্য।

এভাবে ইসলাম মানব আত্মার সুস্থতা ও সুষ্ঠুতা বিধানের লক্ষ্যে সুসংঘবদ্ধ বিধি ব্যবস্থা দান করেছে।

আমরা রমজান মাস অতিক্রম করছি। ৫ ওয়াক্ত সালাত ও রমজানের সিয়াম পালনের সাথে সাথে এখানে অধিকাংশ যাকাত আদায় করি। সামর্থবানরা আরো সওয়াবের আশায় এ মাসে উমরা পালন করেন। ইতেকাফ করেন অনেকেই।

ইবাদাত বন্দেগীগুলোর উদ্দেশ্যের দিকে খেয়াল রেখে সচেতনভাবে আদায় করি। ভাল গুণগুলি অর্জন এবং মন্দ স্বভাব ও অভ্যাসগুলি বর্জন করি। নিজ আত্মাকে পরিশুদ্ধ করি, পরিশুদ্ধ সুন্দর পবিত্র সমাজ গঠনে অগ্রসর হই।

মহান আল্লাহ্ তা’লা সকলকে কবুল করুন। আমীন।

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর