টিকিট কাউন্টারে শুধুই হাহাকার, একটা সিট দেন ভাই!

গতকাল বৃহস্পতিবার রাত ১১টা। গাবতলী এলাকার একটি বাস কাউন্টারে হাজার হাজার মানুষের ঠেলাঠেলির ভিড়ে সামনে এগোতে পারছেন না ৫৫ বছরের মকবুল হোসেন৷ অনেক কষ্টে দাঁড়িয়ে রইলেন কাউন্টার ম্যানেজারের চেয়ারের সামনে।

টিকিট কাউন্টারে শুধুই হাহাকার

মিনিটখানেক পর চোখ তুলে একবার তাকালেন কাউন্টার ম্যানেজার। মকবুলের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করলেন তিনি। মনে হচ্ছিল, বৃদ্ধ মকবুল একজন আসামি আর টিকেট কাউন্টারে বসা ম্যানেজার একজন বিচারক।

আসামির মতোই আকুতির সুরে মকবুল বললেন, ‘একটা সিট হবে বাবা?’ উত্তরে ‘নাই নাই যান’ বলেই ইশারায় মকবুলকে চলে যাওয়ার ইংগিত দিলেন কাউন্টার ম্যানেজার। কিন্তু আবারও অনুরোধের সুরে মকবুল বললেন, দেখেন না বাবা, হয় কি না একটা সিট। এবার রেগেমেগে চিৎকার করে উঠলেন কাউন্টার ম্যানেজার, ‘বললাম তো সিট নাই, যান।’

অসহায় দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে কাউন্টারের সামনে থেকে এসে মুল সড়কে দাঁড়িয়ে পড়লেন বৃদ্ধ মকবুল।

দুই হাতে কাপড়ের ছোট দুুটি ব্যাগ। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, পরিবারে জন্য কিছু ঈদের পোশাক কিনেছেন। রাস্তায় দাঁড়িয়েই কথা হয় বৃদ্ধ মকবুল হোসেনের সাথে।

তিনি বলেন, ‘আমার বাড়ি রংপুরের তারাগঞ্জে। ঢাকার মোহাম্মদপুরে একটি কোম্পানিতে সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি করি। আজ (বৃহস্পতিবার) ডিউটি শেষ করে ছুটি পাইছি। ঈদের পরদিন আবার এসে ডিউটিতে জয়েন করতে হইবো। তাই রাতের বাসে বাড়ি যাইতে পারলে ছেলেমেয়ে নাতি-নাতনীগুলো অনেক বেশি খুশি হইতো। এত চেষ্টা করলাম, কিন্তু টিকিট পাইলাম না।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমি বুড়া মানুষ, মোবাইল ইন্টারনেট বুঝি না। এখন নাকি মোবাইল ইন্টারনেটে টিকিট কিনতে হয়। এসব তো পারি না বাবা। দেখি, কোনো লোকাল বাসে যদি কোনো রকমে উঠতে পারি। বাড়ি পৌঁছাতে পারলেই শান্তি।’

ওই বাস কাউন্টারের সামনেই রাস্তার ওপর ৩টি ব্যাগ নিয়ে বসে আছেন আপেল মিয়া। তিনিও উত্তরের জেলা কুড়িগ্রামের যাত্রী। অগ্রীম টিকিট কিনতে পারেননি৷ তবুও আশা নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে বের হয়েছেন। যদি একটা সিট পেয়ে যান তাহলেই চলে যাওয়া যাবে গ্রামের বাড়িতে। রাত ৯টা থেকে ১১টা পর্যন্ত ২ ঘণ্টা ধরে খুঁজেও একটা সিট ম্যানেজ করতে পারেননি তিনি।

শুধু মকবুল হোসেন ও আপেল মিয়া নন, এমন হাজারো মানুষ গ্রামের বাড়িতে ঈদ করতে ঢাকার বাস কাউন্টারগুলোতে সিটের জন্য ছোটাছুটি করছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর গাবতলী, কল্যাণপুর, শ্যামলী ও আসাদ গেট এলাকার বাস কাউন্টারগুলোতে ঘুরে এমন দৃশ্য চোখে পড়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘করোনা পরবর্তী এবার ঈদে বহু মানুষ ঢাকা ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে ঈদ করতে যাচ্ছেন। যাত্রীর তুলনায় যানবাহনের সংখ্যা বাড়েনি। তাই বেশি যাত্রীর চাপে তাদের বরাদ্দকৃত টিকিট অগ্রীম বিক্রি হয়ে গেছে। সে কারণে যাত্রার দিনে কোনো বাসের সিট দেওয়া অসম্ভব।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাব মতে, এবারের ঈদে ঢাকা থেকে এক কোটিরও বেশি মানুষ দেশের বিভিন্ন জেলায় যাতায়াত করবে। এছাড়াও এক জেলা থেকে অপর জেলায় আরো প্রায় ৫ কোটি মানুষ যাতায়াত করতে পারে। গ্রামের বাড়ি যাতায়াতসহ নানা কারণে দেশের বিভিন্ন শ্রেণির পরিববহনে বাড়তি প্রায় ৬০ কোটি ট্রিপ যাতায়াত হতে পারে।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী জানান, এবারের ঈদযাত্রায় রাজধানীবাসী সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়বে। তাই এই মূহুর্ত থেকে রাজধানীবাসীর ঈদযাত্রার ভোগান্তি কমাতে সরকারের সংশ্লিষ্টদের কাছে জোর দাবি করেছেন তিনি।

বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক ড. হাদিউজ্জামান এক জরিপের ভিত্তিতে বলেছেন, ২৫ রমজান থেকেই গ্রামের বাড়িতে যাওয়া প্রায় ১৬ লক্ষ যাত্রীর গণপরিবহন সংকট দেখা দিবে। তাই পরিবারের সদস্যদের সব সময় ঈদের ছুটি শুরু হওয়ার আগেই বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।