শ্রীলঙ্কা সংকট: যেভাবে নায়ক থেকে খলনায়ক রাজাপাকসেরা

দেশ যারাই চালাক, আমাদের সাধারণ মানুষের মৌলিক চাহিদা তো মেটাতে হবে। আমার দুটি বাচ্চা আছে, পরিবার আছে। তাদের তো বাঁচাতে হবে। রাজনীতিকদের তো অনেক সম্পদ, তারা কোনোভাবে টিকে যাবেন। কিন্তু আমরা তো বাঁচবো না, আমাদের পরিবার তো বাঁচবে না।

সুসময়ে দুই রাজাপাকসে

কথাগুলো শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোর এক বাসিন্দা চান্দানি মানেলের। কথাগুলো সাদামাটা মনে হলেও মূলত এই সাধারণ বিষয়গুলোই শ্রীলঙ্কার এতদিনের নায়কদেরকে খলনায়ক বানিয়ে ছেড়েছে।

সদ্য পদত্যাগী প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে সম্পর্কে বলতে গিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক কুশল পেরেরা বলছিলেন, স্বাধীনতা উত্তর শ্রীলঙ্কায় তিনি ছিলেন সবচেয়ে জনপ্রিয় সিংহলি বৌদ্ধ নেতা। অনেকে তো তাকে সম্রাট মাহিন্দা বলেও প্রশংসা করতো।

সরকারে থাকা রাজাপাকসে পরিবারের সদস্যরা

পার্লামেন্টের একজন বিরোধী নেতা থেকে তিনি প্রধানমন্ত্রী হন ২০০৪ সালে। এক বছর পর তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে শুরু করেন। তখন তিনি তার ছোট ভাই গোতাবায়া রাজাপাকসেকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর দায়িত্ব দেন। মূলত এর মাধ্যমেই রাজনৈতিক উত্থান হয় গোতাবায়ার।

১০ বছরের বেশি সময় ধরে প্রেসিডেন্ট থাকাকালে ২০০৯ সালে তামিল বিদ্রোহীদের নির্মমভাবে দমনের মাধ্যমে তিন দশক ধরে চলা গৃহযুদ্ধের সমাপ্তি টেনেছিলেন মাহিন্দা রাজাপাকসে। এর মাধ্যমে একসময় শ্রীলঙ্কার সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলি জাতিগোষ্ঠীর কাছে বীর নায়কে পরিণত হন মাহিন্দা রাজাপাকসেসহ পুরো রাজাপাকসে পরিবার। ধীরে ধীরে সরকারে যোগ দেয় রাজাপাকসে পরিবারের আরো সদস্য ও আত্মীয় স্বজন।

মাহিন্দা রাজাপাকসে স্বল্প মেয়াদে হলেও তিন দফা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। অন্যদিকে একটানা প্রেসিডেন্ট ছিলেন টানা ১০ বছরের বেশি সময়। শেষবারে আবারো গুছিয়ে বসেছিলেন মাহিন্দা-গোতাবায়া রাজাপাকসেরা। প্রেসিডেন্ট হিসেবে ছোট ভাই ৭২ বছর বয়সী গোতাবায়া রাজাপাকসে এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ৭৬ বছর বয়সী বড় ভাই গোতাবায়া রাজাপাকসে। সরকারে-পার্লামেন্টে ছিল আরো কিছু রাজাপাকসে। সব মিলিয়ে বলতে গেলে চাঁদের হাঁট।

কিন্তু করোনা এবং ইউক্রেন যুদ্ধ তাদের এতদিনের সাজানো সাম্রাজ্য যেন একেবারে দুমড়ে মুচড়ে দিলো। অর্থনৈতিক সমস্যার জেরে একসময় প্রকাশ পেল ভেতরে ভেতরে দেউলিয়া হয়ে গেছে এ দ্বীপরাষ্ট্রটি। খাবারের টাকা নেই, জ্বালানির টাকা নেই। নেই পড়াশোনা বা চিকিৎসা চালানোর টাকাও। ফলে এতদিনের নায়কেরা জনগণের দৃষ্টিতে ধীরে ধীরে নিচে নামতে শুরু করেন। জনগণও ধীরে ধীরে যেন জাগতে শুরু করে। তাদের ঠেকাতে নামানো হয় সেনাবাহিনী, জারি করা হয় জরুরি আইন, কারফিউ।

কিন্তু কিছুই সাধারণ লঙ্কানদের আটকে রাখতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত তাদের দাবির মুখে মাহিন্দা রাজাপাকসে পদত্যাগ করেন। তারপরও ক্ষুব্ধ জনগণ যখন তাদের বাড়ি ঘেরাও করে বাড়ি গাড়িতে আগুন দিতে শুরু করে, তখন বাধ্য হয়ে নৌ-ঘাঁটিতে আশ্রয় নেন মাহিন্দা রাজাপাকসে। এতেও অবশ্য আন্দোলনকারীদের আন্দোলন শেষ হয়নি। এখন তারা চান প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের পদত্যাগ।

দীঘ ২০ বছর ধরে যে ইমেজ তারা গড়ে তুলেছিলেন, মাত্র কয়েক মাসে তা ধুলিস্যাৎ হয়ে গেছে। শ্রীলঙ্কার এখন যে পরিস্থিতি তাতে তারা আর পূর্বের অবস্থানে ফিরতে পারবেন বলে মনে হয় না। পুরো চিত্রটা তাই সিনেমাটিক মনে হচ্ছে। নায়ক থেকে খলনায়ক। একা নয় পুরো পরিবার।

মহামারির পর ইউক্রেন যুদ্ধ, এই যুগলের ধাক্কায় আবার কখন কোথায় উইকেটের পতন হয়, সেই ভয়েই আছেন বিশ্ব শাসকেরা।

বিবিসি অবলম্বনে