আপনি পড়ছেন

পবিত্র কুরআনে মহান রব্বুল আলামীন বলেন, “সেই দিন আমি জাহান্নামকে জিজ্ঞাসা করবো তুমি কি পূর্ণ হয়ে গেছ? জাহান্নাম বলবে, ‘আরও আছে কি?’ আর জান্নাতকে নিকটস্থ করা হবে মুত্তাকীদের, কোন দূরত্ব থাকবে না। এরই প্রতিশ্রুতি তোমাদেরকে দেয়া হয়েছিল প্রত্যেক আল্লাহ্-অভিমুখী হিফাযতকারীর জন্য যারা না দেখে দয়াময় আল্লাহকে ভয় করে এবং বিনীত হৃদয়ে উপস্থিত হয়-তাদেরকে বলা হবে, ‘শান্তির সাথে তোমরা তাতে প্রবেশ কর; এটা অনন্ত জীবনের দিন। এখানে তারা যা কামনা করবে তা-ই পাবে এবং আমার নিকট রয়েছে তার চেয়েও বেশি।” (সূরা ক্বাফ ৫০: ৩০ - ৩৪)

laylatul qadr 2021রমজানের শেষ দশকে নীরবে চোখের পানি ফেলে মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই, ফাইল ছবি

বহু মানুষের ধারণা, এত মানুষ নাফরমানী করছে তাদের সবাইকে কি রহমানুর রহীম জাহান্নামে দিবেন? কিভাবেই বা তা করবেন? আল্লাহ্ তা’লা আল-হাকিম, ন্যায় বিচারক। তিনি ইনসাফের দাবী পূরণ করবেনই। তাঁর জায়গার অভাব হবে না। আজকের মহাকাশ বিদ্যা আমাদের তেমনটিই জানাচ্ছে। একেকটা ব্ল্যাকহোল-এ একেকটা জগৎ ঢুকিয়ে দেয়া সম্ভব।

আল্লাহ তা’লা রহমানুর রহীম। তিনি কারো প্রতি যুলুম করেন না। করবেনও না। যার যা প্রাপ্য তা তিনি দিবেন। মুমিন, নেককারদের জন্য আছে তাঁর রহমত। তাদের তিনি তাদের প্রাপ্যের চেয়েও বহুগুণ দান করবেন। আল্লাহ্ তা’লা আমাদের সবাইকে তার রহমতের দিকে অগ্রসর করে দিন।

কুরআন-সুন্নাহর আলোকে জান্নাতী ও জাহান্নামীদের বিষয়ে আমাদের আলোচনা চলছিল। জান্নাতী বান্দাদের আরো কতিপয় বৈশিষ্ট্য:

* রসূলের সুন্নাহ্কে দৃঢ়ভাবে অবলম্বন করা

আল্লাহ্ তা’লা বলেন, “রসূল এ উদ্দেশ্যেই প্রেরণ করেছি যে, আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে তার আনুগত্য করা হবে।” (নিসা ৪: ৬৪)

তিনি আরো বলেন:

“কিন্তু না, তোমার রবের কসম! তারা মুমিন হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের নিজেদের বিবাদ-বিসম্বাদের বিচার ভার তোমার উপর (অর্থাৎ নবী (সা.)-এর উপর অর্পণ না করে; অতঃপর তোমার সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে তাদের মনে কোন দ্বিধা না থাকে এবং সর্বান্তকরণে তা মেনে নেয়।” (নিসা ৪: ৬৫)

রসূল (সা.)-এর সুন্নাতের অনুসরণ কোন ঐচ্ছিক বিষয় নয়। যেমনটা আজকে বহু মুসলমানের ধারণা। ‘এটা তো সুন্নাত’- এই বলে অবহেলা করা হয়। বহু দ্বীনি শিক্ষিত মানুষের মধ্যেও একই প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। নিজস্ব মাযহাব বা প্রচলিত ধ্যান-ধারণার বিপরীতে নবী (সা.)-এর সুন্নাত কোন আমল উপস্থাপন করলে তারা একান্তই অবহেলার সাথে তা প্রত্যাখ্যান করেন, নিজেদের সুন্নাহ্ বিরোধী আমল অব্যাহত রাখেন।

নবী (সা.) বলেন,

“আমার উম্মতের মধ্যে সবাই জান্নাতে যাবে, শুধু তারা নয় যারা প্রত্যাখ্যান করে। সাহাবীরা জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রসূলুল্লাহ্, কে প্রত্যাখ্যান করে? রসূল (সা.) বললেন, যারা আমার আনুগত্য করে তারা জান্নাতে যাবে। আর যারা আমার আনুগত্য করতে অস্বীকার করে মূলতঃ তারাই আমাকে প্রত্যাখ্যান করে। তারা জান্নাতকে প্রত্যাখ্যান করেছে, জান্নাতও তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে।” (মুসলিম)

অতএব, যারা সুন্নাহ্ বাদ দিয়ে মনগড়া বিশ্বাস অনুযায়ী শুধু কুরআন অনুসরণের দাবী করেন তারা সতর্ক হোন। বস্তুতঃ এদের কুরআন অনুযায়ী চলার দাবীও অসত্য। কারণ কুরআনেই রসূল (সা.)-এর সুন্নাহকে অনুসরণের পরিষ্কার নির্দেশ এসেছে। সতর্ক হোন তারাও যারা মাযহাব ইত্যাদির নামে সুন্নাহ্ বর্জন করে মনগড়া আমল করছেন।

* কবীরা গুনাহসমূহ বর্জন

কবীরা গুনাহ বা বড় বড় গুনাহসমূহ বর্জন করা জান্নাতী হওয়ার অন্যতম শর্ত। মহান আল্লাহ্ তা’লা বলেন “তোমাদেরকে যা নিষেধ করা হয়েছে তার মধ্যে যা গুরুতর তা থেকে বিরত থাকলে তোমাদের ছোট ছোট পাপগুলি আমি মুছে দিব এবং তোমাদের সম্মান ও মর্যাদার স্থানে দাখিল করবো।” (সূরা নিসা ৪: ৩১)

বড় বড় গুনাহগুলির বর্ণনা পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে এসেছে যেমন সূরা আনআম ৬: ১৫১-১৫৩, সূরা বনী ইসরাঈল ১৭: ৩য় ও ৪র্থ রুকু। এছাড়া নবী (সা.) তার হাদীসে বিভিন্ন সময় এগুলোর বর্ণনা দিয়েছেন। রসূলুল্লাহ্ (সা.) কবীরাহ গুনাহ সম্পর্কে যা বলেছেন, তা হল—

১. আল্লাহর সাথে শরীক করা
২. পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া
৩. কাউকে হত্যা করা
৪. মিথ্যা কথা বলা (মুসলিম: কিতাবুল ঈমান ১৬১)

অপর এক হাদীসে তিনি বলেন-

আমি কি তোমাদের সবচেয়ে বড় গুনাহ সম্পর্কে বলবো নাঃ তিনি বললেন, মিথ্যা কথা অথবা মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া। (মুসলিম: ১৬২)

তিনি (সা.) আরো বলেন:

ধ্বংসকারী সাতটি কাজ থেকে তোমরা বেঁচে থেকো। প্রশ্ন করা হল হে আল্লাহর রসূল সেগুলি কি? তিনি বললেন:

১) আল্লাহর সাথে শরীক করা,
২) যাদু করা,
৩) আল্লাহ্ যার হত্যা নিষেধ করেছেন যথার্থ কারণ ছাড়া তাকে হত্যা করা,
৪) ইয়াতীমের মাল অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ করা,
৫) সুদ খাওয়া,
৬) যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যাওয়া,
৭) সরলমনা ও ঈমানদার নারীর প্রতি অপবাদ আরোপ করা।” (মুসলিম: ১৬৩)

ইমাম যাহাবী (রহ.) কুরআন-সুন্নাহর আলোকে কবীরা গুনাহসমূহের একটা তালিকা করে দিয়েছেন তার “কিতাবুল কাবায়ের” নামক পুস্তকে। এটি বাংলায় ‘কবীরা গুনাহ’ ও একই নামে অনুবাদ হয়েছে। কবীরা গুনাহসমূহ জানা ও সেগুলি বাঁচার জন্য বইটি সহায়ক হবে।

* উন্নত চরিত্র গঠন

আনুষ্ঠানিক ইবাদাত বন্দেগীগুলির অন্যতম উদ্দেশ্য উন্নত চরিত্র গঠন ও নৈতিক পবিত্রতা অর্জন। যেমন-

- নামায বান্দাকে অশ্লীল ও খারাপ কাজ থেকে রক্ষা করে। (আনকাবূত ২৯: ৪৫)
- রোজা বান্দার মধ্যে মিথ্যা কথা ও মিথ্যা কাজ এবং জাহেলী আচরণ হতে বিরত থাকার যোগ্যতা পয়দা করে।

নবী (সা.) বলেন-

“তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই সর্বোত্তম যে নৈতিকতায় সর্বোত্তম।” (বুখারী)

তিনি (সা.) আরো বলেন,

তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তির চরিত্র ও আচরণ সর্বোত্তম, তোমাদের মধ্যে সে-ই আমার সবচেয়ে প্রিয় এবং কিয়ামতের দিনও আমার খুবই নিকটে থাকবে। তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি আমার নিকট সবচেয়ে ঘৃণ্য সে ব্যক্তি কিয়ামতের দিন আমার কাছ থেকে অনেক দূরে থাকবে। তারা হল বাচাল, ধৃষ্ট, নির্লজ্জ এবং মুতাফাইহিকুনরা। সাহাবারা বললেন, হে আল্লাহর রসূল, বাচাল, ধৃষ্ট, দাম্ভিকদের তো আমরা জানি, কিন্তু মুতাফাইহিকুন কারা? তিনি বললেন, অহংকারীরা।” (তিরমিযী)

অপর হাদীসে এসেছে-

“কিয়ামতের দিন মুমিনের দাড়িপাল্লায় সচরিত্র ও সদাচারণের চেয়ে বেশী ওজনদার আর কোনো জিনিস হবে না। কেননা আল্লাহ্ তা’লা অশ্লীল ও কটুভাষীকে ঘৃণা করেন।” (তিরমিযী)।

আমাদের জন্য এ হাদীসগুলির শিক্ষা খুবই জরুরি। অনেকেই নামায-রোজায় খুবই পাবন্দ। মসজিদে জামাতে সামনের কাতারে নিয়মিত, কিন্তু চারিত্রিক ও নৈতিক দিক দিয়ে খুবই দুর্বল। কপালে দাগ পড়ে গিয়েছে, পায়ে কড়া, কিন্তু লেন-দেন, কথা-বার্তা, আচার-আচরণ ও অন্যের অধিকার আদায়ে অনৈসলামী আচার-অভ্যাস ছাড়তে পারেননি। তারা এ হাদীসগুলি হতে সতর্ক হই।

* বেশী বেশী তাওবা ইস্তেগফার করা

আল্লাহ তা’লা বলেন,

“নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তাওবাকারী ও অপবিত্রতা থেকে যারা বেঁচে থাকে তাদের পছন্দ করেন।” (বাকারা: ২২২)

রসূলুল্লাহ (সা.) বলেন,

“আদম সন্তানরা সবাই গুনাহগার আর গুনাহগারদের মধ্যে সর্বোত্তম যারা তাওবা করে।” (তিরমিযী)

মানুষ গুনাহ করে। সে ভুলে যায়, অজ্ঞতার শিকার হয়, লোভ-লালসায় আক্রান্ত হয়। সাথে আছে শয়তানের ওয়াসওয়াসা। দুনিয়ার জীবন মানুষের জন্য এক পরীক্ষাগার। এতে প্রতিকূলতা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। মানুষ তাই ভুল করবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ভুল করার সাথে সাথে সে যদি মহান রব্বুল আলামীনের দিকে রজু করে, অনুতপ্ত হয়, ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং পুনরায় সে গুনাহ না করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়, আল্লাহ্ পাক তাকে ক্ষমা করে দিবেন। গুনাহর চিহ্নটুকুও রাখবেন না।

রসূল (সা.)- স্বয়ং দিনে ৭০ থেকে একশত বার তাওবা করতেন। এক বৈঠকে একশত বার পড়েছেন “রাব্বিগফিরলী ওয়াতুব আলাইয়্যা, ইন্নাকা আনতাত তাওওয়াবুর রহীম।”

“হে আমার রব! আমাকে ক্ষমা করুন, আমার তাওবা কবুল করুন, আপনিই তাওবা কবুলকারী ও দয়ালু।”

তাই জান্নাতী বান্দা-বান্দীদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য তারা বেশী বেশী তওবা করে। গুনাহর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে রব্বুল আলামীনের নিকট। গুনাহ মাফের সাওগাত নিয়ে রমজান মাস এসেছিল। আবার চলেও যাচ্ছে। গুনাহ কতটুকু মাফ করাতে পারলাম, প্রত্যেকে ভেবে দেখি। শবে কদরে অন্বেষা শুরু হয়ে গেছে। কোমড় বেঁধে লাগি সবাই। নিজ নিজ গুনাহ-খাতাগুলি সবাই জানি। সংশোধনে সচেষ্ট হই। বেশী বেশী তাওবা করি, আল্লাহর কাছে তাওফীক কামনা করি। মহান আল্লাহ্ তা’লা আমাদের ক্ষমা করুন।

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর