আপনি পড়ছেন

“আমরা পৃথিবীতে আল্লাহকে পরাজিত করতে পারবো না, এবং পালিয়ে গিয়েও তাঁকে ব্যর্থ করতে পারবো না।”এই অংশটুকু পবিত্র কুরআনের ৭২নং সূরা, সূরা জিন্ন-এর ১২তম আয়াতের অংশ বিশেষ। জিন্নদের বিভিন্ন গোষ্ঠী রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর জীবনের বিভিন্ন সময় তার প্রতি ঈমান আনে।

holy quran the gift of allahআল্লাহর পক্ষ থেকে শ্রেষ্ঠ উপহার আল কুরআন, ফাইল ছবি

এর একটি নবুয়তের দশম বছর নবী (সা.) নির্যাতিত হয়ে তায়েফ থেকে ফেরার পথে। বিষয়টির বর্ণনা এসেছে সূরা আহকাফের ২৯-৩২ আয়াতে।

সূরা জিন্নের বর্ণিত অংশটুকু, রসূল (সা.) কয়েকজন সাহাবীকে নিয়ে উকাযের বাজারে যাওয়ার সময় সংঘটিত হয়। তাফসিরকারকদের মতে, এটি নবুয়তের প্রাথমিক যুগে মক্কায় সংঘটিত হয়।

জিন্ন জাতি

জিন্ন জাতি আল্লাহর মখলুকদের মধ্যে অন্যতম। কুরআন মজীদে অনেক স্থানে উল্লিখিত হয়েছে যে, এরা আগুন থেকে সৃষ্টি (যেমন সূরা আর-রহমান)। ইবলীস জিন্ন জাতের অন্তর্ভুক্ত। (সূরা কাহাফ ১৮:৫০) এরা ভিন্ন এক মখলুক। এদের নিজস্ব চরিত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেমন, এরা অশরীরী সত্ত্বা, যে কোনো সুরত ধারণে সক্ষম ইত্যাদি। মানুষের মতোই জিন্নদের মধ্যে ঈমানদার ও কাফির জিন্ন রয়েছে। আলিমদের সাধারণ মত হল, মানুষের মধ্যে প্রেরিত নবী-রসূলগণ জিন্নদেরও নবী-রসূল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে তাদের মধ্যে নেককাররা নবীদের অনুসরণে তাদের জাতির মধ্যে হেদায়াতের দিকে আহবান জানায়। শেষ নবী (সা.) জিন্নদের জন্যও নবী হিসেবে প্রেরিত হয়েছিলেন। যা কুরআন মজীদের সূরা আহকাফ ও সূরা জিন্ন-এর সংশ্লিষ্ট অংশ থেকে পরিষ্কার বুঝা যায়।

জিন্নদের উদ্ধৃতি উল্লেখের তাৎপর্য

জিন্নরা মানব জাতির পূর্বে সৃষ্ট। মানুষ আল্লাহর খলিফা হিসেবে শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী। কিন্তু পূর্বে সৃষ্ট হিসেবে জিন্নদের অভিজ্ঞতায় অগ্রসরতা রয়েছে। তাছাড়া নবী (সা.)ও বিভিন্ন সময় জিন্নদের উদ্ধৃতি দিয়েছেন। যেমন- সূরা আর-রহমানে বারবার উল্লিখিত আয়াত “ফাবি আইয়্যি আ’লাই রব্বিকুমা তুকায্যিবান।” অর্থাৎ “তবে তোমরা উভয়ে (জিন্ন ও মানুষ) তোমাদের রবের কোন নেয়ামত অস্বীকার করবে?। নবী (সা.) বলেন, “জিন্নরা তাদের রবকে যে জওয়াব দিয়েছিল তোমাদের কাছ থেকে সে রকম সুন্দর জওয়াব শুনছি না কেন?’ লোকেরা বললো ‘সে জওয়াব কি ছিল?’ নবী (সা.) বললেন, ‘যখনই আমি আল্লাহর বাণী “ফাবি আইয়্যি আলাই রব্বিকুমা তুকায্যিবান” পড়ছিলাম জিন্নেরা তার জবাবে বলছিল ‘লা বিশাই ইম্মিন নি’মাতি রব্বিনা নুকায্যিবু।’ অর্থাৎ ‘আমরা আমাদের রবের কোনো নিয়ামতকেই অস্বীকার করি না।” অপর বর্ণনায় এর শেষে এসেছে ‘ফালাকাল হামদ’। অর্থাৎ ‘সব প্রশংসা কেবল তোমারই’।” (তিরমিযী, হাকেম, দারে কুতনী)

এক অনুপম সত্য কথন

জিন্নদের এই উক্তি যে, “আমরা পৃথিবীতে আল্লাহকে পরাজিত করতে পারবো না, এবং পালিয়ে গিয়েও তাঁকে ব্যর্থ করতে পারবো না”-এক সরল-সহজ সত্যের সুন্দরতম প্রকাশ।

এই পৃথিবী এবং এতে বিরাজমান যাবতীয় সৃষ্টি, আকাশ, মহাকাশ, গ্রহ-নক্ষত্র, মানুষ, জিন্ন এবং এসবের মধ্যে বিরাজমান সুশৃঙ্খল সম্পর্ক ও সামঞ্জস্য স্বতঃই প্রমাণ করে এসবের একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন। এবং তিনি একজনই। কারণ একাধিক স্রষ্টা থাকলে এই সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা সৃষ্টিও হতো না, টিকতেও পারতো না।

আমরা সে স্রষ্টাকে দেখতে পারি না। কিন্তু তিনি তাঁর অস্তিত্ত্বের সত্যতা এবং মানুষ ও সৃষ্টিজগতের জন্য তাঁর ইচ্ছা-অভিপ্রায় জানান দিয়েছেন নবী-রসূলদের মাধ্যমে কিতাব নাযিল করে। মানুষ-জিন্নসহ সব সৃষ্টির সর্বোত্তম ন্যায্য ও যৌক্তিক আচরণ হবে তাদের অস্তিত্বের উৎস মহান স্রষ্টার বিধি-ব্যবস্থা মেনে নেওয়া। তা আন্তরিকতার সাথে অনুসরণ ও বাস্তবায়ন করা।

এই মহাসত্য অনুধাবন সত্ত্বেও মানুষ বিপথগামী হয়। লোভ-হিংসা-পরশ্রীকাতরতা, দুনিয়ার ভোগ-বিলাস, নফসের তাড়না ও শয়তানের ওয়াসওয়াসা মানুষকে স্রষ্টা ও তাঁর প্রতি দায়িত্ব ভুলিয়ে দেয়। মানুষ নানাভাবে স্রষ্টার প্রতি কুফরী করে।

- কেউ তাঁকে একেবারেই অস্বীকার করতে চায়, নিদেনপক্ষে এ ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করে। এরা সন্দেহবাদী। এদের সংখ্যাই বেশি।

- কেউবা একেবারে স্রষ্টাকে অস্বীকার করে। নিজেদের নাস্তিক দাবি করে। তাদের সংখ্যা একেবারেই নগণ্য। বর্তমানে তো ভিন্ন নামে প্রকৃতি, আদি ইচ্ছা/আদি কারণ নামে স্রষ্টার অস্তিত্ব মেনে নিচ্ছে।

- কেউবা স্রষ্টাকে মানে। কিন্তু সৃষ্টি করে তিনি তাঁর সৃষ্টির বিষয়ে নির্লিপ্ত হয়ে গেছেন বলতে চায়। অর্থাৎ এখানে কে কি করলো তাতে তাঁর যায় আসে না।

- আবার একদল স্রষ্টাকে মানে কিন্তু তাঁর অস্তিত্ব ও ক্ষমতায় শরীক স্থাপন করে। তাঁর স্ত্রী-পুত্র-কন্যা সাব্যস্ত করে।

- আবার কেউ আছেন স্রষ্টাকে মানেন, তাঁর দেওয়া জীবনব্যবস্থা দ্বীন ইসলামকে সত্য বলে বিশ্বাসের দাবি করেন। কিন্তু তাঁর নির্দেশ পালনে নিজ ইচ্ছা অনুযায়ী চলেন:

# ঈমান মানেন তো আমল মানেন না,
# আমল করেন তো মনগড়া,
# আমল করেন তো কেবল আনুষ্ঠানিক ইবাদাত যেমন নামায-রোজা ইত্যাদির বাইরে আল্লাহর কোনো নির্দেশ আছে মানেন না,
# কেউ নামাজ-রোজা করেন তো হালাল হারামের বিধান, পর্দা-পুশিদা মানেন না।
# কেউবা হয়তো এতটুকু মানেন কিন্তু আল্লাহর শরীয়তের বিধিব্যবস্থা মানেন না। আজকের জামানায় অচল বলতে চান।

এমনি বিভিন্ন সুরতে মানুষ মূলত সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্ তা’লার প্রতি কুফরী করে। কেউ বলতে পারেন, নামায-রোজা করা সত্ত্বেও কি কেউ কুফরী করতে পারে? দেখুন, রসূল (সা.)-এর সাহাবীরা যাকাত অস্বীকারকারীদের ব্যাপারে কি সিদ্ধান্ত নিলেন? ঐ লোকেরা কালেমা অস্বীকার করেনি, নামায-রোজা অস্বীকার করেনি, শরীয়তের অন্যান্য বিধান যেমন পর্দা-পুশিদা অস্বীকার করেনি, হারাম-হালালের বিধি অস্বীকার করেনি, কেবল একটা মাত্র বিধান অস্বীকার করায় সাহাবীরা তাদের মুমিন গণ্য করেননি। যারা নামায ও যাকাতের ব্যাপারে পার্থক্য করবে তাদের মুমিন বিবেচনা করা হয়নি। তাহলে আজকে যারা ঈমানের দাবি করেন অথচ শরীয়তের বিধান ইচ্ছামতো মানতে চান, তাদের ঈমানের অবস্থা কি বিবেচ্য। কারো প্রতি কুফরীর ফতোয়া দেওয়া আমাদের দায়িত্ব নয়। তবে প্রত্যেকের নিজের দায়িত্ব তার ঈমানের হেফাজত করা। দ্বীনের নামে মনগড়া কোনো ব্যবস্থা দুনিয়ার জীবনে তো মানলাম কিন্তু আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’লার সামনে যেদিন দাঁড়াবো সেদিন কি এ নীতি তিনি গ্রহণ করবেন? আল্লাহ্ তো জানিয়েই দিয়েছেন-

“ইসলাম আল্লাহর মনোনীত একমাত্র দ্বীন তথা জীবনব্যবস্থা।” (আলে-ইমরান ৩: ১৯)

“কেউ ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো দ্বীন তথা জীবনব্যবস্থা অনুসরণ করলে তা কখনো তার কাছ থেকে কবুল করা হবে না। এবং সে হবে আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত।” (আলে-ইমরান ৩: ৮৫)

দ্বীন ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, (মায়িদা ৫: ৩) এর আংশিক অনুসরণ প্রসঙ্গে আল্লাহপাক বলেন-

“তবে কি তোমরা কিতাবের কিছু অংশে বিশ্বাস কর এবং কিছু অংশকে প্রত্যাখ্যান কর? তোমাদের মধ্যে যারাই এরূপ কাজ করবে তাদের একমাত্র প্রতিফল দুনিয়ার জীবনে লাঞ্ছনা এবং কিয়ামতের দিন তারা কঠিনতম আযাবে নিক্ষিপ্ত হবে। তোমরা যা কর আল্লাহ্ সে বিষয়ে বেখবর নন। তারাই আখিরাতের বিনিময়ে পার্থিব জীবন ক্রয় করে, সুতরাং তাদের শাস্তি লাঘব করা হবে না এবং তারা কোনো সাহায্যপ্রাপ্তও হবে না।” (বাকারা ২ : ৮৫-৮৬)

দুনিয়ার ছলনাময় ভোগের হাতছানি, লিপ্সা-লালসা, অলীক আকাংখার মরীচিকায় মানুষ পথ হারায়। আল্লাহর প্রতি, তাঁর নির্দেশের প্রতি যথাযথ মনোযোগ দেয় না। উদাসীনতা ও উন্নাসিকতার শিকার হয়ে পড়ে। এর মোকাবেলায় জিন্নদের এই উক্তি মানুষের উপলব্ধিকে নাড়া দেয়। গাফলতিতে নিমজ্জিত মানুষের অন্তরে সচেতন হওয়ার আহবান পয়দা করে-

“দুনিয়ায় আমরা আল্লাহকে পরাজিত করতে পারবো না এবং পালিয়ে গিয়েও তাঁর হাত থেকে বাঁচতে পারবো না।”

তাই-তো। একটু দেখি সবাই। আল্লাহর কোন বিধি ব্যবস্থাটা আমরা অস্বীকার করতে পারছি? আমাদের চোখ-কান অংগ-প্রত্যংগ যার যে কাজ তিনি ঠিক করে দিয়েছেন তার বাইরে অন্য কিছু কি তা দিয়ে করতে পারছি? কে কোথায় জন্মাচ্ছি বা কোথায় মরবো তার উপর কি নিয়ন্ত্রণ আছে? আমাদের চেহারা-সুরত গায়ের ও চুলের রং প্রকৃতি ইত্যকার কোনোটির উপর আমরা নিয়ন্ত্রণ রাখি? অস্বীকার করতে পারি তাঁর দ্বীনকে যেহেতু তিনি তার অনুমতি দিয়েছেন। আমরা তাঁর দ্বীন মানি না মানি সে ব্যাপারে তিনি বেপড়োয়া। মানলে যে আমাদেরই লাভ, না মানলে ক্ষতি আমাদেরই।

এই যে তিনি আমাদের তাঁকে ও তাঁর দ্বীনকে অস্বীকার করার বা না মানার অধিকার দিলেন এতে কি প্রমাণিত হয় না যে, আমরা কোনো অবস্থাতেই তাঁর আয়ত্বের বাইরে যেতে পারবো না? দুনিয়াও তাঁর, আখিরাতও তাঁরই। দুনিয়াতেও আমরা তাঁর আয়ত্বের মধ্যে আছি। মৃত্যুর পর তাঁর কাছেই ফিরে যেতে হবে। যেকোনো সচেতন বিবেকবান মানুষ জিন্নদের এই উপলব্ধিকে গুরুত্ব সহকারে নিবেন। নিজের স্বার্থেই নিবেন। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা সৃষ্টিকর্তা বিমুখ চিন্তাধারায় আমাদের গড়ে তুলেছে। এমনকি ধর্মীয় শিক্ষার নামে যা চলছে তা-ও অনেকাংশে ঈমানী চেতনা ও উপলব্ধি সৃষ্টিতে অক্ষম। ফলে বিশ্বাসী ও আত্মসচেতন মানুষের কর্তব্য নিজের স্বার্থেই এ বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা করা। এমনকি যারা নামায-রোজা করেন তারাও গভীরভাবে ভেবে দেখবেন, আপনার সৃষ্টিকর্তার প্রতি আপনার উপলব্ধির জায়গাটা আসলে কি অবস্থায় আছে? তার গভীরতাই বা কতটুকু? নাকি সামাজিক শিক্ষা ও অভ্যাসের বসে কিছু আনুষ্ঠানিক কাজ করে যাচ্ছি আমরা?

আজ ১৫ রোজা। রোজা এল অর্ধেকটা চলেও গেল। সবাই আত্মযাচাই করি- কি কি ক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জন করতে পারলাম:

-বিশ্বাসে ও চেতনায়,
-আমলে ও অভ্যাসে,
-চরিত্র ও আখলাকে,
-সম্পর্ক ও সোহবতে,
- কুরআন-সুন্নাহর জ্ঞান চর্চা ও তার অনুসরণে,
-পরিবার ও পরিচিতদের দ্বীনের পথে সহযেগিতায়,
-দানে ও সাদাকায়,
-দ্বীনের পথে সময় ও সম্পদের ব্যবস্থাপনায়।

সবাই গভীরভাবে আত্মসমালোচনা করি। সময় চলে যাচ্ছে। সামনে কদরের অন্বেষা। মন-মগজ ও অভ্যাসে পরির্তন আনতে সচেষ্ট হই। রাতারাতি কোনো কিছু বদলে ফেলা যায় না। বড় কিছু অর্জনে বড় রকম আশা ও প্রস্তুতি জরুরি। হেলা-ফেলা না করি। সময় ব্যবস্থাপনায় মনোযোগী হই। ক্ষুদ্রতম সময়ও যেন হিসাবের বাইরে না থাকে। একান্ত জরুরি কাজ (যেমন-রিজিক অন্বেষণ, ব্যক্তিগত প্রয়োজন পূরণ, প্রয়োজনমতো বিশ্রাম, পরিবারকে দেয় সময়) এর বাইরে বাকী সময় ইবাদাত, অধ্যায়ন, যিকির, দাওয়াত ও আত্মসমালোচনায় ব্যবহার করি। মহান আল্লাহ্ আমাদের সকলের প্রচেষ্টায় বরকত দান করুন। ঈমানে গভীরতা এনে দিন, আমলে তৃপ্তি দান করুন, দান করুন দ্বীনের যথাযথ জ্ঞান। আমাদের পরিবারগুলি তিনি দ্বীনের পথে অগ্রসর করে দিন। গোটা উম্মতকে ঈমান ও ইসলামে আরো মজবুত করে দিন। বিশ্ব মানবকে হেফাজত করুন, হেদায়াত দান করুন। আমীন।।

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর