২০১৬ সালে যাদেরকে হারালাম আমরা
- Details
- by টোয়েন্টিফোর লাইভ নিউজপেপার
চলে গেলো ২০১৬। সামনে আরেকটি নতুন বছরের শুভ সমাগমের আনন্দে সবাই বিভোর। ঠিক তখনই একটু পিছনে ফিরে দেখা যাক। চলে যাওয়া ২০১৬-তে আমরা এমন কিছু মানুষকে হারিয়েছি যাদের অভাব নতুন বছরের পরতে পরতে অনুভব করবে বাংলাদেশ তথা সারা বিশ্ব।
এই মানুষগুলোর কেউ কেউ বাংলাদেশে ঈশ্বরের আসনে ছিলেন। আবার কারও কারও আবেদন ছিলো সারা বিশ্বজুড়ে। দেখে নিন, ২০১৬-তে কাদেরকে হারালো বাংলাদেশ ও বিশ্ব।
কবি রফিক আজাদ
দীর্ঘদিন গুরুতর অসুখে ভুগে অবশেষে ১২ মার্চ ইন্তেকাল করেন দেশের অন্যতম বিখ্যাত কবি রফিক আজাদ। ৭৬ বছর বয়সে মারা যাওয়া দেশের অন্যতম এ প্রধান কবি বছরের জানুয়ারি মাস থেকেই গুরুতর অসুস্থতায় ভুগছিলেন।
ওই মাসের প্রথম দিক থেকে শারিরীক অবস্থা খুব একটা ভালো যাচ্ছিল না কবির। ধীরে ধীরে অবস্থার অবনতি দেখে মাসের কয়েকদিন যাওয়ার পর ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয় তাকে। অবশেষে ওই হাসপাতালেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান রফিক আজাদ।
দেশের বিখ্যাত এ কবি ১৯৪১ সালে টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইলে জন্ম গ্রহণ করেন। ১৯৬০ এর দশকে কবি হিসেবে সুনাম কুড়ান তিনি। 'ভাত দে হারামজাদা, নইলে মানচিত্র খাবো'-সহ রফিক আজাদের বিভিন্ন কবিতার বহু পংক্তি বাংলা কবিতার ভক্তদের মধ্যে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
তিনি 'চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া', 'সীমাবদ্ধ জলে সীমিত সবুজে', 'পাগলা গারদ থেকে প্রেমিকার চিঠি', 'প্রিয় শাড়িগুলো', 'কোন খেদ নেই' ইত্যাদির মত বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ রয়েছে তার। কবিতার জন্য বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ও দেশের শীর্ষ সম্মান একুশে পদকও পেয়েছেন এ কবি।
নিউরোসার্জন রশিদ উদ্দিন আহমদ
২০ মার্চ রোববার মহাখালীর মেট্রোপলিটন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৭৯ বছর বয়সে মারা যান দেশের প্রথম নিউরোসার্জন রশিদ উদ্দিন আহমদ।
বছরের শুরুতে ৯ ফেব্রুয়ারি রশিদ উদ্দিন আহমদ হৃদরোগে আক্রান্ত হন। এরপর থেকে তিনি দীর্ঘদিন কোমায় ছিলেন। এরপর তার অবস্থা আরও খারাপের দিকে গেলে মহাখালীর মেট্রোপলিটন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে এবং সেখানেই তিনি মারা যান।
উল্লেখ্য, ১৯৭০ সালে দেশে প্রথম নিউরো সার্জারির রোগী দেখা শুরু করেন তিনি। ওই সময়ে রশিদ আহমদই ছিলেন ছিলেন একমাত্র নিউরোসার্জন। স্বাধীনতার পর রশিদ উদ্দিন তৎকালীন আইপিজিএমআর (বর্তমানে বিএসএমএমইউ)-এ নিউরোসার্জারি বিভাগ চালু করেন। পরবর্তীতে তার উৎসাহেই ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিউরোসার্জারি বিভাগ খোলা হয়।
অভিনেত্রী পারভিন সুলতানা দিতি
দীর্ঘদিন ক্যানসারে ভুগে ২০ মার্চ রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় না ফেরার দেশে পাড়ি জমান বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের কিংবদন্তী অভিনেত্রী পারভিন সুলতানা দিতি।
২০১৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে মস্তিষ্কে ক্যানসার ধরা পড়ে পরে দিতির। তারপর চিকিৎসার জন্য ভারতের মাদ্রাজ ইনস্টিটিউট অব অর্থোপেডিকস অ্যান্ড ট্রমাটোলজি (এমআইওটি) হাসপাতালে নেয়া তাকে। সেখানে তিন দফা চিকিৎসা করা হয় তার। তবুও তার অবস্থার কোন উন্নতি দেখা যায়নি। বরং রেডিয়েশনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ‘পারকিনসন’ রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন এ তারকা।
১৯৬৫ সালে ঢাকার নারায়ণগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন গুণী এই অভিনেত্রী। ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রাঙ্গনে দেখা দেয় নতুন মুখের সঙ্কট। তখন এক প্রতিভা অন্বেষণ কার্যক্রম থেকে উঠে আসেন দিতি। তিনি দুইশরও বেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। তার অভিনীত প্রচুর ছায়াছবি এই সময়ের দর্শকদের কাছেও তুমুলভাবে জনপ্রিয়।
গেরিলা যোদ্ধা ডা. মোরশেদ চৌধুরী
মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের সাফল্যের অন্যতম কৌশল ছিল গেরিলা আক্রমণ। রণাঙ্গনের সেই সব সময়ে যারা গেরিলা হিসেবে যুদ্ধ করেছেন তাদের একজন ডা. মোরশেদ চৌধুরী। ১৪ এপ্রিল বৃহস্পতিবার ভোর রাতে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৭ বছর।
যুদ্ধের সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন মোরশেদ চৌধুরী। সে সময় যুদ্ধ শুরু হলে গেরিলা বাহিনীর ক্র্যাক প্লাটুনে যোগ দেন মোরশেদ চৌধুরী।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের ত্রিপুরার বিশ্রামগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তৈরি অস্থায়ী বাংলাদেশ হাসপাতালের চিকিৎসক ছিলেন ডা. মোরশেদ। ওই হাসপাতালই পরে দেশে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র হিসাবে পরিচিতি পায়। ডা. মোরশেদ ছিলেন হাসপাতালটির উপদেষ্টা।
নুরজাহান বেগম
বাংলাদেশের নারী সাংবাদিকতার পথিকৃত এবং দেশের প্রথম নারী বিষয়ক সচিত্র পত্রিকা ‘বেগম’-এর সম্পাদক নুরজাহান বেগম ২৩ মে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে ৯১ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন।
নুরজাহান বেগম নারী সাংবাদিকতায় সুনাম অর্জন করার পাশাপাশি সুদীর্ঘ ছয় দশক ‘বেগম’ পত্রিকা সম্পাদনা করেন। এই পত্রিকাটিকে এক সময় বাংলাদেশের নারীদের মুখপত্র বলা হতো। পত্রিকাটিতে সাধারণত মুসলিম নারীদের এগিয়ে যাওয়া এবং তাদের অনুপ্রেরণাদায়ক লেখা প্রকাশ করা হতো।
নুরজাহান বেগম বিখ্যাত সাংবাদিক মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিনের মেয়ে ছিলেন, যদিও তিনি সওগাত সম্পাদক নাসির নামে বেশি পরিচিত। নুরজাহান বেগমের স্বামী আরেক বিখ্যাত সাংবাদিক রোকনুজ্জামান খান। তিনি দৈনিক ইত্তেফাকের কচি কাঁচার আসরের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন।
বেগম পত্রিকাটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন নুরজাহান বেগমের বাবা নাসিরুদ্দিন। তৎকালীন কলকাতা থেকে প্রকাশ পেতো বেগম। পরে ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর ঢাকায় চলে আসে বেগম-এর কার্যালয়। বেগম-এর সম্পাদনা থেকে প্রকাশ করা পর্যন্ত, সব কাজে সরাসরি অংশগ্রহণ করতেন নুরজাহান।
সাংবাদিকতায় অনুপ্রেরণাদায়ক অবদানের জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন নুরজাহান বেগম। সাংবাদিকাতার পাশাপাশি সমাজ সেবায়ও আগ্রহ ছিলো তার। ২০১১ সালে একুশে পদক পান তিনি। এ ছাড়া রোকেয়া, একাধিক আজীবন সম্মাননা, বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং ইউনিসেফসহ আরো নানা পুরস্কার পান তিনি।
১৯৪৬ সালের মুক্তি সংগ্রামে নানাভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি। এ ছাড়া কলকাতা দাঙ্গার সময় শিশুদের জন্য অনাথাশ্রমের সঙ্গেও কাজ করেছেন তিনি। পরে ১৯৪৭ সালে মুসলিম নারী ও শিশুদের জন্য অনাথাশ্রম প্রতিষ্ঠাও করেছিলেন নুরজাহান বেগম। বাংলাদেশ সৃষ্টির পর দেশের প্রথম নারীদের সংগঠন ‘দ্য বেগম ক্লাব’ প্রতিষ্ঠায়ও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন তিনি। এছাড়া বিভিন্ন নারী সংগঠনের নানা কাজে তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন। এর মধ্যে আছে ওয়ারি মহিলা সমিতি ও নারিন্দা মহিলি সমিতি।
মোহাম্মদ আলি
২০১৬ সালের ৩ জুন পৃথিবীবাসী হারায় সর্বকালের সেরা অ্যাথলেট মোহাম্মদ আলিকে। ৭৪ বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রের ফিনিক্স-এরিয়া হাসপাতালে মারা যান তিনি।
মৃত্যুর আগের ৩২ বছর ধরে ‘পারকিনসন’ রোগে ভুগে নানা যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে আলিকে। পারকিনসন রোগের কারণে আলির শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ নিশ্চল হয়ে পড়েছিলো। শেষ পর্যন্ত তিন তিনবার বিশ্ব হেভিওয়েট বক্সিংয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়া এই মহাতারকা বিশ্ববাসীকে কাঁদিয়ে ইহলোক ত্যাগ করেন।
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আলি ছিলেন মুসলমানদের অধিকার আদায়ে সচেতন। তৎকালীন রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রে মুসলমানদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হোক বলে মন্তব্য করেছিলেন। তার কথার প্রতিবাদ করেছিলেন আলি।
আলি বলেছিলেন, ‘মুসলমান হিসেবে আমাদের উচিত ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া। কারণ তাদেরকে প্রতিহত করা দরকার, যারা ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের জন্য ইসলামের নাম ব্যবহার করে।’
মোহাম্মদ আলি জন্ম গ্রহণ করেছিলেন খ্রিস্টান পরিবারে। ১২ বছর বয়সে বক্সিং শেখা শুরু করেন তিনি। ২২ বছর বয়সে জিতে নেন প্রথম বিশ্ব হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়নশিপ। এর কিছুদিন পরই ধর্ম বদলে ইসলাম গ্রহণ করেন তিনি। ক্যাসিয়াস ক্লে থেকে তার নাম হয় মোহাম্মদ আলি। জীবনের শেষ দিকে সুফিবাদ নিয়েও আলির আগ্রহ লক্ষ্য করা গেছে।
বক্সিংয়ে মোট ৬১টি ফাইটে রিংয়ে নেমেছেন তিনি। জিতেছেন ৫৬টিতেই। হেরেছেন মাত্র পাঁচটি ফাইট। আলিকে কেনো সর্বকালের সেরা বলা হয়, তার একটা যুক্তি কিন্তু এখানেই আছে।
মোহাম্মদ আলি তার জীবনজুড়ে বিশ্বের সব মানুষের অনন্ত অনুপ্রেরণার উৎস ছিলেন। সম্রাজ্যবাদের বিপক্ষে সারা জীবন নিজের কঠোর অবস্থান বজায় রেখেছিলেন এই মহাতারকা। তার মৃত্যুতে নিশ্চিতভাবেই শোকের ছায়া নেমে আসে বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনে।
অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিয়া
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিয়া ইন্তেকাল করেন ১৩ জুন। রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।
৮১ বছর বয়সী মনিরুজ্জামান মিয়াকে বার্ধক্যজনিত রোগে আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিলো। সেখানেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
অধ্যাপক মনিরুজ্জামান কখনো বিয়ে করেননি। সারা জীবন একা কাটিয়ে দেয়া মনিরুজ্জামান ১৯৩৫ সালে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন।
অধ্যাপক মনিরুজ্জামান ১৯৬১ সালে ফ্রান্সের প্যারিসের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেন। ১৯৯০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব দেয়া হয় তাকে। ১৯৯২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
অভিনেতা ফরিদ আলী
‘দুবাই যামু টাকা দ্যান’ –সংলাপখ্যাত বর্ষীয়ান অভিনেতা ফরিদ আলী মারা যান ২২ আগস্ট। ঢাকার মিরপুর হৃদ্রোগ ইনস্টিটিউটে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া এই অভিনেতা দীর্ঘদিন ধরে তিনি হৃদরোগে ভুগছিলেন। তার মৃত্যুর খবরে টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রাঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে আসে।
মূলত হাস্যরসাত্মক অভিনয়ের মাধ্যমে মানুষের মনে জায়গা করে নেন ফরিদ আলী। তার ‘দুবাই যামু টাকা দ্যান’ সংলাপ এখনও মানুষের মুখে মুখে ঘুরে। অভিনয়ের পাশাপাশি নাটক লেখা ও নির্দেশনায় দক্ষ ছিলেন ফরিদ আলী।
সবার প্রিয় এই অভিনয়শিল্পী ১৯৬২ সালে ‘নবজন্ম’ নাটকের মধ্য দিয়ে টিভি নাটকে প্রথম হাজির হন। তবে এর আগে থেকেই তিনি মঞ্চনাটকে অভিনয় করছেন। ১৯৬৬ সালে ‘ধারাপাত’ ছবির মাধ্যমে চলচ্চিত্রাঙ্গনে প্রবেশ করেন তিনি।
এরপর বহু জনপ্রিয় ছবিতে অভিনয় করেছেন ফরিদ আলী। এর মধ্যে রয়েছে, চান্দা, দাগ, জীবন তৃষ্ণা, স্লোগান, অধিকার ইত্যাদি।
কবি শহীদ কাদরী
২৮ আগস্ট অন্তিম নিস্তব্ধতায় শায়িত হন বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম প্রধান কবি শহীদ কাদরী। ‘রাষ্ট্র মানে লেফট রাইট’ কিংবা ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’-এর মতো কবিতার জন্ম দেয়া এই কবি নিউইয়র্কের একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
১৯৪৭ সালে শহীদ কাদরী ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। শহরে বেড়ে উঠা কবির লেখায় সব সময়ই নানাভাবে উঠে এসেছে শহরের নানা রূপ। তীব্র জীবনবোধ সম্পন্ন শহীদ কাদরীর ভাষায় বহু নাগরিক ভাবনা উঠে এসেছে নতুন রকম সঞ্জীবনী সুধা নিয়ে।
শহীদ কাদরী কবিতায় অনবদ্য অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি এবং একুশে পদক পেয়েছেন। ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত হয় কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ উত্তরাধিকার। এরপর দেশ স্বাধীন হওয়ার তিন বছর পর, ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত হয় কবির অনবদ্য সৃষ্টি তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা।
কাব্যভাষায় বৈচিত্র এবং নাগরিক জীবনের নানা দিক তুলে ধরার দারুণ প্রচেষ্টার মধ্যেই কবি দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করেন। বেশ কবিতামুখী শহুরে মানুষের কাছে তিনি হয়ে উঠেন আপনজনের মতো।
কবির তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই। এরপর ২০০৯ সালে প্রকাশিত হয় শহীদ কাদরীর সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও। ২০১৬ সালে শহীদ কাদরীর মৃত্যুর মাধ্যমে বাংলাদেশের সাহিত্য জগত উজ্জ্বল এক নক্ষত্রকেই হারালো।
কথাসাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হক
‘জাগো বাহে কোনঠে সবাই’ –বলে হাঁক দেবার জন্য আর রইলেন না সব্যসাচী লেখক কথাসাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হক। ২৭ সেপ্টেম্বর বিকেলে না ফেরার দেশে চলে যান নুরলদীনসহ আরও বহু বিখ্যাত চরিত্রের এই স্রষ্টা।
সব্যসাচী এই লেখক ফুসফুসে ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন। ২০১৬ সালের ১৫ই এপ্রিল চিকিৎসার জন্য সস্ত্রীক লন্ডনে যান তিনি। লন্ডনে জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা কর্তৃপক্ষের নিয়মিত চিকিৎসকের মাধ্যমে চিকিৎসা চলে তার। তার দেখভাল করেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ম্যাকডোনাল্ড। লন্ডনের রয়্যাল মার্সডেন হাসপাতালে কয়েকদিন ভর্তিও ছিলেন এই লেখক।
ক্যান্সারের কেমোথেরাপি নেন ক্যানসার চিকিৎসার জন্য খ্যাত চেলসি অ্যান্ড ওয়েস্টমিনিস্টার হাসপাতালে। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়েও তার রোগমুক্তি মেলেনি।
এরপর ২০১৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর তিনি দেশে ফিরে আসেন। সে সময় মৃত্যুর কারণে তিনি ভীত নন বলেও গণমাধ্যমের কাছে জানিয়েছিলেন এই কালজয়ী লেখক।
প্রবীণ রাজনীতিবিদ আ স ম হান্নান শাহ
২৭ সেপ্টেম্বর ভোরে সিঙ্গাপুরের র্যাফেল হার্ট সেন্টারে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ স ম হান্নান শাহ। দীর্ঘদিন হৃদরোগে ভুগছিলেন হান্নান শাহ।
হান্নান শাহ সেনাবাহিনীর একজন কর্মকর্তা ছিলেন। সেনাবাহিনী থেকে অবসরের পর বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় হন। ২০০১ সালে বিএনপির শাসনামলে পাট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন হান্নান শাহ।
জুনকো তাবেই
এ বছরের ২২ অক্টোবর এভারেস্ট জয়ী প্রথম নারী জুনকো তাবেই মারা যান। জাপানের এই পর্বতারোহী আজ থেকে প্রায় ৪০ বছর আগে এভারেস্ট জয় করেছিলেন। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে প্রায় ৭৭ বছর বয়সে মারা যান তিনি।
জাপানের সাইতামা শহরের একটি হাসপাতালে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন জুনকো তাবেই। ২০১২ সাল থেকে তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন। এভারেস্টের কাছে হার না মানলেও শেষ পর্যন্ত ক্যান্সারের কাছে হেরে চলে যান না ফেরার দেশে। সত্তরের দশকে প্রতিকূল সামাজিক পরিবেশে এভারেস্ট জয় করা এই নারী বিশ্বব্যাপী ব্যাপক সমাদৃত ছিলেন।
তাবেই ৩৫ বছর বয়সে ১৯৭৫ সালের মে মাসে এভারেস্ট জয় করেন। পরে তিনি ১৯৯২ সালে তিনি বিশ্বের আরো সাতটি সাতটি সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গে আরোহণ করেন।
এভারেস্ট জয় করতে গিয়ে তাবেই তুষার ধসে চাপা পড়ে প্রায় মরতেই বসেছিলেন। গাইডের মাধ্যমে কোনরকম প্রাণে বাঁচলেও তিনি সেবার অভিযান বাতিল করেননি। প্রায় মরতে বসা অদম্য এই নারীই তখন বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গে পা রেখে রেকর্ড করেন। সর্বশেষ ২০১৬ সালের জুলাইয়ে জাপানের মাউন্ট ফুজির চূড়ায় উঠেন তিনি।
জীবিত থাকাকালীন ২০১২ সালে জাপানের একটি গণমাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাতকারে তাবেই বলেন, '৭০-এর দশকে জাপান ছিল একটা অনগ্রসর জাতি। নারীদের বিষয়ে তাদের ধ্যানধারণা ছিল ভিন্ন। তারা মনে করতো মেয়েরা শুধু ঘরের ভেতরে কাজ করবে আর বাইরের কাজ শুধুই পুরুষদের জন্য। এভারেস্ট জয়ের আগে এমন প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে জিততে হয়েছে আমাকে।
জাতীয় অধ্যাপক ডা. এম আর খান
৫ নভেম্বর রাজধানীর সেন্ট্রাল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান বাংলাদেশে শিশু চিকিৎসার জনক জাতীয় অধ্যাপক ডা. এম আর খান। বার্ধক্যজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে ৮৮ বছর বয়সে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
বাংলাদেশে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে বহুল পরিচিত ডা. এম আর খান। ছিলেন বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপক। দেশের শিশুস্বাস্থ্য ও শিশু চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনকও বলা হয় তাকে।
স্বনামধন্য এই ডাক্তারের পুরো নাম রফি খান। ১৯২৮ সালের ১ আগস্টে তিনি সাতক্ষীরায় জন্মগ্রহণ করেন।
চিকিৎসাখাতে অনন্য অবদান রেখেছেন ডা. এম আর খান। গড়ে তুলেছেন বিভিন্ন চিকিৎসা ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। চাকরি শেষে সরকারের কাছে পাওয়া পেনশনের টাকায় গড়েছেন ডাঃ এম আর খান-আনোয়ারা ট্রাস্ট। যেখানে গরীব মা ও শিশুদের চিকিৎসা সেবা, অর্থনৈতিক-সামাজিক উন্নয়নে শক্তিশালী ভূমিকা রাখা হয়। তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টাতেই গড়ে উঠেছে জাতীয় শিশুস্বাস্থ্য ফাউন্ডেশন।
সর্বজন শ্রদ্ধেয় এই ডাক্তারই প্রতিষ্ঠা করেছেন শিশু স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, সাতক্ষীরা শিশু হাসপাতাল, যশোর শিশু হাসপাতালসহ দেশব্যাপী অসংখ্য প্রতিষ্ঠান। দেশ থেকে পোলিও দূরীকরণ এবং ধূমপানবিরোধী বিভিন্ন কার্যক্রমেও ছিলেন বেশ সক্রিয়।
ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত ইন্টারন্যাশনাল হু ইজ হু অব ইন্টেলেকচুয়াল প্রকাশনায় স্থান পেয়েছে মহান এই মানুষটির জীবনী।
চিকিৎসা সেবায় বিশেষ অবদানের জন্য তিনি পেয়েছেন স্বাধীনতা পদক, একুশে পদকসহ অনেক পুরস্কার।
ফিদেল কাস্ত্রো
কিউবার বিপ্লবী নেতা এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রো ২৬ নভেম্বর পাড়ি জমান না ফেরার দেশে। ৯০ বছর বয়সি এই নেতার বিশ্বজুড়ে লাখো ভক্ত রয়েছে।
দেশবাসীর উদ্দেশ্যে ফিদেল কাস্ত্রোর মৃত্যুর সংবাদ রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে ঘোষণা করেন দেশটির বর্তমান প্রেসিডেন্ট ও ফিদেল কাস্ত্রোর ভাই রাউল কাস্ত্রো।
প্রথম জীবনে একজন জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক নেতা ও পরে সমাজতন্ত্রী বিপ্লবী হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাকের ডগায় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে বিশ্ব জুড়ে নজির স্থাপন করে গৌরব অর্জন করেন ফিদেল কাস্ত্রো ।
১৯২৬ সালের ১৩ আগস্ট কিউবার পূর্বাঞ্চলে বিরান জেলায় স্পেনীয় বংশোদ্ভূত এক অসচ্ছল অভিবাসী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন কিউবা বিপ্লবের এই কমান্ডার ইন চিফ।
মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতা
৫ ডিসেম্বর মারা যান দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ুর জনপ্রিয় নেত্রী ও সেখানকার মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতা। হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়ে অ্যাপোলো হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন তামিলনাড়ুর ছয়বারের মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতা। এরপর সেখানেই মারা যান।
জয়ললিতাকে স্থানীয় সমর্থকরা ‘আম্মা’ বলে সম্বোধন করতেন। এতেই বোঝা যায় তিনি কতোটা জনপ্রিয় ছিলেন। এক সময় ভারতীয় চলচ্চিত্রে কাজ করা জয়ললিতার প্রধান অসুস্থতা ছিলো ফুসফুসে সংক্রমণজনিত সমস্যা।
তার মৃত্যুর পর চেন্নাইয়ে নেমে আসে যারপরনাই শোক। হাজার হাজার সমর্থক হাসপাতালের সামনে ভিড় করেন। তাদের কান্নায় ভারি হয়ে উঠে সেখানকার পরিবেশ।
মাহবুবুল হক শাকিল
একাধারে রাজনীতিবিদ, বিশিষ্ট কবি এবং লেখক মাহবুবুল হক শাকিল মারা যান ৬ ডিসেম্বর। রাজধানীর গুলশানস্থ একটি রেস্তোরাঁয় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন।
কর্মজীবনে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ জনপ্রিয় সাবেক এই ছাত্র নেতা এর আগে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী (মিডিয়া) ও উপ-প্রেস সচিব হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
মাহবুবুল হক শাকিল ১৯৬৮ সালে ময়মনসিংহ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। শাকিলের বাবা আইনজীবী এবং মা শিক্ষকতা করেন। তিনি প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন।
গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...
খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর
Discover extraordinary stories from around the world with our exceptional news coverage. From uplifting human interest stories to groundbreaking scientific discoveries, we bring you the best of the best. Stay informed about the latest breakthroughs in technology, medicine, and beyond, and explore the world's most fascinating cultures and communities. Get inspired and informed with our exceptional news coverage.