আপনি পড়ছেন

মহান আল্লাহ্ তা’লা বলেন, ‘‘কিন্তু আমি সত্য দ্বারা আঘাত হানি মিথ্যার উপর; ফলে উহা মিথ্যাকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দেয় এবং তৎক্ষণাত মিথ্যা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।” (সূরা আম্বিয়া ২১:১৮)

ramadan abstain from liesফাইল ছবি

রসূল (সা.) বলেন, মিথ্যা সমস্ত পাপের মা। অর্থাৎ সমস্ত পাপ কাজের মূলে রয়েছে কোনো না কোনো মিথ্যা। সুদ, ঘুষ, দুর্নীতিসহ সমস্ত অর্থনৈতিক অনাচারের ভিত্তি মিথ্যা। সুদ সম্পদ বৃদ্ধির কথা বলে অথচ তা কার্যত: সম্পদ ধ্বংস করে। ঘুষখোর তার কাজের জন্য বেতন নিচ্ছে। সে ঘুষ নেয়, যার বিনিময় সে ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠান থেকে নিচ্ছে। তদুপরি কাউকে অন্যায় সুযোগ পাইয়ে দেওয়ার জন্য যখন সে ঘুষ নেয় তখন তাতে আরেকটা মিথ্যা যুক্ত হয়। শিক্ষক কোচিং বাণিজ্য করে অথচ প্রতিষ্ঠান থেকে সে বেতন নেয় পড়ানোর জন্য। কোচিংয়ের এডভারটাইজ করার জন্য নয়। শ্রমিক দিনে যে কতটুকু কাজ করার কথা তার থেকে কম করে মজুরি নেয়। তার মধ্যে মিথ্যা রয়েছে। ব্যবসায়ী ভেজাল মাল দেয়, মাপে-ওজনে কম দেয় তা বলে কয়ে নয়। বরং সে মিথ্যাচার করে বিশুদ্ধ মাল যথাযথ ওজনে দেওয়ার দাবি করে। ব্যভিচারের মধ্যেও রয়েছে অবৈধ সম্পর্কের মিথ্যাচার। এমনিভাবে রসূলুল্লাহ্ (সা.) ছোট্ট কথায় বিষয়টি চিহ্নিত করে দিয়েছেন যে, মিথ্যাচারই সমস্ত পাপ কর্মের ভিত্তি।

রসূলুল্লাহ (সা.) আরো বলেন-

“নিশ্চয়ই সত্যবাদিতা পূণ্যের পথ দেখায়। আর পূণ্য জান্নাতের দিকে পথনির্দেশ করে। আর মানুষ সত্য কথা বলতে থাকে, শেষ পর্যন্ত আল্লাহর নিকট তাকে সিদ্দিক (মহা-সত্যবাদী) হিসিবে লিপিবদ্ধ করা হয়। আর নিঃসন্দেহে মিথ্যাচার নিলর্জ্জতা ও পাপাচারের দিকে নিয়ে যায়। আর পাপাচার জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়। আর মানুষ মিথ্যা বলতে থাকে, শেষ পর্যন্ত আল্লাহর নিকট তাকে কায্যাব (মহা-মিথ্যাবাদী) হিসেবে লিপিবদ্ধ করা হয়।” (বুখারী-মুসলিম)

দুর্ভাগ্যজনকভাবে আজ গোটা দুনিয়ায় মিথ্যার সয়লাব বয়ে যাচ্ছে। ব্যক্তি পর্যায় থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায় পর্যন্ত দায়িত্বশীল মানুষেরা নির্লজ্জভাবে মিথ্যাচার করে চলেছে। মিথ্যার ভিত্তিতে দেশ দখলের মহোৎসব চলছে। জাতিসংঘ সেগুলোর বৈধতা দেওয়ার রাবারস্ট্যাম্প প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে।

                                                         War is Peace
                                                    Freedom is Slavery
                                                  Ignorance is Strength

স্লোগানগুলি শুনলে মনে হবে বুঝি প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বা অধুনা নব্য সাম্রাজ্যবাদী রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন সাহেবের কোনো বক্তৃতা বা বাণী হতে সংগৃহীত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এ বাক্যগুলি প্রখ্যাত ব্রিটিশ লেখক জর্জ অরওয়েলের অমিয় কীর্তি 1984 নামক উপন্যাস হতে উদ্ধৃত।

অরওয়েল 1984 লিখেছিলেন গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে। এটি প্রকাশিত হয় ১৯৪৯ সালে। অরওয়েলের আরেক অমর কীর্তি ‘Animal Farm’। এটি লেখা হয়েছিল রাশিয়ার কমিউনিস্ট বিপ্লবকে সামনে রেখে রূপক আকারে। উচ্চ মাধ্যমিকে পাঠকালে এর কিছু অংশ আমাদের ইংরেজি পাঠের অংশ ছিল। সেই থেকে এই অভিনব চিন্তার মানুষটির প্রতি আগ্রহ জন্মে যায়।

‘1984’ অরওয়েল লিখেছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ উত্তর বিশ্ব নেতৃত্বের মধ্যে কর্তৃত্বপরায়ণ মনোভাবের বিস্তার দেখে। ইতিমধ্যে হিটলারের জার্মানি ও নাৎসিবাদের ফলশ্রুতিতে ঘটে যাওয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ খুব কাছ থেকে দেখেছেন তিনি। পেশায় ছিলেন খ্যাতিমান ব্রিটিশ সাংবাদিক। তার মনে আশঙ্কা জাগে, ক্রমশ: কর্তৃত্বপরায়ণ শাসনের বিস্তার ঘটবে। শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিতরা মানুষের সমগ্র জীবন নিয়ন্ত্রণ করতে চাইবে। এর জন্য তারা মানুষের স্বাভাবিক চিন্তাধারাকে পরিবর্তন করার উদ্যোগ নিবে। সেই লক্ষ্যে এই স্লোগানের ব্যাপক প্রচারণা চালানো হবে। অনুবাদ করলে এই স্লোগানগুলির অর্থ দাঁড়ায় :

                                                              যুদ্ধই শান্তি
                                                      স্বাধীনতা মানেই দাসত্ব
                                                             অজ্ঞতাই শক্তি

এমনি নানা চিন্তাধারার সন্নিবেশ ঘটেছে উপন্যাসটিতে। তার কিছু নিম্নরূপ:

১. চিন্তাপরাধ: সরকার কর্তৃক নির্ধারিত চিন্তাধারার বিপরীতে স্বাধীন চিন্তার মনোভাব।

২. অতীত মুছে দেওয়া: ক্ষমতাসীন পার্টির কাছে ক্ষমতাই মুখ্য। তাই তারা অতীতকে মুছে দেয়। বর্তমানই সব। এখন যা যেমন অতীতেও ছিল তা-ই, ভবিষ্যতেও তা-ই থাকবে।

৩. সত্য-মন্ত্রণালয় (মিনিষ্ট্রি অব ট্রুথ): সরকার কর্তৃক নির্ধারিত চিন্তাধারা প্রচার প্রসার ঘটানোই যার কাজ। অতীতের সব সত্যকে সুকৌশলে মুন্সিয়ানার সাথে মিথ্যায়নই এ মন্ত্রণালয়ের কাজ।

৪. Big Brother is watching you: বড় ভাই কিন্তু তোমাকে লক্ষ্য করছেন। জনগণকে নিয়ন্ত্রণের জন্য ভীতির সম্প্রসারণ।

৫. মিনিস্ট্রি অব পিস: যার নিয়ন্ত্রণে কেবল যুদ্ধ, যুদ্ধ বাধাও জনগণের দৃষ্টি ফেরাও।

৬. মিনিস্ট্রি অব লাভ: ভালবাসা মন্ত্রণালয়ের অধীনে আইন-শৃঙ্খলা।

৭. থটপুলিশ: মানুষের চিন্তাধারা মনিটর করার ব্যবস্থা।

বস্তুত: স্টালিনের অধীনে সোভিয়েত রাশিয়ার চিত্র ব্যাপক আকারে তুলে ধরাই ছিল এই উপন্যাসের উদ্দেশ্য। সোভিয়েট রাশিয়া ভেঙে গেছে। পুতিন অবশ্য তার কিছুটা হলেও উদ্ধারের চেষ্টা করছেন। দেখা যাক উনার চেষ্টা কতদূর আগায়। কিন্তু বিশ্বময় কর্তৃত্ববাদী সরকার ব্যবস্থা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। গণতন্ত্রের ফেরিওয়ালাদের দেশগুলোও এর বাইরে নয়। অরওয়েলের আশঙ্কা বহুলাংশে আতঙ্কজনকভাবে বাস্তবে রূপ লাভ করেছে। ছড়ানো হচ্ছে কখনো কমিউনিজমের জুজুর ভয় আবার কখনো ইসলামী মৌলবাদের সম্প্রসারণের আশঙ্কা। আতঙ্কিত মানুষ নিরাপত্তার আশায় নিজের অধিকার বিসর্জন দিচ্ছে। এসবের বিস্তার ঘটানোর জন্য আধুনিক সত্য মন্ত্রণালয়গুলো অনুমোদিত সত্যের সম্প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে অবিরাম।

ইরাক হামলা হল, লাখ লাখ মানুষ নারী-শিশু-অসহায় মানুষ হত্যা করা হল, ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্রের ধোঁয়া তুলে। পরে জানা গেল সব বানোয়াট। কিন্তু কোনো বিচার নেই। ওই সব ইরাকি মানুষ কি ইউক্রেনের মানুষগুলোর চেয়ে “কম মানুষ” (Less Human) ছিল? মিনিস্ট্রি অব পিসগুলো দেশে দেশে আরো যুদ্ধ বাঁধাচ্ছে। ভালবাসা মন্ত্রকেরা মানুষকে নিয়ন্ত্রণের জন্য নিত্যনতুন আইন তৈরি করছে। থানা পুলিশ সব রেকর্ড করছে যেন মানুষেরা “চিন্তাপরাধে” জড়িয়ে পড়ে নিজেদের ক্ষতি করতে না পারে। এভাবে চলছে বিশ্বময়।

সে বহুকাল আগের কথা। সত্য আর মিথ্যা নাকি একদিন বেড়াতে বের হয়েছিল। পথিমধ্যে সুন্দর একটা ঝিল দেখে মিথ্যা প্রস্তাব দেয় তাতে নেমে গোসল করার। সত্য কাপড় খুলে যেই তাতে নেমেছে, মিথ্যা তার কাপড়গুলো নিয়ে পালিয়ে গেল। সেই থেকে মিথ্যা সত্যের লেবাস পড়ে অবলিলায় মানব সমাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর নগ্ন সত্য সবার সামনে ঘুরলেও কেউ তাতে ভ্রুক্ষেপ করে না। কাল্পনিক হলেও শিক্ষণীয় এ গল্প বর্তমান অবস্থা তুলে ধরেছে সঠিকভাবে।

মিথ্যা থেকে বাঁচার জন্য সিয়াম

মানবজীবনে সব সমস্যার উৎস পাপ বা অপরাধ থেকে। আর সব অপরাধের মূলে আছে মিথ্যাচার। মিথ্যা, মিথ্যাচার ও মিথ্যাচারের ভিত্তিতে রচিত জীবনদর্শন, ভাবাদর্শ-মতবাদ, কার্যাবলী থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহ্ মুমিনদের দান করেছেন সিয়াম বা রোজা। না খেয়ে থাকার নাম রোজা নয়। রসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেন-

“যে ব্যক্তি রোজা রেখে মিথ্যা কথা ও কাজ এবং জাহেলী কাজকর্ম ত্যাগ করতে পারলো না তার খানা-পিনা ত্যাগ করায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।” (বুখারী)

তিনি (সা.) আরো বলেন-

“খানা-পিনা ত্যাগ করাই সিয়াম নয় বরং সিয়াম হল অর্থহীন ও খারাপ কাজ ত্যাগ করা।” (বায়হাকী হাকেম)

সিয়াম পাপ থেকে বাঁচার জন্য ঢালস্বরূপ, কিন্তু ঢাল যদি ফুটা হয় তবে সে তার পেছনে আশ্রিতকে রক্ষা করতে পারে না। রসূল (সা.) ও সেই কথাই বলেছেন। তিনি বলেন-

সিয়াম হচ্ছে ঢালস্বরূপ যদি না সে নিজেই তা ফুটা করে দেয়। সাহাবীরা জিজ্ঞাসা করলেন, কোন জিনিস দ্বারা তা ফুটো হয়ে যায়? এরশাদ হল- মিথ্যা কথা ও গীবত। (নাসাই, হাদীস সম্ভার)

বস্তুত: দীর্ঘদিন যাবৎ বহু মানুষ আমরা রোজা রাখছি। কিন্তু তার ফায়দা পাচ্ছি যেন খুবই কম। রোজার উদ্দেশ্য ঠিক না হওয়াতেই তেমনটি হচ্ছে কিনা সবাই ভেবে দেখি। মিথ্যা কথা ছাড়া, মিথ্যা ওয়াদা করা, মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া, মিথ্যার উপর আমল, ইসলাম বিরোধী জাহেলী কাজ, গীবত প্রভৃতি রোজা বিনষ্টকারী ও ঈমান বিধ্বংসী আমলগুলি ছাড়ার কোনো Plan করেছি কি? নাকি কেবল না খেয়েই থাকছি?

সুন্দর সমাজ চাই। অন্যেরা সুন্দর হবে। সরকার, তার মন্ত্রী ও কর্মকর্তারা সব ভাল হয়ে যাবেন। কিন্তু আমি যেমন ছিলাম তেমনই থাকবো। মিথ্যা বলবো, দুর্নীতি করবো, বিদেশে টাকা পাচার করবো। তাহলে রোজাও হবে না সুন্দর সমাজও হবে না। আখিরাতে এই রোজা কি আমাকে রাইয়্যানে পৌঁছে দিবে, জাহান্নামের গহবর থেকে আমাকে উদ্ধার করবে? সবাই ভেবে দেখি। অন্যেরা কি করে সেদিকে দেখবেন না। নিজের নিজের নাজাতের স্বার্থে মিথ্যার সাথে সমস্ত সংস্রব বর্জন করি। আজ থেকেই। মহান আল্লাহ্ তা’লা সকলকে তাওফীক দান করুন। আমীন।

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর