জমে উঠেছে মহারাষ্ট্রের রাজনৈতিক নাটক

ভারতের মহারাষ্ট্র থেকে গুজরাটে চলে যাওয়া শিব সেনা দলীয় বিধায়করা আজ ভোরে আসামে পৌঁছেছে। আসামের মুখ্যমন্ত্রী ও বিজেপি নেতা হিমন্ত বিশ্বশর্মা গৌহাটির র‌্যাডিসন হোটেলে শিব সেনার বিধায়কদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। বিজেপির সঙ্গে দলীয় বিধায়কদের এমন আঁতাতের জেরে মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব থ্যাকারে পদত্যাগ করতে চলেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

শিব সেনা দলীয় বিধায়ক একনাথ শিনদে ও মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব থ্যাকারে

এনডিটিভি জানিয়েছে, শিব সেনার বিদ্রোহী নেতা একনাথ শিনদের নেতৃত্বে একদল বিধায়ক সোমবার রাত থেকে গুজরাটের সুরাট শহরের লো মেরিদিয়েন হোটেলে অবস্থান করছিলেন। বুধবার ভোরে তারা লো মেরিদিয়েন হোটেল ছেড়ে একটি ভাড়াকৃত বিমানে চড়ে আসামের গৌহাটি পৌঁছেন। সেখানে তারা র‌্যাডিসন হোটেলে অবস্থান করছেন।

শিব সেনা নেতা সঞ্জয় রাউত বলেছেন, মহারাষ্ট্র থেকে দলীয় নেতারা সুরাটে অবস্থানরত বিধায়কদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে সাড়া পাচ্ছিলেন না। কয়েকজন বিধায়ক সুরাট থেকে ফিরে আসতে চাইলেও গুজরাট পুলিশ তাদের হোটেল থেকে বের হতে দেয়নি।

জানা গেছে, মহারাষ্ট্রে শিব সেনা, এনসিপি ও কংগ্রেসের মহা বিকাশ আগাদি (এমভিএ) জোট ভাঙতে বিজেপি নেতারা গোড়া থেকেই জোর চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। বেশ কয়েকবার চেষ্টার পর ব্যর্থ হয়ে তারা শিব সেনা দলীয় বিধায়কদের ভাগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। চলতি সপ্তাহে মহারাষ্ট্র বিধানসভার উচ্চকক্ষ বা লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের নির্বাচনের আগে বিজেপির দীর্ঘদিনের চেষ্টা সফল হয়।

রাজ্য বিধানসভার সদস্যদের ভোটে লেজিসলেটিভ কাউন্সিল নির্বাচন করা হয়। সোমবার অনুষ্ঠিত মহারাষ্ট্র লেজিসলেটিভ কাউন্সিল (এমএলসি) নির্বাচনে শিব সেনার কিছু বিধায়ক দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে বিজেপি প্রার্থীদের পক্ষে ভোট দেন। এ কারণে মহারাষ্ট্র বিধানসভায় সংখ্যালঘু হওয়া সত্ত্বেও বিজেপি এমএলসির পাঁচটি আসনে জয় লাভ করে। অন্যদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও এমভিএ জোটের তিনটি দল মিলে পায় পাঁচটি আসন। এর মধ্যে শিব সেনার দুইটি, এনসিপির দুইটি ও কংগ্রেসের একটি।

ওসামানাবাদ আসনে শিব সেনা থেকে নির্বাচিত বিধায়ক কৈলাস পাতিল হিন্দুস্তান টাইমসকে জানান, এমএলসি নির্বাচনের পরপর বিধানসভায় আমাদেরকে জানানো হয় যে থানে অঞ্চলে একটি নৈশভোজের নিমন্ত্রণ রয়েছে, আমরা যাতে সেখানে যোগ দিই। দলের বিধায়কদের সঙ্গে আমিও বাসে চড়ে বসি। কিন্তু বাসটি কোথাও না থেমে গুজরাট সীমান্তের ঘোড়বান্দার দিকে যেতে থাকলে সন্দেহ হয়।

তিনি বলেন, সীমান্তের চেক পোস্টের কাছে গিয়ে আমি দোকানে যাবার অজুহাতে বাস থেকে নেমে পড়ি এবং ভিড়ের মধ্যে মিশে যাই। পরে পাঁচ কিলোমিটার হেঁটে প্রথমে ট্রাকে ও পরে মোটরসাইকেলে চড়ে বান্দ্রা ইস্টে পৌঁছে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করি। আমি শিব সেনা ও উদ্ধব থ্যাকারের সঙ্গে আছি।

শিব সেনার আরেক বিধায়ক নীতিন দেশমুখ আজ সকালে সুরাট থেকে নাগপুর পৌঁছে সংবাদমাধ্যমকে জানান, সুরাটের হোটেল থেকে আমি বেরিয়ে পড়লে ১০০-১৫০ জন পুলিশের একটি দল আমাকে জোরপূর্বক তুলে একটি হাসপাতালে নিয়ে যায় এবং আমার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে বলে চিকিৎসকদের জানায়। তারা চিকিৎসার অজুহাতে আমার ক্ষতি করতে চাইছিল। জোর করে অস্ত্রোপচার কক্ষে নিয়ে যেতে চাইলে আমি কোনোক্রমে পালিয়ে ঈশ্বরের কৃপায় নাগপুর পৌঁছেছি। আমি উদ্ভব থ্যাকারের সঙ্গে আছি।

সিপিআই (এম) নেতা সীতারাম ইয়েচুরি এক টুইটে অভিযোগ করেছেন, মহারাষ্ট্রে রাজ্য সরকারের পতন ঘটাতে দিল্লিতে ক্ষমতাসীন বিজেপি ষড়যন্ত্র করছে। রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর মাধ্যমে অনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ও টাকার বিনিময়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর বিধায়কদের আনুগত্য কিনে নিয়ে বিজেপি ভারতে গণতন্ত্রের মৃত্যু ঘটাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন বর্ষীয়ান এ রাজনীতিক।

তিনি বলেন, বিজেপি-শাসিত এক রাজ্য থেকে বিধায়কদের সরকারি সংস্থাগুলোকে ব্যবহার করে আরেক রাজ্যে জোরপূর্বক স্থানান্তরের মাধ্যমে বিজেপি গণতন্ত্রকে ছিনতাই করছে। গোয়া, কর্নাটক, মধ্যপ্রদেশসহ কয়েকটি রাজ্যে বিজেপি এভাবে বিরোধী দলীয় বিধায়কদের জোরপূর্বক হোটেলে আটকে রেখে সরকারের পতন ঘটিয়েছে।

নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের সাংবাদিক সুধীর সূর্যবংশী জানান, মহারাষ্ট্রে শিব সেনা দলীয় বেশ কয়েকজন বিধায়ক ভারতের আয়কর বিভাগ, এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট ও অন্যান্য রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর তদন্তের নামে হয়রানি থেকে বাঁচাতে দলের প্রধান ও মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব থ্যাকারেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করেছিলেন। এক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের কিছু করণীয় নেই বলে উদ্ধব থ্যাকারে তাদের জবাব দেন।

সুধীর জানান, রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর হয়রানি থেকে বাঁচতে বিধায়করা অনন্যোপায় হয়ে দল বদলের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অতীতে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, কর্নাটকসহ কয়েকটি রাজ্যে বিরোধী দলীয় রাজনীতিক ও বিধায়করা দল বদল করে বিজেপিতে যোগদানের পর এ ধরনের তদন্ত থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন।

এদিকে একনাথ শিনদে দাবি করেছেন, তার সঙ্গে এ মুহূর্তে শিব সেনার ৪৬ জন বিধায়ক রয়েছে এবং অন্যরাও শীঘ্রই যোগ দেবে। তবে এখনো বিজেপির সঙ্গে কোনো যোগাযোগ হয়নি বলে তিনি দাবি করেন, যদিও বিজেপি নেতা ও আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা আজ সকালে গৌহাটির হোটেলে শিব সেনা বিধায়কদের সঙ্গে কথা বলতে গেছেন বলে এনডিটিভির খবরে জানানো হয়েছে। গৌহাটির র‌্যাডিসন হোটেলে হিমন্ত বিশ্বশর্মার গাড়িবহরের ভিডিও ফুটেজও সম্প্রচার করেছে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম।

মহারাষ্ট্রের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ও বিজেপি নেতা দেবেন্দ্র ফদনবিস তার দলের বিধায়কদের এ মুহূর্তে মহারাষ্ট্রের বাইরে না যাওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি বলেন, পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত বিধায়কদের রাজ্যে থাকতে বলা হচ্ছে।

মহারাষ্ট্র বিধানসভার মোট আসন সংখ্যা ২৮৮। এর মধ্যে বিজেপির রয়েছে ১০৫ আসন। শিব সেনার ৪০ জনকে দল থেকে ভাগিয়ে নিতে পারলেই বিজেপি মহারাষ্ট্রে সরকার গঠন করতে পারে। এর আগে দলটি নির্বাচনে তুলনামূলক কম আসন পাওয়া সত্ত্বেও একই কায়দায় প্রতিপক্ষের বিধায়কদের ভাগিয়ে নিয়ে হোটেলে-রিসর্টে আটকে রেখে সম্মতি আদায়ের মাধ্যমে কর্নাটক, গোয়া ও মধ্যপ্রদেশে সরকার গঠনে সমর্থ হয়েছে। তবে রাজস্থানে ও পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি সে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে।