আপনি পড়ছেন

ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, “প্রত্যেক গোলাম, আযাদ, পুরুষ, নারী, প্রাপ্ত বয়স্ক, অপ্রাপ্ত বয়স্ক মুসলিমের উপর আল্লাহর রসুল (সা.) সদাকাতুল ফিতর হিসেবে খেজুর হোক অথবা যব হোক এক সা’ পরিমাণ আদায় করা বাধ্যতামূলক করেছেন, এবং ঈদের সলাতের জন্য বের হওয়ার আগেই তা আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন।” (বুখারী ১৫০৩)

sadaqahtul fitar 2021ছবি - সংগৃহীত

আবু সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা এক সা’ পরিমাণ খাদ্য অথবা এক সা’ পরিমাণ যব অথবা এক সা’ পরিমাণ খেজুর অথবা এক সা’ পরিমাণ পনির অথবা এক সা’ পরিমাণ কিসমিস দিয়ে সদাকাতুল ফিতর আদায় করতাম। (বুখারী ১৫০৬)

ফিতরা কথার তাৎপর্য:

আমরা যাকে ফিতরা বলি, শরীয়তের পরিভাষায় তাকে যাকাতুল ফিতর বলা হয়। অর্থাৎ ফিতরের যাকাত। ফিতর অর্থ রোজা ছাড়া। তাই যাকাতুল ফিতর অর্থ হলো ‘সেই যাকাত যা রমজানের রোজ শেষ করার কারণে ধার্য হয়।’ একে সদকায়ে ফিতরও বলা হয়। এছাড়া একে ‘যাকাতুল ফিতরাহ’-ও বলা হয়। ফিতরাহ অর্থ মানব প্রকৃতি। ‘আত্মার পরিশুদ্ধি ও তার কার্যাবলী পরিচ্ছন্ন-নির্ভুল-নিষ্কলুষ করার লক্ষ্যে’ এ যাকাত বা সাদাকা নির্ধারণ করা হয়েছে বলে এই নামকরণ করা হয়েছে। (ইসলামের, যাকাত বিধান, আল্লামা ইউসুফ আল কারযাভী, ই.ফা.বা প্রকাশিত, ২য় খণ্ড, পৃ. ৫২৯)

‘সাদাকায়ে ফিতর’ হিযরতের পর দ্বিতীয় বছর ধার্য করা হয়। উল্লেখ্য, এ বছর থেকেই রমজানের রোজা ফরয করা হয়।

সদাকায়ে ফিতরের উদ্দেশ্য-

ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন:

“রসুলুল্লাহ (সা.) ফিতরের যাকাত নির্ধারণ করেছেন রোজাদারকে বেহুদা অশ্লীল কথা ও কাজ থেকে পবিত্র রাখা এবং মিসকীনদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা স্বরূপ।” (আবু দাউদ, যাকাতুল ফিতর অধ্যায়)

অর্থাৎ সাদাকায়ে ফিতরের উদ্দেশ্য দ্বিবিধ:

প্রথমত: রোজাদারকে পরিশুদ্ধ করা। রোজার দাবী রোজাদারের পরিপূর্ণ সত্ত্বা আল্লাহমুখী হয়ে যাবে। পেট ও গোপানাঙ্গ যেভাবে রোজা থাকে মুখ, কান, চোখ, হাত-পা সর্বোপরি অন্তঃকরণও রোজা থাকবে তথা আল্লাহর নিষিদ্ধ কাজগুলি থেকে বেঁচে থাকবে। কিন্তু মানব প্রকৃতি তার দুর্বলতার কারণে অনেক সময়ই তা করতে পারে না। এ জন্য রোজা শেষ হওয়ার পর এ যাকাতের ব্যবস্থা করা হয়েছে। যেন গোসল করার মতো। যা কিছু অপবিত্রতা স্পর্শ করেছিল রোজাদারকে, তা ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করার ব্যবস্থা। কারণ “সৎকাজ অবশ্যই অসৎকাজকে মিটিয়ে দেয়।” (সুরা হুদ ১১: ১১৪)

যেমন- আল্লাহপাক ফরয নামাজের সাথে কিছু সুন্নাত নামাযের বিধান দিয়েছেন। যাতে তা নামাযীর ত্রুটি-বিচ্যুতি দূর করে দেয়। কোনো কোনো ইমাম সাদাকায়ে ফিতরকে নামাযের ‘সাহু সিজদা’র সাথে তুলনা করেছেন। নামাযে ত্রুটি-বিচ্যুতি হলে সাহু সিজদা যেভাবে তা পূরণ করে তেমনি রোজার ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলি সাদাকায়ে ফিতরের মাধ্যমে দূর হয়ে যায়। (ইসলামের যাকাত বিধান, আল্লামা ইউসুফ আল-কারযাভী)

দ্বিতীয়ত: সাদাকায়ে ফিতরের উদ্দেশ্য হল সমাজের দুঃস্থ, অসহায়, দরিদ্র ও মিসকীনদের প্রতি ভালবাসা ও সহৃদয়তা বিস্তৃত করা এবং ঈদের আনন্দে তাদের সম্পৃক্ত করা।

ঈদ আনন্দের দিন। কিন্তু অসহায়-দরিদ্র মানুষের পক্ষে এতে যথাযথভাবে সামিল হওয়া দুঃসাধ্য। তাই আল্লাহতা’লা তাঁর সক্ষম বান্দাদের নির্দেশ দিলেন- তোমাদের দুর্দশাগ্রস্ত ভাই ও বোনদের তোমাদের এই আনন্দে সামিল করে নাও।

রসুল (সা.) বলেন-

“এই দিন (অর্থাৎ ঈদের দিন) তাদের স্বচ্ছল করে দাও।” (বায়হাকী)

- সুবহানাল্লাহ! আমাদের এই দ্বীন, দ্বীন ইসলাম এক অপূর্ব জীবন ব্যবস্থা, সারা মাস রোজাদার রোজা পালন করলো, তাতে অবশ্যই তার ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়েছে। কোনো অসংগত চিন্তা মনে এসেছে, কোনো অসংগত কথা মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে, অর্থাৎ কোনো অসংগত আচরণ করে ফেলেছে সে কোথাও। তা পূরণ করার ব্যবস্থা কি দেয়া হল- অভাবগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াও। তাকে তোমার মধ্যে সামিল করে নাও, তোমার আনন্দে সামিল করে নাও। ঈদের খুশী বণ্টন করে দাও সমাজের প্রতিটি কোণায়, প্রতিটি ঘরে। আর তারপরই ঈদের নামাযে হাজির হয়ে এই যে আত্মশুদ্ধির জন্য রোজার বিধান, রোজা রাখার তাওফীক ও রোজার ত্রুটি-বিচ্যুতি দূর করার জন্য সাদাকায়ে ফিতরের এই যিনি দিলেন তাঁর বড়ত্ব ও মহত্বের ঘোষণা প্রদান করো:

“আল্লাহ তোমাদের জন্য যা সহজ তা চান, যা তোমাদের জন্য কষ্টকর তা চান না। এই জন্য যে তোমরা (রোজার) সংখ্যা পূরণ করবে এবং তোমাদেরকে সৎপথে পরিচালিত করার কারণে তোমরা আল্লাহর মহিমা ঘোষণা করবে এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পার।” (বাকারা ২: ২৮৫)

সাদাকায়ে ফিতর সমাজকে inclusive করার ব্যবস্থা। সমাজের প্রতিটি সদস্যকে পরস্পরের সঙ্গে অঙ্গীভূত করার, অংশী করার ব্যবস্থা। ধনী ভুলে যাবে না তার অভাবী আত্মীয় প্রতিবেশী বা সমাজবাসীর কথা। ভুলে যাবে না তার সম্পদে অভাবীর ভাগ আছে (যারিয়াত ৫১: ১৯)। ভুলে যাবে না যে, পেটপুরে ভাল ভাল খেল আর তার অভাবী প্রতিবেশী কষ্টে থাকলো- এতে তার ঈমানই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে, প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে তার নামায-রোজাসহ সব ইবাদত-বন্দেগী। আর অভাবীও বুঝবে সমাজ তাকে ভুলে যায়নি। তার সম্পদশালী ভাই বা বোনেরা তার পাশে আছে সুখে-দুঃখে, আনন্দে-বেদনায়। একটা সুদৃঢ় কল্যাণমুখী সমাজব্যবস্থা গড়ার জন্য এটাই ইসলামের একমাত্র ব্যবস্থা নয়। তবে অন্যতম ব্যবস্থা। অন্য কোনো ধর্মে বা জীবনব্যবস্থায় আমরা সমাজে ভ্রাতৃত্ববোধ ও পারস্পাকি দায়বোধ সৃষ্টির এ ব্যবস্থা দেখতে পাই না।

সাদাকায়ে ফিতরের বিধান

১. সাদাকায়ে ফিতর ওয়াজিব তথা বাধ্যতামূলক।

২. কার উপর বাধ্যতামূলক: ঈদের দিন নামাযে যাওয়ার পূর্বে যার নিকট তার প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ রয়েছে তার জন্যই ফিতরা বাধ্যতামূলক। কারণ, রসুল (সা.) রমজানের ফিতরের যাকাত ধার্য করেছেন মুসলমানদের মধ্যে প্রত্যেক স্বাধীন মুক্ত ও ক্রীতদাস- পুরুষ ও নারীদের উপর।” (বুখারী ১৫০৩)

৩. ফিতরা কখন দিবে: ঈদের নামাযে যাওয়ার আগেই ফিতরা প্রদান ওয়াজিব (বুখারী ১৫০৯)। তবে সতর্কতা ও গরীব মানুষের উপকারে আসে এই উদ্দেশ্যে দুই-তিন দিন পূর্ব হতে তা দেয়া যায়। ঈদের নামাযের পর দিলে ফিতরা হবে না বরং তা সাধারণ দান হিসেবে বিবেচিত হবে।

৪. কতটুকু দিবে: রসুল (সা.) খাদ্যবস্তুর উপর এক সা’ ফিতরা নির্ধারণ করেছেন। অতএব, এক সা’ ফিতরা প্রদানই সুন্নাহ সম্মত। অর্ধ সা’ গম একজন একজন সাহাবীর ব্যক্তিগত মত যা অধিকাংশ সাহাবীই মেনে নেননি। বরং তারা রসুল (সা.) সুন্নাহ অনুযায়ী পূর্ণ এক সা’ খাদ্যবস্তুর উপর ফিতরা প্রদান করেছেন (মুসলিম)। ফলে উত্তম হল- এক সা’ পরিমাণ ফিতরা আদায় করা।

৫. এক সা’র প্রচলিত হিসাব: রসুলুল্লাহ (সা.)-এর যামানায় মদীনায় এক সা’ হিসেবে যে পাত্র মাপের জন্য ব্যবহার করা হতো তাতে ২০৪০ থেকে ২৫০০ গ্রাম এর সমপরিমাণ খাদ্যশস্য ধরতো। আর তৎকালীন ইরাকী সা’ এর পাত্রে ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম সমপরিমাণ। অতএব, ২৫০০ গ্রাম বা আড়াই কেজি পরিমাণ দিলে সুন্নাত অনুযায়ী আদায় হবে। তবে কেউ বেশি দিতে চাইলে ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম সমপরিমাণ দিতে পারেন। বেশি দিতে কোনো আপত্তি নেই। বরং আল্লাহ বলেন-

“যে ব্যক্তি অতিরিক্ত বা নফল হিসেবে কোনো করবে তা তার জন্য ভালো হবে।” (বাকারা ২: ১৮৪)

আল্লামা কারযাভী বলেন, রোজার ফিতরার ব্যাপারে এ আয়াত খুবই প্রযোজ্য। কেন না তা হচ্ছে মিসকীনের খাদ্য। (ইসলামের যাকাত বিধান, পৃ. ৫৬২) তদুপরি বর্তমান করোনা মহামারীর কালে অধিক প্রদানই উত্তম মনে হয়। (আল্লাহ পাকই ভালো জানেন)।

৬. কি দিয়ে সাদাকুল ফিতর দিবে: রসুল (সা.)-এর সময় খেজুর, যব, কিসমিস বা পনির ইত্যাদি দিয়ে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা হতো। কারণ এগুলোই সে সময় মূল খাদ্য হিসেবে প্রচলিত ছিল।

আমাদের দেশে মূল খাদ্য বা Staple Food হল চাল। তাই চাল দিয়েই ফিতরা প্রদান করাই সুন্নাহর সঙ্গে সামঞ্জস্যশীল। আল্লামা কারযাভী এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনার পর বলেন-

“অতএব, আমার দৃষ্টিতে এ মতটাই অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য যে, প্রত্যেক ব্যক্তিই তার দেশের জনগণের সাধারণ খাদ্য দিয়েই তার ফিতরা আদায় করবে অথবা তার নিজের সাধারণ খাদ্য যদি দেশের সাধারণ খাদ্য থেকে উন্নতমানের হয় তাহলে তা থেকেই ফিতরা দিবে।” (ইসলামের যাকাত বিধান, ২য় খণ্ড, পৃ. ৫৬৯)

অতএব, যে যে মানের চাল খান তা থেকে এক সা’ পরিমাণ ফিতরা আদায় করবেন।

৭. খাদ্যবস্তু দিয়ে না টাকা দিয়ে সাদাকায়ে দিয়ে:

রসুলুল্লাহ (সা.) খাদ্যবস্তু দিয়ে ফিতরা আদায় করতে বলেছেন এবং জনগণ তাদের নিজ নিজ প্রধান খাদ্য খেজুর, যব, কিসমিস, পনির ইত্যাদি দিয়ে তা আদায় করেছেন।

তাই খাদ্যবস্তু দিয়ে ফিতরা আদায় করা সুন্নত।

তবে টাকা বা currency দিয়ে ফিতরা আদায় করলে তা আদায় হবে কিনা এ নিয়ে কিছুটা মতভেদ আছে।

(পঞ্চম খলিফা হিসেবে বিবেচিত) উমর বিন আব্দুল আজিজ (রহ.) ফিতরা বাবদ মূল্য গ্রহণ করেছেন। ইমাম আবু হানিফা ও তার সঙ্গীগণ ফিতরা বাবদ মূল্য প্রদান জায়েয বলে মত দিয়েছেন।

নবী করীম (সা.) ফিতরার যাকাত দেয়ার জন্য খাদ্যবস্তু দেয়া নির্ধারণ করেছেন দুটি কারণে:

প্রথমত: সে সময়কার আরবে নগদ অর্থ ছিল বিরল। ফলে খাদ্যবস্তু দেয়াটাই ছিল লোকদের পক্ষে সহজ।

দ্বিতীয়ত: নগদ মূল্যের ক্ষয় ক্ষমতা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন হয়ে থাকে। কিন্তু এক সা’ পরিমাণ খাদ্য সেরূপ নয়। তা মানবীয় প্রয়োজন খুব সীমিতভাবে পূরণ করতে পারে মাত্র। সেকালে খাদ্যশস্য দেয়া যেমন দাতার পক্ষে সহজ ছিল, গ্রহণকারীর পক্ষেও তা ছিল অধিক উপকারী। (একালে নগদমূল্য দেয়াটা ঠিক তেমনি উপকারী)। (ইসলামের যাকাত বিধান, ২য় খণ্ড, পৃ. ৫৭৩)।

-আমাদের দেশে মূল খাদ্য চাল। চাল দিয়ে ফিতরা দেওয়ার ক্ষেত্রে নিম্নরূপ অবস্থা হতে পারে-

# রসুলুল্লাহ (সা.)- এর সময় যার যা আছে তা দিয়ে ফিতরা দেয়া হতো। কিন্তু শহরবাসী মানুষদের চাল দিতে হলে তা কিনে দিতে হবে। তখন একবার তাকে অধিক মূল্যে বাজার থেকে চাল কিনে আনতে হবে। আবার ফিতরা গ্রহীতা শুধু চাল বা ভাত খান না। অন্যান্য জিনিস (যেমন- পোলাওয়ের চাল, সেমাই, তেল, মুরগি, কিসমিস, মসলা ইত্যাদি) কিনতে হলে তাকে প্রদত্ত উদ্বৃ্ত্ত চাল বিক্রি করতে হবে। তখন সে অবশ্যই যথার্থ মূল্য পাবে না। অর্ধেক বা তার চেয়ে কম মূল্য পাবে। ফলে একই বস্তুতে দু'বার সম্পদের অপচয় হচ্ছে।

# এ ছাড়া, একজন ব্যক্তি বিভিন্ন জনের কাছ থেকে বিভিন্ন প্রকার চাল ফিতরা বাবদ পেতে পারে- পাইজাম, মিনিকেট, নাজিরশাইল ইত্যাদি। এগুলো মিশ্রিত অবস্থায় রাঁধতে গেলে সে সমস্যায় পড়বে।

# সর্বোপরি কথা হল

রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন-

"ঈদের দিন তাকে ধনী করে দাও।" অর্থাৎ গরীব-মিসকিনরা যেন ঈদের আনন্দে শরীক হতে পারে তার ব্যবস্থা করে দাও। মদীনার সকলেই একই রকম খাদ্য খেতেন। তাই দিয়ে ফিতরা দেয়া হতো। ফলে ঈদের দিন সবার বাড়িতে কাছাকাছি মানের খাদ্যবস্তু থাকতো। কিন্তু আমাদের দেশে স্বচ্ছল ব্যক্তিরা বাসায় কমসেকম পোলাও, রোস্ট, সেমাই, ফিন্নি ইত্যাদি খাবেন। আর মিসকীনকে বলা হবে তুমি পাইজাম দিয়ে চালাও। শরীয়ত প্রণেতা মহান আল্লাহতা’লা যে উদ্দেশ্যে ফিতরার ব্যবস্থা করেছেন তার সাথে এটা সামঞ্জস্যশীল বলে মনে হয় না। শরীয়তের বিধানের উদ্দেশ্য তথা মাকাসিদ আশ-শরীয়াহর সাথে তা সাংঘর্ষিক হয়ে যায়-

"নবী (সা.)-এর কথা: ‘এদিন মিসকীনদের স্বচ্ছল বানিয়ে দাও’-থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, মূল্য দিলেও তাদের স্বচ্ছল বানাবার উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হয় যেমন- খাদ্যবস্তু দিলে তা হয়। আর অনেক সময় মূল্য দেয়াটা উত্তমও হয়। কেন না ফিতরা বাবদ পাওয়া বিপুল খাদ্য সম্ভার ফকীর-মিসকীনদের কাছে জমা হলে তা বিক্রয় করার প্রয়োজন দেখা দিতে পারে। অথচ নগদ পয়সা পেলে সে তার দ্বারা প্রয়োজন মতো খাদ্য, বস্ত্র ও অন্যান্য দ্রব্য ক্রয় করতে পারে।”

… "আমাদের এ যুগের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলেও এটাই সহজ মনে হবে। বিশেষ করে শিল্পোন্নত দেশ ও এলাকাসমূহে নগদ পয়সাই হয় বিনিময়ের একমাত্র মাধ্যম। অনকে দেশে, অনেক শহরে এবং অনেক সময়ই তা গরীব লোকদের জন্য খুবই সুবিধাজনক হয়।” (ইসলামের যাকাত বিধান, ২য় খণ্ড, পৃ. ৫৭২-৫৭৩)

# এ বিষয়ে আরো কথা হল, গরীব মানুষের প্রয়োজনটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়। যদি খাদ্য শস্য দিলে তার ভাল হয় তবে সেটা দেয়াই উত্তম। যেমন- দূর্ভিক্ষে ও কষ্টের সময় সেটাই ভাল। আর যদি নগদ টাকা পেলে তার ভাল হয়, বেশি সুবিধা হয় তাহলে তা-ই দেয়া উত্তম। আবার অনেক সময় দুর্বলতার কারণে গরীব মানুষ হাতে নগদ টাকা পেলে অপ্রয়োজনীয় বা বাজে কাজে তা খরচ করে ফেলে। সেক্ষেত্রে খাদ্য দেয়াটাই উত্তম।(ইসলামের যাকাত বিধান, ২য় খণ্ড পৃ. ৫৭৪-৫৭৫)

# এটাই শরীয়তের মাসলাহাত বা উপযোগিতার নীতি হিসেবে বিবেচ্য।

# তবে এক্ষেত্রে কথা হল- যিনি খাদ্যবস্তু দিয়ে ফিতরা দেয়াকে উত্তম মনে করেন তিনি তা দিয়েই দিন। আবার যিনি মূল্য দিয়ে দেয়া যথার্থ বিবেচনা করেন তিনি তা দিয়েই ফিতরা দিন। উভয়টিই সাহাবী ও তাবেয়ীদের আমল ও বক্তব্য দ্বারা প্রমাণিত। এ নিয়ে বিবাদ না করি। উভয়েরই মূল্য লক্ষ্য যখন শরীয়তের বিধান পালন এবং দরিদ্রের কল্যাণ তখন পরস্পরের প্রতি সুধারণা পোষণ, ঔদার্য ও সহনশীলতাই কাম্য।

৮. ফিতরা কাকে দেয়া হবে, কতটুকু দেয়া হবে: কোনো কোনো হাদীসে উল্লেখিত রয়েছে-

"ফিতরা মিসকিনদের খাদ্য।"

রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,

"এদিন তাদের ধনী বানিয়ে দাও।"

তাই ফিতরা দরিদ্র ও মিসকীনদেরই প্রাপ্য। ফকির ও মিসকীন কারা এর সংজ্ঞায় ফিকাহবিদদের মত পার্থক্য রয়েছে।

যে দরিদ্র বা মিসকীন যাকাত পাওয়ার উপযুক্ত সেই ফিতরা পাওয়ার উপযুক্ত। এরা হলেন-

১. যার কোনো সম্পদ নেই, নেই আসলেই কোনোই উপার্জন,

২. যার কিছু উপার্জন বা মাল সম্পদ আছে বটে, কিন্তু তা তার পরিবার ও পোষ্যদের মৌলিক প্রয়োজনসমূহ পূরণের জন্য যথেষ্ট নয়।

এক্ষেত্রে, ব্যবসায়ী ভিক্ষুকদের ব্যাপারে সাবধান হওয়া জরুরী। এদের অনেকেই অত্যন্ত স্বচ্ছল বরং তাদেরই ফিতরা দেয়া জরুরী। আর বাকিরা ভিক্ষা ব্যবসা পরিচালনাকারীদের হাতে বন্দী। এদের ফিতরা দিলে ওইসব অপরাধীদের হাতেই তা যাবে। তবে বর্তমান করোনা পরিস্থিতে বিষয়টি অত্যন্ত জটিল হয়ে পড়েছে। কে ভিক্ষা ব্যবসায়ী আর কে প্রকৃতই দরিদ্র তা চিহ্নিত করা কঠিন। তবে নিজ নিজ পরিচিত দরিদ্রদের দিকে নজর দিলে এ সমস্যা হতে কার্যত মুক্তি পাওয়া সম্ভব। তবে নিয়ত সহীহ করে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বান্দা যাই ব্যয় করে আল্লাহ পাক রহমানুর রহীম তা অবশ্যই কবুল করবেন, ইনশাল্লাহ।

ফিতরা দেয়ার সময় এক ব্যক্তির প্রয়োজন পূরণ হয় এ পরিমাণ ফিতরা দেয়া জরুরী। একজনের ফিতরা বহুজনকে দিলে স্বভাবত:ই এতে এক ব্যক্তির ঈদ প্রয়োজন পূরণ সম্ভব নয়। হাদীস অনুযায়ী ঈদের দিন তাকে ধনী করে দেয়ার নির্দেশও বাস্তবায়িত হয় না। সেক্ষেত্রে এ ব্যক্তিকে অন্যের মুখাপেক্ষী থাকতে হয়। যা অত্যন্ত অনভিপ্রেত, অগ্রহণযোগ্য। আবার বহু ব্যক্তির ফিতরা একজনকে দিলে অন্যান্য অভাবগ্রস্তরা বঞ্চিত হওয়ার সম্ভবনা সৃষ্টি হয়। তাই এক্ষেত্রে স্বচ্ছল ভাই-বোনেরা যথেষ্ট বিবেচনা করে প্রয়োজনে কয়েকজনে মিলে পরামর্শ করে ফিতরার টাকা বণ্টন করলে সবচেয়ে ভালো হয়। ইবাদতের হক আদায় হয়, দরিদ্র ভাই-বোনদের প্রতি দায়িত্বও পালিত হয়।

৯. ফিতরা ও ইসলামী সমাজের জরুরত: যাকাতের মতো ফিতরাও রসুলুল্লাহ (সা.) ও খিলাফতের যামনায় রাষ্ট্রীয়ভাবে আদায় করা হতো। (বুখারী ১৫১১)। বস্তুত: এতে ইতিপূর্বে উল্লেখিত যত রকম সমস্যা তার সবকিছু এড়ানো সম্ভব। রাষ্ট্রীয়ভাবে সদকায়ে ফিতর আদায় করলে যথাযথভাবে তা আদায় করা এবং প্রকৃত প্রাপকদের মধ্যে যথাযথভাবে তা বণ্টন করা সম্ভব হয়। মুসলিম জনগোষ্ঠীর যাকাত ও ফিতরের মতো ইবাদতগুলি সঠিকভাবে আদায় এবং এগুলি ব্যবহার করে দারিদ্র্য বিমোচনে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের লক্ষ্যে সর্বস্তরের দায়িত্বশীল মহলের উদ্যোগ প্রয়োজন।

১০. শেষ কথা: এই নিবন্ধ যখন লেখা শেষ হচ্ছে তখন ২৭ শে রমজানের বরকতময় রাত অতিক্রান্ত হচ্ছে। আজ রাতই হতে পারে শবে কদরের রাত। রসুল (সা) বর্ণিত আলামত অনুযায়ী সাহাবীগণ রসুল (সা.)-এর সময় লাইলাতুল কদরের রাত কোনো বছর ২১ রমজানও হয়েছে। সাহাবীদের কেউ কেউ কদরের রাত ২৭ রমজান বলেছেন। তবে শেষ ১০ দিনে তা অবশ্যই আছে এবং এর বেজোড় রাতগুলোতেই তা হওয়ার সম্ভবনা সবচেয়ে বেশি। আজ-সহ এ রকম আরো বরকতময় ৩টি রাত রয়েছে। আশা করছি, মুমিন ভাই-বোনেরা সবাই ইবাদতে- নামায-দোয়া, কুরআন তেলাওয়াত-যিকির, ইস্তেগফারে এ সময় অতিক্রান্ত করেছেন। সবাই মেহেরবানী করে বিশ্বের সকল মুসলিমকে দোয়ায় শরিক করি- ইয়েমেনের মুসলিমরা যারা চরম দুর্দশায় দিন কাটাচ্ছে, উগান্ডার মুসলিমরা যারা সেহেরী-ইফতারীতে কেবল পানি খেয়ে রোজা রাখছে, সিরিয়া, গাজা, আফগানিস্তান, ফিলিস্তিন সর্বত্র আমাদের ভাই-বোনেরা চরম কষ্টে আছে। কষ্টে আছে রোহিঙ্গা ভাই-বোনেরা যারা উদ্বাস্তু হয়ে আমাদের ও অন্যান্য দেশে আশ্রয় নিয়েছে- অজানা ভবিষ্যত তাদের। কাশ্মিরী ও উইঘুর মুসলিমরা একই অবস্থায় নিপতিত। ঈমান ও ইসলামের পথে সংগ্রাম করছে অমুসলিম দেশে বসবারসরত সব মুসলিম। বাংলাদেশের মুসলমানরা অনেক দিক থেকে এখনো নিরাপদে আছি। অনেকই নিজেদের দুর্দশার জন্য ভারতের বা সরকারের সমালোচনা করেন। বস্তুত: মুসলমানদের সমস্যার জন্য তারা নিজেরাই দায়ী। আল্লাহ বলেন,

"হে মুমিনগণ! তোমাদের দায়িত্ব তোমাদের উপর। তোমরা যদি সৎপথে পরিচালিত হও তবে যে পথভ্রষ্ট হয়েছে সে তোমাদের কোনোই ক্ষতি করতে পারবে না।"(সুরা মায়িদা ৫: ১০৫)

নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন না করলে আল্লাহ কারো অবস্থা নিজ থেকে বদলে দেন না।" (সুরা রাদ ১৩ : ১১)

আমরা কল্যাণ চাই। কল্যাণ আছে একমাত্র ইসলামে- দুনিয়ার ও আখিরাতের। ইসলামের পথে আগাই। কুরআন-হাদীস শিখি। পরিবারকে শিখাই। নিজেরা আমল করি। তাদের আমল করতে শিক্ষা দেই, উদ্বুদ্ধ করি। সমাজের মানুষদের জানাই। ইতিবাচক থাকি, উৎসাহ দেই। নিজেরা কল্যাণকর কাজ করি। আদর্শ স্থাপন করি। দোজাহানের মালিক আমাদের! মাফ করে দিন আমাদের, আমাদের সন্তানদের, আমাদের পরিবারের সদস্য, আমাদের জাতির মানুষদের সবাইকে, পাপী-তাপী-নেককার-বদকার সবাইকে। মাফ করে দিন আমাদের দ্বীন সম্পর্কে ভাই-বোন যে যেখানে আছে। সবাইকে নিরাপত্তা দিন, মাফ করে দিন মানবীয় সম্পর্কে আমাদের সব ভাই-বোন গোটা মানবজাতিকে। সবাইকে হেদায়েতের দিকে পরিচালিত করুন। এই মহামারী থেকে মুক্তি দিন। মাফ করে মুমিন-মুমিনা নারী-পুরুষ যারা কবরে শুয়ে আছেন- আমাদের মুরুব্বীরা, ইসলামের পথে পথিকেরা, গাফেল অথচ মুমিনেরা- সবাইকে মাফ করে দিন। আমাদের সবাইকে কবুল করে নিন, ইয়া রব্বাল আলামীন! ইয়া রব্বাল আলামীন!

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর