কালিনিনগ্রাদ ট্রানজিট নিয়ে রাশিয়া-ন্যাটো সংঘাতের আশঙ্কা

লিথুয়ানিয়া সরকার সে দেশের ট্রানজিট ব্যবহার করে রাশিয়ার কালিনিনগ্রাদ ছিটমহলে পণ্য পরিবহনে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। মস্কোর কর্মকর্তারা এ পদক্ষেপকে রাশিয়ার সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের শামিল অভিহিত করে দেশটির বিরুদ্ধে দ্রুত ও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার হুমকি দিয়েছেন। ন্যাটোর সদস্য লিথুয়ানিয়ার সঙ্গে সম্পর্কে এ উত্তেজনা পশ্চিমা সামরিক জোটটির সঙ্গে রাশিয়ার সংঘাতের আশঙ্কা বাড়িয়ে তুলেছে।

কালিনিনগ্রাদ ট্রানজিট ব্যবহারে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে লিথুয়ানিয়া

বাল্টিক সাগরের তীরবর্তী রুশ ছিটমহল কালিনিনগ্রাদে প্রয়োজনীয় সামগ্রীর প্রায় অর্ধেক রাশিয়া থেকে রেলপথে লিথুয়ানিয়ার ভূখণ্ড হয়ে সরবরাহ করা হয়। এ বিষয়ে রাশিয়া ও লিথুয়ানিয়ার মধ্যে ৩০ বছরের একটি ট্রানজিট চুক্তি বলবৎ রয়েছে।

লিথুয়ানিয়ার রেল কর্তৃপক্ষ রোববার রাতে কালিনিনগ্রাদে সিমেন্ট, রড, জ্বালানি তেলসহ বিভিন্ন পণ্য পরিবহনে বিধিনিষেধ আরোপের ঘোষণা দেয়। সোমবার থেকে এ বিধিনিষেধ কার্যকর হয়েছে। এরপর থেকে কালিনিনগ্রাদের দোকানপাট ও বিপনি কেন্দ্রগুলোতে আতঙ্কগ্রস্ত স্থানীয় অধিবাসীদের কেনাকাটার হিড়িক পড়েছে।

স্থানীয় কর্মকর্তারা জানান, লিথুয়ানিয়া সরকার লোহা ও ইস্পাত পণ্য, জেট ফুয়েল, বিমান ও মহাকাশ শিল্পে ব্যবহার্য পণ্য ও যন্ত্রাংশ, জ্বালানি তেল ও তেলজাত পণ্য ও কয়লা পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।

কালিনিনগ্রাদ অঞ্চলের গভর্নর আন্তন আলিখানভ লিথুয়ানিয়ার বিধিনিষেধকে বেআইনি অভিহিত করে বলেছেন, লিথুয়ানিয়া যা করছে তার জের ইউরোপীয় ইউনিয়ন পর্যন্ত গড়াতে পারে। কালিনিনগ্রাদ ইস্যুতে রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মস্কোতে ইইউ দূতাবাসের প্রতিনিধিকে তলব করবে বলে তিনি সংবাদমাধ্যমকে জানান।

রাশিয়ার সামরিক ও কৌশলগত পরিকল্পনায় বাল্টিক সাগরের তীরবর্তী রুশ ছিটমহল কালিনিনগ্রাদের গুরুত্ব অপরিসীম। পোল্যান্ড ও লিথুয়ানিয়ার মধ্যবর্তী ছোট এ ছিটমহল রুশ নৌবাহিনীর বাল্টিক বহরের ঠিকানা। রাশিয়ার প্রায় আশিটি রণতরী ও ডুবোজাহাজ রয়েছে কালিনিনগ্রাদে। এছাড়া সেখানে গুরুত্বপূর্ণ জাহাজ নির্মাণ শিল্প ছাড়াও রয়েছে ইসকান্দার মিসাইল ও অন্যান্য কৌশলগত অস্ত্র। কালিনিনগ্রাদে মোতায়েন মিসাইলে পারমাণবিক ওয়ারহেড রয়েছে কিনা জানা যায়নি।

লিথুয়ানিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, রাশিয়ায় যেসব পণ্য রপ্তানি ও সরবরাহের ওপর ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, ইইউর সদস্য হিসেবে লিথুয়ানিয়া সেসব পন্য পরিবহন বন্ধে উদ্যোগ নিয়েছে। লিথুয়ানিয়া একতরফাভাবে কোনো বাড়তি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি।

রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ ঘটনার প্রতিবাদ জানাতে মস্কোতে নিযুক্ত লিথুয়ানিয়ার চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্সকে তলব করেছে। লিথুয়ানিয়ার প্রতিনিধির হাতে তুলে দেওয়া প্রতিবাদলিপিতে রাশিয়া বলেছে, কালিনিনগ্রাদের সম্পূর্ণ ট্রানজিট সুবিধা পুনর্বহাল না করলে জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষায় রাশিয়া প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার অধিকার রাখে।

রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, লিথুয়ানিয়ান পক্ষের পদক্ষেপ কালিনিনগ্রাদ অঞ্চলের সঙ্গে রুশ ফেডারেশনের অন্যান্য অঞ্চলের মধ্যকার ট্রানজিট নিয়ে ২০০২ সালে রাশিয়া ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের যৌথ বিবৃতি ও লিথুয়ানিয়ার অন্যান্য আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতার স্পষ্ট লঙ্ঘন। আমরা এ বিষয়টিকে প্রকাশ্য বৈরী আচরণ হিসেবে বিবেচনা করছি।

রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা বলেছেন, কালিনিনগ্রাদে ট্রানজিটে বিধিনিষেধ আরোপ করে লিথুয়ানিয়া সরকার বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে নতুন সমস্যা সৃষ্টি করছে। লিথুয়ানিয়াকে এর জবাব দিতে হবে।

রুশ সংবাদমাধ্যম রিয়া নভোস্তির এক মন্তব্য প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কালিনিনগ্রাদের ওপর লিথুয়ানিয়ার অবরোধ আরোপের সিদ্ধান্ত রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল।

রাশিয়ার সিনেটের এক প্রস্তাবে বিধিনিষেধ আরোপের জবাবে লিথুয়ানিয়ার বিরুদ্ধে দ্রুত ও কঠোর পদক্ষেপের হুমকি দেওয়া হয়েছে। প্রভাবশালী সিনেটর আন্দ্রেই ক্লিশাস অভিযোগ করেছেন, কালিনিনগ্রাদের ওপর অবরোধ আরোপের মাধ্যমে লিথুয়ানিয়া কার্যতঃ রাশিয়ার সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করেছে। লিথুয়ানিয়ার এ পদক্ষেপকে ভিত্তি করে রাশিয়া আইনসম্মতভাবে অত্যন্ত কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার এখতিয়ার রাখে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

রুশ সিনেটের পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান ও জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক গ্রিগরি কাসারিন বলেন, লিথুয়ানিয়াকে কড়া প্রতিবাদলিপি দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে রাশিয়ার যে কোনো পদক্ষেপ ‘ফলাফল নির্ধারক’ হবে বলে তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন।

রুশ পার্লামেন্ট স্পিকার ভাচেস্লাভ ভলোদিন বলেছেন, কালিনিনগ্রাদে পণ্য পরিবহনের সুবিধার্থে স্বাক্ষরিত ট্রানজিট চুক্তিকে ভিত্তি করেই রাশিয়া সরকার লিথুয়ানিয়ার সীমান্তকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এর ভিত্তিতে লিথুয়ানিয়া ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও ন্যাটোর সদস্যপদ লাভ করেছে। রাশিয়ার সঙ্গে স্বাক্ষরিত ট্রানজিট চুক্তি অস্বীকার করলে লিথুয়ানিয়ার রাষ্ট্রীয় সীমান্তের রুশ স্বীকৃতি থাকে না বলে তিনি দাবি করেন।

ইইউর পররাষ্ট্র নীতি বিষয়ক প্রধান জোসেপ বোরেল বলেছেন, রাশিয়ার হামলার হুমকি আছে ঠিকই কিন্তু লিথুয়ানিয়া অন্যায় কিছু করেনি। লিথুয়ানিয়া কেবলমাত্র ইউরোপীয় কমিশনের নির্দেশনা প্রয়োগ করছে।

এর আগে গত মাসে ফিনল্যান্ড ও সুইডেন সরকার ন্যাটোতে যোগদানের সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর পোল্যান্ডের ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতা ও সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী রোমুয়াল্ড জেরেমিতিউ রাশিয়ার সামরিক স্থাপনা হটিয়ে কালিনিনগ্রাদ ছিটমহল বেসামরিকীকরণ প্রস্তাব দিলে রুশ কর্মকর্তারা তীব্র প্রতিক্রিয়া জানান।

এদিকে এস্তোনিয়া সরকার আগামী ১০ জুলাই থেকে রাশিয়া থেকে পণ্য আমদানিতে বিধিনিষেধ আরোপের ঘোষণা দিয়েছে। রাশিয়ার যেসব পণ্য ইইউর নিষেধাজ্ঞার আওতাভুক্ত রয়েছে, এস্তোনিয়ান নাগরিকরা সেসব পণ্য রাশিয়া থেকে কিনে আনতে পারবেন না বলে ঘোষণায় উল্লেখ করা হয়।

ক্রিমিয়া ও সেভাস্তপলে নিষেধাজ্ঞা

ইউরোপিয়ান কাউন্সিল ক্রিমিয়া ও সেভাস্তপলের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ আরও এক বছর বাড়িয়েছে। ২০১৪ সালে রাশিয়া ক্রিমিয়া দখল করে নেওয়ার পর ইসি সেখানে বেশকিছু আর্থিক ও রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। নতুন এক সিদ্ধান্তে ইসি বিদ্যমান নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ ২০২৩ সালের ২৩ জুন পর্যন্ত বৃদ্ধি করেছে।