রোগমুক্তি-মনোবাসনা পূরণে ‘নিশানা’ মানত!
- Details
- by নিজস্ব প্রতিবেদক
আদিমকাল থেকেই মানুষ কোনো প্রকার অসুস্থতায় পড়লে প্রথমে নিজ নিজ ধর্ম অনুযায়ী সৃষ্টিকর্তার কাছে রোগ মুক্তি চেয়ে প্রার্থনা করেন। এর পাশাপাশি আজকের মানুষ আধুনিক চিকিৎসা সেবা পেলে পূর্ব পুরুষরা চিকিৎসা হিসেবে গাছ ও লতাপাতা থেকে নিজেদের আবিষ্কার করা ঔষধ তৈরি করে সেবন করতেন। কেউ কেউ আবার ওঝা, কবিরাজের কাছে যেতেন।
গাইবান্ধার ৪১ পীরের দরগা বা মাজারে ‘নিশান মানত পালন’
সেই বহু বছর আগে থেকেই হিন্দু-মুসলিমসহ বিভিন্ন ধর্মের মানুষ রোগ মুক্তি বা বিশেষ কোনো সমস্যা অথবা মনের ইচ্ছা পূরণের জন্য মানত করে আসছেন। কেউ কেউ মসজিদে শিরনী মানত করেন, কেউ মন্দিরে পূজা মানত করেন। মুসলিমরা গরু, ছাগল কোরবানি, আর হিন্দুরা পাঠা ( ছাগল) বলি দেন। অনেকে আবার বিভিন্ন মাজারেও গিয়ে মানত করে থাকেন।
তবে রোগমুক্তি ও মনোবাসনা পূরণের জন্য এক অদ্ভুত রকমের মানতের দৃশ্য দেখা গেছে বাংলাদেশের একটি প্রত্যন্ত গ্রামের ঐতিহাসিক এক বারুনীর মেলায়। মেলাটি প্রায় ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে উদযাপিত হচ্ছে। মেলার নাম "পীরের হাট বারুনির মেলা"।
গাইবান্ধার ৪১ পীরের দরগা বা মাজারে ‘নিশান মানত পালন’
দিনটি ছিল গত ১৬ এপ্রিল ( শনিবার)৷ ভরদুপুরে তীব্র গরমে হাজার হাজার মানুষ সেই মেলায় এসেছে। মূলত মেলায় একটি বড় মাজার রয়েছে যাকে ৪১ পীরের দরগা বা মাজার বলেন স্থানীয়রা। ওই মাজারকে ঘিরেই সরকারি খাস জমিতে মেলা বসে প্রতি বছর মেলায় বাচ্চাদের খেলনার দোকান, মাটির হাঁড়ি পাতিল, জুস, মাছ, সবজিসহ নানা ধরনের পণ্য পাওয়া যায়।
দুপুর তখন ঠিক ১২টা। হঠাৎ মেলার এক পাশের সড়কে ঢাক-ঢোলের বাজনার আওয়াজ নজর কাড়ে মেলায় আগত মানুষের। ঢাক-ঢোল বাঁশির সুরে নাচ গান করতে করতে মেলার দিকে এগিয়ে আসছেন ১০/১২ জন মানুষ। তাদের প্রত্যেকের হাতেই একটি করে বাঁশের লাঠি। লাঠির ওপরের মাথায় পাটের রশিতে প্যাচানো বিশেষ রং লাগানো ঝাড়ু।
গাইবান্ধার ৪১ পীরের দরগা বা মাজারে ‘নিশান মানত পালন’
তাদের প্রত্যেকের শরীরে নতুন একটি করে স্যান্ডো গেঞ্জি। পরনে লুঙ্গি। কিন্তু অদ্ভুত কায়দায় পড়া হয়েছে পরনের লুঙ্গি। যারা গানের সুরে ঢোলের তালে তালে নেচে যাচ্ছেন তাদের বয়স বেশির ভাগেরই ১৮ থেকে ৩০ এর মধ্যে। শুধু একজন ষাটোর্ব্ধ ব্যক্তি ছিলেন ওই দলটিতে। তিনিও সমানতালে নেচে যাচ্ছিলেন যুবকদের সাথে সাথে।
তবে অন্য সবার লাঠির থেকে ওই বৃদ্ধ লোকের হাতের লাঠিটি ছিল বিশেষ রকমের। কারণ তার পুরো বাঁশের লাঠিটি প্যাঁচানো ছিল কাফনের কাপড়ে। বিশেষভাবে তৈরি করা এই নাচের দলটি নাচতে নাচতে চলে আসে সেই বিখ্যাত ৪১ পীরের মাজারে। এরপর মাজারে আগত হাজার হাজার মানুষের ভিড়ের মধ্যেই সামান্য জায়গা করে নিয়ে নাচতে থাকেন তারা।
গাইবান্ধার ৪১ পীরের দরগা বা মাজারে ‘নিশান মানত পালন’
তখন মাজারের ভেতর থেকে চিৎকার করে এক ব্যক্তি বলেন, "নিশান এসেছে। নিশান এসেছে। প্রস্তুতি নেন।" তখন বোঝা গেল এই বাঁশের লাঠি হাতে নাচের এ দলটিকে বলা হয় "নিশান"। এরপর নিশান থেকে সেই বৃদ্ধ ব্যক্তিটি তার হাতে থাকা কাফনের কাপড়ে প্যাঁচানো লাঠিটি মাজারের ভেতর প্রবেশ করায়৷ তখন সেখানে থাকা মাজারের খাদেম তা হাত দিয়ে ধরে কিছু গরুর দুধ ঢেলে দেয়।
এরপর হঠাৎ করেই বাঁশের লাঠিটা ছেড়ে দেন তিনি। শুরু হয় আবার ঢাক-ঢোলের বাজনার তালে তালে নাচ। মাজার প্রাঙ্গণ ছেড়ে এবার নিশানের দলটি স্থানীয় পুকুরপাড়ে গিয়ে দৌড়ে দৌড়ে ঘুরতে থাকে। চলতে থাকে ঢোল বাঁশি তীব্র গতির বাজনা। বাজনার তালে নাচতে নাচতে সকলে লাঠি হাতে লাফিয়ে পড়ে পুকুরের পানিতে। ডুব দিয়ে পুকুর থেকে উঠে ভেজা শরীরে নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে যায় নিশানে অংশ নেওয়া প্রত্যেকে।
নিশানে অংশ নেওয়া সেই বৃদ্ধ লোকের সাথে কথা বলে জানা যায়, তার নাম ছালেক মন্ডল। পেশায় তিনি একজন কৃষক। তার একমাত্র নাতনীর বিয়ের ৮ বছর পরও কোনো বাচ্চা হচ্ছিল না। তাই এ মাজারে নিশান মানত করে ছিলেন তিনি। মানত করার পরের বছরই তার নাতনীর এক ছেলে সন্তান হয়েছে। সেই কারণে মানত পরিশোধ করতে মেলার দিনে নিশান নিয়ে এসেছিলেন তিনি।
বৃদ্ধ ছালেক মন্ডলের কথা শেষ না হতেই মেলার মধ্যে আবারও সেই ঢাক-ঢোল ও বাঁশির শব্দ। হাতে লাঠি নিয়ে নাচতে নাচতে প্রবেশ করছে আরও কিছু মানুষ। খুব সহজেই বোঝা গেল এবার আরও একটি নিশান এসেছে মেলার মাজারে। তারাও একইভাবে নাচতে নাচতে সকল কার্যক্রম শেষ করে ঝাপিয়ে পড়লেন পুকুরের পানিতে।
এবার সেই নিশানে অংশ নেওয়া লাভলু মিয়ার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, "আসলে এই নিশান-টা হলো একটা বিশ্বাস। আমার ছেলের পেটে বড় অসুখ হইছিল। দিন-রাত পেটের ব্যথার চিৎকার করে কান্নাকাটি করতো। অনেক ডাক্তার কবিরাজ দেখাইছি। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। পরে এই মাজারে এসে ছেলের জন্য নিশান মানত করেছিলাম। এরপরই ছেলের পেটের ব্যথা ভালো হয়েছে। তাই মানত শোধ করতে নিশান নিয়ে মেলায় আইছি।"
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, গাইবান্ধা জেলার সাদুল্যাপুর উপজেলার ৬ নং ধাপের ইউনিয়নের তিলক পাড়া গ্রামে এই "৪১ পীরের মাজার"৷ অনেকে আবার এই স্থানকে "পীরের হাট" বলেও ডাকেন। স্থানীয়দের মতে, এখানে ৪১ জন পীরের কবর রয়েছে। আর মাজারটি হঠাৎ মাটি উঁচু হয়ে এক রাতে বের হয়েছে। সেই রাতেই মাজারে ঠিক পেছনে একটি পুকুরও অলৌকিকভাবে খনন হয়েছে।
এই মাজার এলাকায় রয়েছে শত বছর বয়সী ৫টি বিশাল আকৃতির বট গাছ। অত্র এলাকা ছাড়াও আশপাশের জেলা থেকে প্রতিদিন বহু মানুষ এই মাজার দেখতে আসেন। কেউ কেউ নিজেদের বিশ্বাস মতে এখানে মানত করেন। এরপর তাদের রোগমুক্তি, মনোবাসনা পূরণ হলে তারা এখানে শিরনী পোলাও রান্না করে মানুষকে খাওয়ান।
এই মাজার উপলক্ষেই প্রতি বছরের বৈশাখের প্রথম শনিবার বসে দিনব্যাপী মেলা। উপজেলা প্রশাসনের সহায়তায় সারাদিন হাজার হাজার মানুষ মেলায় অংশ নেয়। মেলার দিনে যেকোনো অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে বিকেল ৫টার মধ্যেই পুলিশ প্রশাসন মিলে মেলা শেষ করে দোকান-পাট তুলে দেয়।
গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...
খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর
Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.
Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.