ভীষণ বেকায়দায় পড়েছে ইউক্রেনীয় বাহিনী

যুদ্ধক্ষেত্রে কঠিন পরিস্থিতিতে পড়েছে ইউক্রেনীয় বাহিনী। কৌশলগত বিচারে গুরুত্বপূর্ণ শহর সিভিয়ারোডোনেৎস্কে কয়েক হাজার ইউক্রেনীয় সৈন্যকে ঘেরাও করে ফেলার চেষ্টা চালাচ্ছে রুশরা। মারিওপোলের আজভস্টালে অবরুদ্ধ হয়ে আড়াই হাজার সৈন্যের আত্মসমর্পণের পর একই ধরনের ঘটনার পুণরাবৃত্তির আশঙ্কা করছেন ইউক্রেনের সেনা কর্মকর্তারা।

সিভিয়ারোডোনেৎস্কে ইউক্রেনীয় বাহিনীকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করছে রুশরা

জানা গেছে, সিভিয়ারোডোনেৎস্কের উত্তরে রুবিঝনি, উত্তর-পশ্চিমে ক্রাসনি লিমান শহর শুক্রবার রুশ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে গেছে। দুটি শহর থেকে সরে গিয়ে ইউক্রেনীয়রা সিভিয়ারোডোনেৎস্কে প্রতিরোধ জোরদারের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু এরইমধ্যে দক্ষিণে পোপাসনা শহর থেকে এগোতে থাকা চেচেন স্পেশাল ফোর্সেসের একটি দল সিভিয়ারোডোনেৎস্ক শহরে ঢুকে পড়ে। এ অবস্থায় ইউক্রেনীয় বাহিনীর বড় অংশটি পিছু হটে শহরের বাইরে শিল্পাঞ্চলে অবস্থান নিয়েছে।

শহরের কেন্দ্র ছেড়ে শিল্পাঞ্চলে সৈন্যদের সরে যাওয়া ইউক্রেনে অনেকের মনে মারিওপোলের বেদনাময় স্মৃতি জাগিয়ে তুলেছে। দক্ষিণাঞ্চলীয় বন্দরনগরী মারিওপোলে যুদ্ধে কোনঠাসা হয়ে ইউক্রেনীয় সৈন্যরা আজভস্টাল কারখানায় অবস্থান নিয়েছিল। দীর্ঘদিন সেখানে অবরুদ্ধ থেকে একপর্যায়ে তারা রুশ বাহিনীর কাছে শর্তহীন আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।

ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী সূত্রের বরাতে স্থানীয় সাংবাদিকরা জানান, সিভিয়ারোডোনেৎস্ক ও আশপাশে মোতায়েন ইউক্রেনীয় বাহিনীকে ঘিরে ফেলতে রুশ সৈন্যরা সেভেরস্ক ও বেরেস্তভো জেলায় আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ অবস্থায় রুশদের বেষ্টনী গড়ার চেষ্টা ঠেকাতে বাখমুত ও সিভিয়ারস্ক এলাকায় অতিরিক্ত সৈন্য পাঠানোর চেষ্টা করছে ইউক্রেন। সেটা ঠেকাতে লিসিচান্ক-সোলেদার মহাসড়কে অবিরাম গোলাবর্ষণ করছে রুশ ও সহযোগী বাহিনী।

চেচেন নেতা রমজান কাদিরভ দাবি করেছেন, সিভিয়ারোডোনেৎস্ক শহরে রুশ বাহিনী পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। শহরের ৭০ ভাগ এলাকা থেকে ইউক্রেনীয় বাহিনীর পুঁতে রাখা মাইন অপসারণ সম্পন্ন হয়েছে বলেও তিনি সামাজিক মাধ্যমে এক পোস্টে জানান।

এদিকে খেরসন অঞ্চল পুনর্দখলে ইউক্রেনীয় বাহিনীর চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। রোববার সন্ধ্যায় দাভিদভ ব্রদ এলাকায় অগ্রসর হতে গিয়ে ইউক্রেনের একটি স্ট্রাইক ফোর্স রুশ বাহিনীর ভারি গোলাবর্ষণের কবলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে। এ অভিযানে ইউক্রেনের অন্তত দুইশত সৈন্য নিহত হয়েছে বলে রুশ সূত্রগুলোর বরাতে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে।

এছাড়া নিকোলায়েভ থেকে ক্রিভয় রজ ও নিকোপলের পথেও ইউক্রেনীয় বাহিনী খেরসনের দিকে এগোনোর চেষ্টা করছে। খেরসনে মোতায়েন রুশ বাহিনী অগ্রসরমান ইউক্রেনীয় সৈন্যদের কভার দিতে নিয়োজিত একটি সুখোই-২৫ জঙ্গীবিমান গুলি করে ভূপাতিত করেছে।

উপর্যুপরি প্রাণহানির কারণে জনবল সংকটে ভূগছে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী। স্থানীয় ব্লগাররা জানাচ্ছেন, জনবল সংগ্রহে মরিয়া হয়ে ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর রিক্রুটমেন্ট কমিশাররা খারকিভ, লভিভ ও অন্যান্য পশ্চিমাঞ্চলীয় শহরে যে কোনো তরুণকে প্রকাশ্যে দেখতে পেলেই সেনাবাহিনীর সমন ধরিয়ে দিচ্ছেন। অনলাইনে পাওয়া বেশকিছু ভিডিওতে ইউক্রেনীয় সেনা কমিশারদের পেট্রোল স্টেশন ও সুপার স্টোরে যাওয়া ক্রেতাদের হাতে সমনের টিকেট তুলে দিতে দেখা গেছে।

সমরাস্ত্র ও রসদ সরবরাহ বৃদ্ধির আবেদন জানিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ইউক্রেনের সৈন্যদের ভিডিও বার্তা প্রেরণের প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় এ ধরনের ভিডিও নিষিদ্ধ করে বিশেষ আদেশ জারি করেছে কিয়েভের সেনাসদর। এছাড়া যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে যাওয়া সৈন্যদের সাজার মেয়াদ বৃদ্ধি ও সম্পদ বাজেয়াপ্তের বিধান রেখে ইউক্রেনের পার্লামেন্টে আইন প্রণয়নের আহ্বান জানিয়েছে সেনাবাহিনী।

যুদ্ধরত সৈন্যদের মনোবল চাঙ্গা করতে রোববার খারকিভের রণাঙ্গন সফর করেছেন ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। তিনি সেখানে কর্মকর্তা ও সৈনিকদের সঙ্গে সময় কাটিয়েছেন। খারকিভে থাকাবস্থায় এক আদেশে ইউক্রেনের গোয়েন্দা সংস্থার (এসবিইউ) প্রধানকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেছেন জেলেনস্কি।

খারকিভ অঞ্চলে ইউক্রেনীয় বাহিনী গতকাল ও আজ রুশদের নিয়ন্ত্রণাধীন কয়েকটি এলাকায় হামলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। বিশেষত তেরনভোয়া এলাকায় রুশ অবস্থানে ইউক্রেনীয়রা অব্যাহতভাবে মেশিনগানের গুলি ছুঁড়ছে। খারকিভের হাসপাতালগুলোতে বিপূল সংখ্যক যুদ্ধাহত সৈন্য ভর্তি হয়েছে বলে স্থানীয় সাংবাদিকরা জানিয়েছেন। রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিংয়ে জানা গেছে, রুশ বাহিনী দূর পাল্লার ভিকেএস মিসাইল খারকিভে একটি রাডার স্টেশন ধ্বংস করেছে।

এদিকে দীর্ঘদিন বিরতির পর ইউক্রেনীয় বাহিনী গতকাল আবারো দোনেৎস্কে ভারী গোলাবর্ষণ করেছে। বাদিনভস্কি, গোরলভকা ও কালিনভস্কি জেলার আবাসিক এলাকাগুলোতে ইউক্রেনীয় বাহিনী ১৫২ মিমি ও ১৫৫ কিমি কামানের গোলাবর্ষণ করে বলে রাশিয়া-সমর্থিত ডিপিআর কর্তৃপক্ষ অভিযোগ করেছে। ইউক্রেনীয় গোলাবর্ষণে কমপক্ষে ৪ জন নিহত ও ২০ আহত হয় বলে ডিপিআর কর্মকর্তারা জানান।

ইজিয়ুম সেক্টরে রুশ বাহিনী কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ সভিয়াতগোরস্ক শহরের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা চালালেও সুবিধা করতে পারছে না। স্লভিয়ানস্ক ও রায়গোরদক এলাকায় ইউক্রেনীয় অবস্থান লক্ষ্য করে গোলাবর্ষণ করছে রুশরা।

ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী আনা মালিয়ার বলেছেন, শত্রুপক্ষ নানাদিক থেকে আমাদের সৈন্যদের অবস্থানে হানা দিচ্ছে। সামনে অত্যন্ত কঠিন ও দীর্ঘ লড়াই আসছে। অন্যদিকে ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা ওলেক্সি আরেস্টোভিচ বলেছেন, যুদ্ধক্ষেত্রে আমাদের একেকজন সৈন্যের বিপরীতে দখলদার বাহিনীর সাতজন করে সৈন্য রয়েছে। জার্মানিসহ কয়েকটি দেশের সরকার ভারী অস্ত্র সরবরাহে কালক্ষেপণের মাধ্যমে পরিস্থিতির অবনতি ঘটাচ্ছে।