বেতনের পুরো টাকাই দান করে দিলেন সেই মুসলিম চিকিৎসক
- Details
- by আন্তর্জাতিক ডেস্ক
ডাক্তার শাফি শিহাবউদ্দিন। শ্রীলঙ্কার জনপ্রিয় প্রসূতিবিদ্যা ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ। ২০১৯ সালে মিথ্যা অভিযোগে তাকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়। কেবলমাত্র মুসলিম পরিচয়ের কারণে একের পর এক ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় আসামি করা হয়। দীর্ঘ ভোগান্তি শেষে তিনি নির্দোষ প্রমাণ হয়েছেন ও জামিন পেয়েছেন। উচ্চ আদালতে আপিল করে আদায় করেছেন তিন বছরের বকেয়া বেতন ২৬ লাখ ৭৫ হাজার ৮১৬ রুপিয়া। এরপর পুরো অর্থ দান করে দিয়েছেন দেশের মানুষের জরুরি ওষুধ ক্রয়ের জন্য।
২০১৯ সালের ২৩ মে ডাক্তার শাফি শিহাবউদ্দিনকে গ্রেপ্তার করে শ্রীলঙ্কা সিআইডি
শ্রীলঙ্কার উত্তরাঞ্চলীয় করুনাগেলে শহরের টিচিং হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন ডাক্তার শাফি। চিকিৎসায় হাতযশ, শিক্ষক হিসেবে সাফল্য, সরকারি চাকরি, পাশাপাশি প্রাইভেট প্র্যাকটিসসহ সব মিলিয়ে ছিলেন দারুণ বন্ধু বৎসল, সদা হাস্যমুখ।
করুনাগেলে হাসপাতালেই কর্মরত ছিলেন ডাক্তার শাফির চিকিৎসক স্ত্রী। সন্তানরা পড়াশোনা করছিল স্থানীয় নামী স্কুলে। সুখ, সম্মান ও সমৃদ্ধি কোনোটিরই কমতি ছিল না জীবনে। কমতি ছিল না ঈর্ষান্বিত মানুষেরও। পেশাগত সাফল্য ও সামাজিক সম্মানের কারণে ঈর্ষাকাতর সহকর্মীর রোষানলে ছিলেন তিনি। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ হয়েও সাফল্য ও সম্মানের পাত্র হওয়ায় একইভাবে চক্ষুশূল হয়েছিলেন সাম্প্রদায়িক রাজনীতির।
এরপর আসে ২০১৯ সাল। সে বছর এপ্রিলে ইস্টার সানডের সময় কলম্বোতে হয় রক্তক্ষয়ী হামলা। শ্রীলঙ্কার সাধারণ মানুষের পাশাপাশি নিন্দায় মুখর হয় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। এদিকে পরের বছরই শ্রীলঙ্কায় ঘনিয়ে আসছিল সাধারণ নির্বাচন। তারই প্রস্তুতি হিসেবে চাঙ্গা করা দরকার ছিল রাজাপাকসে পরিবারের ভোট ব্যাংক হিসেবে পরিচিত সিংহলি শ্রেষ্ঠত্ববাদের হুজুগ। কলম্বোতে ন্যাক্কারজনক হামলা সেই সুযোগ সামনে এনে দেয়।
ইস্টার সানডের ঠিক এক মাসের মাথায় শ্রীলঙ্কার একটি সংবাদমাধ্যমে ছাপা হয় চাঞ্চল্যকর এক প্রতিবেদন। করুনাগেলে হাসপাতালে কর্মরত ‘বিশেষ সম্প্রদায়ভূক্ত’ একজন গাইনি চিকিৎসক অস্ত্রোপচারের সময় ইচ্ছাকৃতভাবে ফ্যালোপিয়ান টিউবে চাপ দিয়ে কয়েক হাজার সিংহলি নারীর দ্বিতীয়বারের মতো সন্তান ধারণের সম্ভাবনা বন্ধ করেছেন বলে অজ্ঞাত সূত্রের বরাতে ওই প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়।
এটুকুই দরকার ছিল। একটি দায়িত্বহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রতিবেদনকে পুঁজি করে মঞ্চে নামেন রাথানা থেরো নামের একজন প্রভাবশালী বর্ণবাদী সিংহলি ধর্মযাজক, যিনি পূর্ববর্তী বছরগুলোতে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের উপর নিপীড়ন ও জাতিগত শুদ্ধি অভিযানকে সমর্থন করে উপর্যুপরি বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে পরিচিতি পেয়েছিলেন। বিশেষ সম্প্রদায়ের চিকিৎসকের বিরুদ্ধে এমন গুরুতর অভিযোগের খবর সামনে রেখে তিনি হাওয়া দিতে থাকেন সাম্প্রদায়িক উসকানির পালে। বলা হয়, ডাক্তার শাফিই সেই চিকিৎসক।
সুযোগ নিতে কালবিলম্ব করেনি রাজাপাকসে পরিবারের শ্রীলঙ্কা পড়–যোজনা পার্টির (এসএলপিপি) নেতারাও। রাথানা থেরোর পিছে পিছে মাঠে নামেন সারাথ বীরবান্দেরা, চান্দানা কান্দানগামুয়া, করুনাগেলের মেয়র তুষারা সঞ্জীভা, চান্না জয়াসুমানা প্রমুখ এসএলপিপি নেতা। একের পর এক চাঞ্চল্যকর অভিযোগ সামনে আসতে থাকে। ডাক্তার শাফি ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ব্যবসা করেন, বন্ধুদের সঙ্গে রিয়েল এস্টেটে বিনিয়োগ করেছেন এমনকি জঙ্গী গোষ্ঠীর সঙ্গেও তার যোগাযোগ আছে আরও কত কি! নির্বাচনের আগে এমন মেরুকরণ না হলে কি ভোট ব্যাংক সংহত হয়?
দেখতে দেখতে এক হাজার নারীর স্বাক্ষর সংগ্রহ হয়। সবারই অভিযোগ, ওই চিকিৎসক তাদের দ্বিতীয়বারের মতো মা হবার সুযোগ বন্ধ করেছেন। অপারেশন থিয়েটারে অন্যান্য ডাক্তার, নার্স, স্টাফের সামনে কোনো চিকিৎসকের পক্ষে নাশকতামূলক কিছু করা সম্ভব কিনা, অথবা ফ্যালোপিয়ান টিউব চাপ দিয়ে বন্ধ্যাকরণ আদৌ সম্ভব কিনা, সে সব জানার দরকার বোধ করেনি কেউ। শ্রীলঙ্কার দৈনিক মর্নিংয়ের সম্পাদকীয় পর্ষদের ভাষায় যা ছিল স্রেফ গণ উম্মোদনা বা ম্যাস হিস্টেরিয়া।
ডাক্তার শাফির সহকর্মীরা সাক্ষ্য দিয়েছেন তার পক্ষে। সবাই বলেছেন, অস্ত্রোপচারের পক্ষে এমন কিছু করা সম্ভব নয়। তারপরও কে শোনে কার কথা? রাজনীতির জন্য দরকার শিকার। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কৃতি ব্যক্তির চেয়ে ভালো শিকার আর কে হতে পারে!
অভিযোগ ওঠার পরপর ডাক্তার শাফিকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়। কয়েকদিনের মধ্যে তাকে গ্রেপ্তার করে শ্রীলঙ্কা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। শুরু হয় একের পর এক রিমান্ড ও নিত্যনতুন মামলা। এটুকুতে শেষ হলেও কথা ছিল। ডাক্তার শাফির পরিবারের উপর নেমে আসে সামাজিক বয়কট। বাড়ি ছাড়তে বাধ্য করা হয়। নতুন কেউ তাদের কাছে বাড়ি ভাড়া দিতে অস্বীকৃতি জানায়। সন্তানদের স্কুল ছাড়তে হয় বেশ কয়েকবার। বাধ্য হয়ে তার স্ত্রীকে ওই হাসপাতাল থেকে বদলি হয়ে যেতে হয় অন্যত্র। করুনাগেলে ছেড়ে দেড়শ কিলোমিটার দূরের এক শহরে বাসা ভাড়া নিতে বাধ্য হয় ওই পরিবার। একই পরিস্থিতির শিকার হতে হয় ডাক্তার শাফির আত্মীয় ও শ্বশুর পক্ষের মানুষদের।
দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ ও শত শত সাক্ষীর জবানবন্দি শেষে শ্রীলঙ্কা সিআইডি জানায়, ডাক্তার শাফির বিরুদ্ধে উত্থাপিত কোনো অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি। তাহলে এমন চাঞ্চল্যকর খবর এলো কোথা থেকে? খোঁজ নিয়ে জানা যায়, করুনাগেলে শহরের দায়িত্বে নিয়োজিত ডিআইজি ডাক্তারের বিরুদ্ধে প্রকাশিত খবরটির উৎস। এরপর ওই ডিআইজির জবানবন্দি নেয় সিআইডি। জবানবন্দিতে তিনি জানান যে ডাক্তারের বিরুদ্ধে এমন গুজব রয়েছে বলে তিনি এক সাংবাদিককে জানিয়েছিলেন। বাকিটা ইতিহাস। একটি ভিত্তিহীন খবর আর একটি রক্তলোলুপ রাজনৈতিক প্রচারণায় তছনছ হয়ে গেছে একজন সফল, সমাজহিতৈষী মানুষের জীবন।
জেল থেকে মুক্তির পর ডাক্তার শাফি দেখেন পরিবারের উপর ভীষণ আর্থিক দুর্দশা নেমে এসেছে। একের পর এক বাসস্থান, কর্মস্থল ও স্কুল-কলেজ পরিবর্তন করতে গিয়ে আর সামাজিক বয়কটে জেরবার হয়ে গেছে তার পরিবার। নিজের পাওনা বেতনের জন্য তিনি ধরনা দেন কর্মস্থলে। শ্রীলঙ্কার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তার বেতন আটকে দেয়।
এ অবস্থায় ২০২১ সালের জুলাইয়ে তিনি বেতন আদায়ের জন্য শ্রীলঙ্কার আদালতের শরনাপন্ন হন। দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে উচ্চ আদালতে আপিল করে নিজের প্রাপ্য আদায়ে সমর্থ হয়েছেন তিনি। শ্রীলঙ্কার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গতকাল তার কাছে বকেয়া বেতন, পারিতোষিক ও ভাতা বাবদ ২৬ লাখ ৭৫ হাজার ৮১৬ রুপি ৪৮ পয়সার চেক হস্তান্তর করেছে। চেকটি আবার মন্ত্রণালয়ের কাছে হস্তান্তর করে তিনি বলেছেন, দেশের অর্থনৈতিক এ দুর্যোগে বিপন্ন মানুষের প্রয়োজনীয় ওষুধ সামগ্রী কেনার জন্য যাতে ওই অর্থ ব্যয় করা হয়।
অভাবনীয় এ বদান্যতার পর শ্রীলঙ্কায় আবারও টক অব দ্য কান্ট্রিতে পরিণত হয়েছেন এ মিষ্টিভাষী মুসলিম চিকিৎসক। সানডে টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ডাক্তার শাফি বলেছেন, ‘কেবলমাত্র আল্লাহর রহমত এবং রোগীদের দোয়া আমাকে বাঁচিয়েছে।’ সামাজিক মাধ্যমেও শ্রীলঙ্কানরা ঘুরেফিরে তাকে নিয়েই আলোচনা করছে। সংবাদ পোর্টাল ইকোনমি নেক্সটের ডেপুটি এডিটর হিমাল কোটেলাভালা লিখেছেন- ‘এই নিষ্ঠুর দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় চড়টি দিলেন ডাক্তার শাফি। সত্যিকারের বস মানুষ তিনি।’
পরিবেশবাদী সংগঠক প্রসাদ ওয়েলিকুম্বুরা লিখেছেন- ‘কোনো চেক আর সেই আত্মত্যাগী, স্বতস্ফুর্ত ডাক্তারকে ফিরিয়ে আনতে পারবে না।’ আইনজীবী সুরেন ফার্নান্দো লিখেছেন- ‘নিঃসন্দেহে মহৎ কাজ করেছেন ডাক্তার। কিন্তু যারা তার বিরুদ্ধে মিথ্যা রটনা ছড়িয়েছে, যারা বর্ণবাদ ও ঘৃণা উদগীরক বক্তব্য প্রচার করেছে, তারা কি ক্ষমা চাইবে না? তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে না?’
শ্রীলঙ্কার বিরোধী দলীয় নেতা সাজিথ প্রেমাদাসা লিখেছেন- ‘ডাক্তার শাফির ঘটনা প্রমাণ করে যে ধর্মীয় উগ্রবাদের পেছনে আসলে কোনো ধর্ম নেই, আছে শুধু ঈর্ষা ও হীনমন্যতা। পুরো বিষয়টির যে জবাব তিনি আজ দিয়েছেন, সেটা সত্যিই প্রেরণাদায়ক। আমরা তার মহত্বকে অভিবাদন জানাই। তার প্রেরণা থেকেই আমরা তার দানকৃত অর্থের সম পরিমাণ অনুদান হুসমা তহবিলে যোগ করব।’
গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...
খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর
Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.
Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.