আপনি পড়ছেন

মহান আল্লাহ্ তা’লা বলেন, “সৎকাজ ও তাকওয়ায় তোমরা পরস্পরকে সাহায্য করবে এবং পাপ ও সীমালংঘনে একে অন্যকে সাহায্য করবে না। আল্লাহকে ভয় করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ শাস্তি দানে কঠোর।” (সূরা মায়িদা ৫:২)

the holy kabahমুসলিম উম্মাহর প্রাণকেন্দ্র পবিত্র কাবা, ফাইল ছবি

মানুষ সমাজবদ্ধভাবে বাস করে। এটাই স্রষ্টার বিধি। পরস্পর, ঘোষিত বা অঘোষিতভাবে একে অন্যের সহযোগী হবে এটাই সমাজ গঠনের মূল চেতনা। এভাবেই সমাজ গড়ে উঠে।

আল্লাহ্ তা’লা মানুষকে সৃষ্টি করে দুনিয়াতে প্রেরণ করেছেন পরীক্ষা করার জন্য। তিনি দেখতে চান কে ভাল কাজ করে (সূরা মূলক ৬৭: ২)। ভাল কাজ করে, ভালভাবে করে। ইহসানের সাথে করে।

সব ভাল কাজ একাকী করা যায় না। বস্তুত: সমাজবদ্ধতা ছাড়া ভাল কাজ কেন, মানুষ তার অস্তিত্বও টিকিয়ে রাখতে পারে না। এজন্য মুমিনদের আল্লাহ্ ঐক্যবদ্ধ হয়ে মিলে-মিশে বসবাস করার নির্দেশ দিয়েছেন। কুরআনী নির্দেশ ও ইসলামী বিধিগুলি একজোট ও একাট্টা হয়ে অনুসরণ ও বাস্তবায়ন করতে বলেছেন। (সূরা আলে-ইমরান ৩ : ১০৩)

ইসলাম বৈরাগ্যবাদী জীবনব্যবস্থা নয়। সংসার, সংসারের দায়িত্ব বর্জন করে নির্জন নিরিবিলি একাকীত্বে স্রষ্টার ধ্যানের বিধান কুরআন-হাদীস থেকে পাওয়া যায় না। দুনিয়ার জীবনের আরেক বাস্তবতা হল- ভাল ও কল্যাণের পথটা এখানে মসৃণ নয়। মানুষ, মানুষের উন্নতি ও শান্তিপূর্ণ জীবনের পথে রয়েছে শয়তানী শক্তির বাধা। তারা একজোট। একাকী তাদের বিপরীতে টিকে থাকা দুষ্কর, বরং অসম্ভব। রসূল (স.) তার এক হাদীসে উদাহরণ দিয়ে বলেন, দলছুট ভেড়াকে যেভাবে নেকড়ে সহজেই ঘায়েল করে ফেলে তেমনি বিচ্ছিন্ন মুমিন সহজেই শয়তানের খপ্পরে পড়ে যায়।

মুসলমানের ঐক্যবদ্ধতার নীতি কি হবে, কোন কোন কাজে তারা সহযোগী হবে, কোন কাজে সহায়তা করায় তাদের জন্য বৈধতা নেই তা শুরুতে উল্লিখিত সূরা মায়িদার আয়াতখানিতে বর্ণিত হয়েছে।

সমাজ বাস্তবতা

বর্তমান বিশ্বেও সর্বত্র আমরা ইসলামের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ বৈরীতা দেখতে পাই। দেখি অকল্যাণের সম্প্রসারণে অশুভ শক্তিগুলোর সম্মিলিত প্রয়াস। শক্তিমানেরা সাধারণকে যেন একেবারে গিলে ফেলতে চায়। সমাজটা, বিশ্বটা, বিশ্বের তাবৎ সম্পদ নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিতে চায়। শক্তিমান কবি মরহুম আল-মাহমুদ তার ‘মাৎস্যন্যায়’ কবিতায় এমনি এক চিত্র তুলে ধরেছেন:

“এটা হল বোয়াল মাছের দেশ,
কালি বোয়াল, ধলি বোয়াল, সোনা বোয়াল ও
সাদা বোয়ালের অব্যাহত বিচরণভূমি।
খাল-বিল, ডোবা-নালা ও হাওড়ে একচ্ছত্র বোয়ালেরই রাজত্ব।
আমরা বোয়ালরা আমাদের চেয়ে নরম চোয়ালের মাছদের আইনসংগতভাবে খেয়ে বাঁচি। আমাদের চেয়ে একটু গায়ে গতরে ছোট মাছদের মোটামুটি গিলে ফেলি।”

এই সর্বগ্রাসী বোয়ালের রাজত্বে নেই কোনো নীতি-ন্যায্যতা। তারা নিজেদের জন্য আইন বানিয়েছে হাজার কোটি টাকা মেরে দাও। তোমাকে আগামী ইলেকশনে জনপ্রতিনিধি বা জনকল্যাণের পরামর্শক কোনো দায়িত্ব দেওয়া হবে। এটাই নাকি জনদাবী। আর গরীব কৃষকের ৫ হাজার টাকা কৃষি ঋণ জোর করে আদায় করো। নইলে দেশ যে রসাতলে গেল!

আল মাহমুদের ভাষায়,

“আমাদের রাষ্ট্রবিজ্ঞান আছে। আমরা একে বলি বোয়ালসংহিতা।”
অপেক্ষাকৃত ছোটদের নির্দ্বিধায় খেয়ে বাঁচো। আমাদের সংহিতা বলে, শকুন্তলার আংটিচোর বাইচ্যান্স ধরা পড়ে গেলে তার নির্ঘাত দন্ড হলো ছয় মাস।
ঘানি টানতে হবে - তার নাম হবে তস্কর।
আর যদি কোনো রাঘব বোয়াল এসে
পুরো বাংলাদেশটাকেই
আংটির মত গিলে ফেলে তবে তাকে বলতে হবে–
রাজাধিরাজ। সেলাম কর তাকে- এরই নাম বোয়ালসংহিতা।” (মাৎস্যন্যায়)

এই বোয়ালদের রাজত্বে এই কল্যাণকামী মানুষেরা যদি পরস্পরকে কল্যাণের পথে সাহায্য না করে তবে সময়ের আবর্তনে কল্যাণের নাম নেওয়ার কাউকে পাওয়া যাবে না।

ড. খালিদ আবু শাদি তার ‘রমাদান : আত্মশুদ্ধির বিপ্লব’ গ্রন্থে এ বিষয়ে সুন্দর একটা গল্প উদ্ধৃত করেছেন-

মাসরুক (রহ.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, মরু অঞ্চলে কিছু লোক বাস করতো। তাদের একটা কুকুর, একটা গাধা এবং একটা মোরগ ছিল। মোরগ তাদের সলাতের জন্য জাগিয়ে দিতো। গাধা তাদের জন্য পানি বহন করতো এবং তাদের তাঁবু টানতো। আর কুকুর তাদেরকে পাহারা দিতো। হঠাৎ একদিন একটি শিয়াল এসে তাদের মোরগটা নিয়ে গেল। মোরগটা হারিয়ে তারা পেরেসান হয়ে গেল। তাদের মধ্যে জনৈক নেককার লোকও ছিলেন। তিনি বললেন “হয়তো এতে কোনো কল্যাণ রয়েছে।” তারা এভাবে বাস করতে থাকলো যতদিন আল্লাহ্ চাইলেন।

এরপর একদিন একটি নেকড়ে আসলো এবং গাধাটার পেটে আঘাত করে তা ফেঁড়ে ফেললো। গাধাটাকে নেকড়ে মেরে ফেললো। এবার গাধা হারিয়ে তারা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। নেককার লোকটা বললেন “হয়তো এতে কোনো কল্যাণ রয়েছে।” এরপর তারা যতদিন আল্লাহ্ চাইলেন, এভাবেই বাস করতে থাকলো। এর কিছু দিন পর আবার তাদের কুকুরটা আক্রান্ত হলো। তখন নেককার লোকটি বললেন “হয়তো এতে কোনো কল্যাণ রয়েছে।” এরপর আল্লাহ্ যতদিন চাইলেন, তারা অবস্থান করতে থাকলো।

হঠাৎ একদিন তারা দেখলো তাদের শত্রুপক্ষ তাদের আশপাশের সকলকে বন্দী করে ফেলছে এবং শুধু তাদেরকেই বাকী রেখেছে। শত্রুপক্ষ তাদের ছাড়া অন্যদের গ্রেপ্তারের কারণ হলো, অন্য লোকদের কাছে শব্দ ও শোরগোল করার মতো জিনিস ছিল। যা এই লোকদের কাছে ছিল না। কেননা এদের কুকুর, মোরগ ও গাধা (হঠাৎ আওয়াজ করে উঠবে) এমন সব আগেই ধ্বংস হয়ে গেছে।” (পৃ ১৯০-১৯১)

এই কাল্পনিক গল্পের সাথে জার্মান কবি Pastor Martin Niemoller-এর বিখ্যাত কবিতার মিল রয়েছে:

First they came for the socialists, and I did not speak out—because I was not a socialist.
Then they came for the trade unionists, and I did not speak out— because I was not a trade unionist.
Then they came for the Jews, and I did not speak out—because I was not a Jew.
Then they came for me—and there was no one left to speak for me.

নাৎসি জার্মানির হিটলারের এসএস ও গেসটপো বাহিনী জাতিকে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করে। এরপর এক এক করে তাদের অন্যায়ের বিরোধিতা করতে পারে এমন সব শক্তিগুলিকে কিভাবে নিশ্চিহ্ন করেছে তার চিত্র এতে ফুটে উঠেছে। বস্তুত: এটা সব জালিম স্বৈরাচারীর অনুসৃত পথ:

“ফিরআউন দেশে পরাক্রমশালী হয়েছিল এবং সেখানকার অধিবাসীদের বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করে তাদের একটি শ্রেণীকে সে হীনবল-দুর্বল করেছিল; সে তাদের পুত্র সন্তানদের হত্যা করতো এবং নারীগণকে জীবিত রাখতো। সে তো ছিল বিপর্যয় সৃষ্টিকারী।” (সূরা কাসাস ২৮ : ৪)

ফিরআউনী শাসনের অবসান হয়েছে, কিন্তু তার নীতি আজও জালিমরা অনুসরণ করছে। হিটলার গোয়েবলেসের অনুসারী শাসকবৃন্দ আজ পৃথিবীর দেশে দেশে শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। প্রথমে তারা একটা শ্রেণীকে যাকে তারা নিজেদের শত্রু মনে করে, তাদের ব্যাপারে বিরূপ প্রচারণা চালায়। তারপর একটি ঘটনা ঘটিয়ে ঐ শ্রেণীর উপর চাপিয়ে দিয়ে তাদের সর্বশক্তি নিয়ে এদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে। ‘Give the dog a bad name and kill it’ গৃহস্থের পাহারাদার কুকুরটা পাগল হয়ে গেছে বলে চোর প্রচারণা চালায়। তারপরে গ্রামবাসী মিলে কুকুরটা হত্যা করে। তখন চোরের জন্য সতর্ককারী আর কেউ রইল না। মানবাধিকার, ধর্মীয় স্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতার বিশ্ব ফেরিওয়ালা থেকে শুরু করে সর্বত্র আজ এই হিটলারী নীতির জয়জয়কার।

উম্মাহ চিন্তাধারার পুনর্জাগরণ ও সিয়াম

মুসলিম উম্মাহ আজ শতধা বিভক্ত। শিয়া-সুন্নী, মাযহাব, তরীকা, মাযহাবী-লা মাযহাবী, জাতিয়তাবাদী বিভিন্ন গোষ্ঠী ইত্যাদি নানাভাবে তৈরি হয়েছে। নামাযে হাত কোথায় বাঁধবে, দোয়ায় হাত তুলবে কি তুলবে না এ নিয়ে নানা হট্টগোল। ভাগের শেষ নেই। কিন্তু আমরা সবাই এক আল্লাহতে বিশ্বাসী। বিশ্বাস করি শেষ নবীর নবুয়্যতে, শেষ কিতাব আল-কুরআনে। নামায পড়ি ৫ ওয়াক্ত একই কিবলার দিকে ফিরে। সিয়াম, যাকাত ও হাজ্জ-ঈমান ও ইসলামের মৌলিক বিধানগুলি সব ঐক্যের কথা বলছে।

সিয়ামের মাস চলছে। সারা বিশ্বে মুসলমান এক সাথে রোজা রাখছে। সামান্য কিছু মতপার্থক্য ছাড়া সেহরি-ইফতার কিয়ামুল লাইল সবের বিধানে কি মিল! তবুও কেন বিভক্ত হচ্ছি? কে করছে?

খুঁটি-নাটি বিভক্ত ছাড়ি। পারস্পরিক গালি-গালাজ বদনামি বন্ধ করি। কল্যাণের পথে হাঁটি, অন্যকে হাঁটতে উদ্বুদ্ধ করি, সাহায্য করি। ইসলামী দল, গোষ্ঠী ও ব্যক্তিত্বরা একজোট হয়ে বসুন। ন্যূনতম ইসলামিক এজেন্ডার ভিত্তিতে একমত হোন। একজোট হোন। জাতিকে একজোট করুন। ইসলাম চাই। কুরআন-সুন্নাহর ইসলাম। বিভেদ-বিভক্তি চাই না। রেষা-রেষির অবসান চাই। ইয়েমেনে বোম্বিং বন্ধ চাই। ইয়েমেন-সোমালিয়ায় সেহরীর খাদ্য চাই, ইফতার করার জন্য পরিষ্কার পানি চাই। ওরা সেহরি ইফতারের পানি পায় না। না খেয়ে রোজা রাখে। আর রাজতন্ত্রের পোষা বুলবুলিরা মুসলিম নারী-শিশু হত্যার যৌক্তিকতার বয়ান দিয়ে বেড়ায়। এর অবসান চাই। এরা বাঁচে কিভাবে? সেহরী ইফতার গলা দিয়ে নামে কিভাবে? মুসলিম দেশের সরকারগুলোর বিলাসী প্রোগ্রাম বাদ দিয়ে উম্মাহর বিপর্যস্ত অংশগুলির পাশে দাড়ানো দরকার। ক্ষমতা অর্জন ও ধরে রাখা নয় আল্লাহর সন্তুষ্টি ও জান্নাতই লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যে কল্যাণময় কাজগুলির বিস্তৃতি ঘটাই। সেকাজে পরস্পরকে সহযোগিতা করি। উম্মাহর চেতনার পুণর্উন্মেষ ঘটাই। মহান আল্লাহ্ তা’লা সকলের সহায় হোন। আমীন।

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর