আপনি পড়ছেন

মহান আল্লাহ্ তা’লা বলেন, ‘আমি তো তোমাদের প্রতি এমন এক কিতাব নাযিল করেছি যার মধ্যে তোমাদেরই কথা আছে, তবুও কি তোমরা বুঝবে না?’ (সুরা আম্বিয়া ২১:১০)

the holy quranকুরআনের আলোয় নিজেকে চিনি, ফাইল ছবি

সুরা আম্বিয়ার এই আয়াতখানির সাথে এক মশহুর ঘটনা জড়িত। আহনাফ বিন কায়েস নবী (স.)-এর সময় ঈমান আনেন। কিন্তু নবী (স.)-কে দেখার সৌভাগ্য তার হয়নি। তবে খুলাফায়ে রাশেদীন ও নবী (স.)-এর অনেক সাহাবীর সাক্ষাৎ ও সাহচর্য লাভ করেন তিনি।

এ আয়াতখানি পাঠ করার পর তার মনে প্রশ্ন জাগে কুরআনে তাহলে তার কথাও বলা হয়েছে। অতঃপর তিনি আল-কুরআনে নিজেকে খুঁজতে শুরু করেন।

পবিত্র কুরআনের পাতায় পাতায় তিনি বিভিন্ন ধরনের মানুষের দেখা পেলেন। দেখা পেলেন নেককার আল্লাহ্ ওয়ালা ‘সাবেকুন’- আল্লাহর পথে অগ্রসর বান্দাদের। তাদের সাথে নিজেকে মেলাতে গিয়ে আশাহত হলেন। দেখলেন এদের মানে তিনি নিজেকে উন্নীত করতে পারেননি। হাল ছাড়লেন না। আরো অগ্রসর হয়ে দেখলেন, কুরআন মাজীদের বিভিন্ন স্থানে মন্দ স্বভাবের লোকদের পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। তিনি চিন্তা করলেন এদের কাতারেও তিনি পড়েন না। অতঃপর তিনি কুরআনের ঘোষণা অনুযায়ী নিজেকে খুঁজে পেলেন। তিনি দেখলেন, একদল লোকের কথা কুরআন বলছে এভাবে:

‘হ্যা, এমন ধরনের কিছু লোকও আছে যারা নিজেদের গুনাহ স্বীকার করে। এরা ভাল মন্দ মিশিয়ে কাজকর্ম করে- কিছু ভালো কিছু মন্দ। আশা করা যায় আল্লাহ্ তা’লা এদের ক্ষমা করে দিবেন। অবশ্যই আল্লাহ্ তা’লা বড় দয়ালু, বড় ক্ষমাশীল।’ (সুরা তাওবা ৯:১০২)

আহনাফ দেখলেন এ যেন তার কথাই বলা হচ্ছে। তিনি নিজের গুনাহর ব্যাপারে সচেতন। আবার আল্লাহর দয়ায় ভাল ও নেক কাজও করেন। আর তিনি আল্লাহর দয়া ও রহমত থেকেও নিরাশ নন। কারণ কুরআনেই বলা হয়েছে, গোমরাহ ও পথভ্রষ্টরাই কেবল আল্লাহর দয়া থেকে নিরাশ হয় (সুরা হিজর ১৫:৫৬)। আহনাফ কুরআন মাজীদে তার কথা দেখতে পেলেন। বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে তিনি আল্লাহ্ পাকের বড়ত্ব ও মহত্বের কথা উপলব্ধি করলেন, মহান প্রভু তাঁর গুণাহগার বান্দার কথা ভুলেননি। তাঁর কিতাবে প্রকৃতই তাঁর সব বান্দাদের কথাই তিনি বলেছেন।

আল-কুরআনে কি আমার আপনার কথা আছে?

প্রিয় পাঠক, নিবন্ধের শুরুতে উল্লিখিত আয়াত অনুযায়ী কুরআন মজীদে আপনার-আমার সবার কথাই বলা হয়েছে। বস্তুত: মহান আল্লাহ্ তা’লা কুরআন নাযিল করছেন মানুষের হেদায়াতের জন্য। দুনিয়ার জীবনে মানুষের জন্য পথের দিশা হিসেবে। এর মূল বিষয়বস্তু মানুষ। মানুষ, মানুষের পরিচয়, তার স্বভাব, পছন্দ-অপছন্দ, মানুষের মালিক- তার স্রষ্টার পরিচয়, কেন তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন, তার কাছ থেকে রব্বুল আ’লামীন কি চান, কেন তাকে দুনিয়ায় পাঠালেন, দুনিয়ায় মানুষের কাজ কি কি, সে কাজ সে কিভাবে করবে, কোন কাজে মানুষের প্রকৃত সফলতা, কোন পথে তার ব্যর্থতা, তার জীবনের গন্তব্য কোথায়, সেখানে তার জন্য কি কি অবস্থা অপেক্ষা করছে, তার জীবনের সামগ্রিক সফলতার জন্য কি করণীয়, কোন কোন গুণগুলি তার লাগবে, কোন কোন দোষ থেকে তাকে বাঁচতে হবে, তার বন্ধু কারা, শত্রুই বা কারা তথা মানুষের সঙ্গে সম্পর্কিত সব বিষয় এতে বিশদ বর্ণনা করা হয়েছে।

মহান আল্লাহ্ তা’লার ভাষায়-

‘আমি আত্মসমর্পণকারীদের জন্য প্রত্যেক বিষয়ের স্পষ্ট ব্যাখ্যা স্বরূপ পথনির্দেশ, দয়া ও সুসংবাদ স্বরূপ তোমার প্রতি কিতাব নাযিল করলাম।’ (সুরা নাহল ১৬:৮৯)

মানবজীবনের প্রতিটা স্তর ও ক্ষেত্রের সব সমস্যার সমাধান দিয়েছেন তিনি এই কুরআনে। ব্যক্তিগত জীবন, পারিবারিক জীবন, সাংস্কৃতিক জীবন, আদব-আখলাক, অর্থনৈতিক জীবন, রাজনৈতিক জীবন, রাষ্ট্র পরিচালনার নীতিমালা, আইনের উৎস, আইনের মৌলিক বিধিমালা, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নীতিমালা সব বিষয়ে সব সমস্যার সমাধান দিয়েছেন তিনি তাঁর কিতাবে-

‘ওরা তোমার কাছে এমন কোনো সমস্যা উপস্থিত করে না যার সঠিক সমাধান ও সুন্দর ব্যাখ্যা আমি তোমাকে দান করি নাই।’ (সুরা ফুরকান ২৫:৩৩)

বিষয়বস্তু বুঝার সুবিধার্থে উদাহরণ দিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন। দিয়েছেন ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত, আবার কোথাও সহজ-সরল যুক্তির মাধ্যমে বিষয়বস্তু তুলে ধরেছেন তার বান্দাদের সুবিধার্থে:

‘রসুলদের এই সব বৃত্তান্ত আমি তোমার নিকট বর্ণনা করছি, যা দিয়ে আমি তোমার আত্মাকে দৃঢ় করি, এর মাধ্যমে তোমার কাছে এসেছে সত্য এবং মুমিনদের জন্য এসেছে উপদেশ ও সাবধানবাণী।’ (সুরা হুদ ১১:১২০)

ইহুদি জাতির ঐতিহাসিক ঘটনাবলী তুলে ধরতে গিয়ে আল্লাহ সুবহানহু ওয়া তা’লা বলেছেন-

‘আমি ইহা তাদের সমসাময়িক ও পরবর্তীদের শিক্ষা গ্রহণের জন্য দৃষ্টান্ত ও মুত্তাকীদের জন্য উপদেশস্বরূপ করেছি।’ (সুরা বাকারা ২:৬৬)

কুরআন বিশ্ব জাহানের মালিক আল্লাহর কিতাব সে ব্যাপারে যেন অনুসন্ধিৎসু মন নিশ্চিত হতে পারে সেজন্য বিভিন্ন মানুষের উপযোগী নিদর্শন রেখে দিয়েছেন তিনি কুরআনের ছত্রে ছত্রে। ফলে যে কবি বা ভাষাবিদ সে কুরআনের অলৌকিক ভাষার সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে বলে-

‘লাইসা হাযা কালামুল বাশার’ অর্থাৎ ‘এটি কোনো মানুষের কথা নয়’। চ্যালেঞ্জ দেয়া হয়েছে কুরআনে তার মতো কিছু রচনা করার জন্য (সুরা তুর ৫২: ৩৩-৩৪)। নিদেনপক্ষে ১০টি সুরা বানিয়ে আনতে (সুরা হুদ ১১:১৩); না পারলে তার মতো অন্তত ১টি সুরা রচনা করতে (সুরা ইউনুস ১০:৩৮)। শেষ অবধি সুরা কাউসারের প্রথম ২ আয়াত কাবায় টাঙিয়ে দিয়ে বলা হলো— পরবর্তী আয়াতখানি অন্তত: যেন তারা রচনা করে আনে। এরই জবাবে তৎকালীন আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি লাবিদ ছন্দ মিলিয়ে লিখে দিয়ে আসলেন—

‘লাইসা হাযা কালামুল বাশার’-এটা কোনো মানুষের কালাম নয়। এর মতো কিছু রচনা করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। কবি লাবিদ ইসলাম কবুল করলেন, কিন্তু রব্বুল আ’লামীনের ভাষার সৌকর্যে ও মহিমায় বিনম্র কবি কবিতা রচনা ত্যাগ করলেন। কেউ কবিতা বলতে বললে কুরআন মজীদের কোনো সুরা পেশ করতেন।

কুরআন বিজ্ঞানের বই নয়। কিন্তু বিজ্ঞানমনস্ক মানুষের জন্য এর ছত্রে ছত্রে বিজ্ঞানের এমন সব তত্ত্ব ও তথ্য দেয়া হয়েছে এতে, যা প্রমাণ করে এটা আরব মরুর এক নিরক্ষর মানুষের কষ্ট-কল্পনা নয়। এ কিতাব বিশ্ব জাহানের মালিক সর্বজ্ঞানের আঁধার আল্লাহ তা’লার পক্ষ হতে নাযিল করা হয়েছে। বিজ্ঞানের এমন সব খবর দেয়া হয়েছে, যা প্রিয় নবী (সা.)-কেন ১৪ শত বছর পূর্বের শ্রেষ্ঠ কোনো বৈজ্ঞানিকের পক্ষেও জানা সম্ভব ছিল না। সে আমল কেন, কুরআনের অনেক বৈজ্ঞানিক তথ্য হাল আমলে আবিষ্কৃত হয়েছে, হচ্ছে, হতে থাকবে।

মাতৃগর্ভে ভ্রুণের বিভিন্ন অবস্থা, বায়ুচক্র, পানিচক্র, পৃথিবীকে স্থির রাখায় পাহাড়ের ভূমিকা, নদীর মিঠা পানির সাথে সমুদ্রের নোনা পানি মিশ্রণ না হওয়া, মধু ও দুধের উৎপত্তি ও উপকারিতা, চন্দ্র-সুর্যের আবর্তন প্রভৃতি বৈজ্ঞানিক তথ্যে সমৃদ্ধ কুরআন। যাতে রহমানের বান্দারা তাঁর কিতাবকে চিনতে পারে, কিতাবের সত্যতা উপলব্ধি করতে পারে।

কুরআন পাঠের মাস রমজান, কুরআন বুঝার মাস রমজান:

রমজান মাস অতিক্রান্ত হচ্ছে। এ মাসের মূল বৈশিষ্ট্য- এ মাসে কুরআন নাযিল শুরু হয়। নবী (স.) এ মাসে বেশি বেশি কুরআন অধ্যয়ন করতেন। তার অনুসরণে সাহাবীগণও (রা.)। আমরা কুরআন পড়ছি, খতম দিচ্ছি, রমজানে কুরআন খতম দীর্ঘদিনের রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। নতুন নতুন নিয়ম বের হয়েছে ৭ দিনে খতম, ১০ দিনে খতম, ১৫ দিনে, ২৭ দিনে খতম ইত্যাদি। অথচ রসুলুল্লাহ্ (স.) এমনটি করতে নিষেধ করেছেন। উনি তো তারতীলের সাথে ধীরে ধীরে কুরআন পাঠ করতেন, আয়াতগুলি নিয়ে ভাবতেন। আয়াতের বিষয়বস্তু অনুযায়ী reaction হতো তার (স.) মধ্যে। এক আয়াত পড়ে তার বিষয়বস্তুর চিন্তায় কোনো কোনো রাতের তাহাজ্জুদের গোটাটাই অতিক্রান্ত হতো তার। আমাদের কুরআন পাঠে সেই আবেদন নেই। আছে কুরআনের আদেশের (মুযাম্মিল ১-৫) লংঘন। আর রসুলের সুন্নাহর ব্যত্যয়। ফলে খতম ও তারাবী দু’টোই প্রশ্নবিদ্ধ থেকে যাচ্ছে।

আসুন, এ রমজানে কুরআন অধ্যয়নে কুরআনের নির্দেশের আনুগত্য করি, রসুলের সুন্নাহর পুনর্জীবন ঘটাই। বুঝে বুঝে পড়ি চিন্তার সাথে। কুরআনের আবেদন নিয়ে চিন্তা করি। নিজেকে খুঁজি যেমন খুঁজেছিলেন হযরত আহনাফ। অবশ্যই আপনার কথা, আমার কথা আমাদের মহান রব তাঁর কিতাবে উল্লেখ করেছেন। কুরআনের আলোয় নিজেকে চিনি, নিজেকে আবিষ্কার করি। কুরআনের চশমা দিয়ে জগৎটাকে দেখি। দেখবেন সব কিছু অন্যরকম লাগে। অর্থপূর্ণ লাগে, It actually makes sense ধৈর্য সহকারে লেগে থাকি। রাতারাতি কোনো কিছু হয় না। শুরু করি, দেখবেন আল্লাহর রহমত আসবে, আল্লাহ্ সহজ করে দিবেন, সহজ করে দিয়েছেন-

‘উপদেশ গ্রহণের জন্য আমি এই কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি। আছ কেউ উপদেশ গ্রহণকারী? (সুরা কামার ৫৪:১৭, ২২, ৩২, ৪০)

আয় আল্লাহ্! আপনি আমাদের সহায় হোন।

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর