ইথিওপিয়ায় নতুন রোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র: যেভাবে চীনের কাছে আফ্রিকাকে হারিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র
- Details
- by আন্তর্জাতিক ডেস্ক
ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবার ঠিক দক্ষিণে ৮০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে নির্মাণাধীন আফ্রিকান রোগ নিয়ন্ত্রণের সদর দপ্তরের কাজ একদম শেষ পর্যায়ে। চীনের সার্বিক সহযোগিতা এবং অর্থায়নে এটি নির্মিত হচ্ছে। এই প্রকল্প নিয়ে চীনের সঙ্গে মার্কিন সরকারের মতবিরোধ থাকলেও চীন এর নির্মাণ কাজ প্রায় সম্পন্ন করে ফেলেছে।
ইথিওপিয়ায় নতুন রোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র: যেভাবে চীনের কাছে আফ্রিকাকে হারিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র
গত জুলাই মাসেই রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ দপ্তরের নির্মাণাধীন ভবনটি পরিদর্শন করেছেন আফ্রিকান ইউনিয়নে চীনের নবনিযুক্ত মিশন প্রধান হু চ্যাংচুন। চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কর্পোরেশন (সিসিইসিসি) কর্তৃক নির্মিত এই প্রকল্পটি এই বছরের শেষের দিকে সমাপ্ত হবে।
এ প্রসঙ্গে হু বলেন, চীন এবং আফ্রিকান ইউনিয়নের (এইউ) মধ্যে এই ফ্ল্যাগশিপ প্রকল্পটি চালু হলে আফ্রিকাতে রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে। এই প্রকল্পটি প্রায় ৯০ হাজার বর্গ মিটার এলাকাlজুড়ে বিস্তৃত, যার মধ্যে পুরো ভবনটি প্রায় ৪০ হাজার বর্গ মিটারের।
নির্মান শেষে, এই আফ্রিকান সিডিসি বিল্ডিংটিতে থাকবে একটি জরুরি অপারেশন সেন্টার, একটি ডেটা সেন্টার, একটি পরীক্ষাগার, প্রশিক্ষণ ও সম্মেলন কেন্দ্র এবং ব্রিফিং রুম। সেই সঙ্গে অফিস এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের থাকার ব্যবস্থাও থাকবে এখানে। আর এই সবকিছুই চীন সরকারের দ্বারা নির্মিত এবং সজ্জিত হবে বলে জানা গেছে।
এই প্রকল্প শেষে দ্বিতীয় পর্যায়ে মিশর, গ্যাবন, কেনিয়া, নাইজেরিয়া এবং জাম্বিয়ায়ও আফ্রিকান সিডিসির পাঁচটি আঞ্চলিক সহযোগিতা কেন্দ্র নির্মাণ করবে চীন।
এদিকে, চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আফ্রিকা বিষয়ক বিভাগের মহাপরিচালক উ পেং বলেছেন, আফ্রিকায় সিডিসি সদর দপ্তর ‘চীন-আফ্রিকা সহযোগিতার একটি বড় প্রকল্প’ যা ‘আফ্রিকার জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সক্ষমতা আরও বৃদ্ধি করবে এবং চীন-আফ্রিকা সংহতির একটি অনন্য মাত্রায় পরিণত হবে।’
এই আফ্রিকান সিডিসি মূলত মার্কিন সিডিসির আদলে তৈরি করা হয়েছে। ২০১৫ সালে পশ্চিম আফ্রিকায় উদ্ভূত ইবোলা সংকটের প্রতিক্রিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে ভূমিকা রেখেছিল, সেখান থেকেই এই ধারণাটি শুরু হয়। যদিও এই প্রকল্পটি শুরু হয়েছিল মার্কিন-চীন সহযোগিতার যৌথ প্রকল্প হিসেবে, এর মূল উদ্দেশ্য ছিল আফ্রিকান দেশগুলোকে বিভিন্ন রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সহায়তা প্রদান করা। তবে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে এই প্রকল্প ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফাঁদে পড়েছিল।
২০১৫ সালের এপ্রিলে মার্কিন সরকার এবং আফ্রিকান ইউনিয়নের মধ্যে সিডিসি তৈরির জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যার অধীনে মার্কিন সরকার প্রযুক্তিগত দক্ষতা প্রদান এবং প্রকল্পটির নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য এক ডজন সদস্যকে পাঠাতে সম্মত হয়। এছাড়াও তারা ১০ জন আফ্রিকান মহামারি বিশেষজ্ঞের জন্য আফ্রিকা সিডিসিতে ফেলোশিপ প্রদানেও রাজি হয়েছিল।
একই বছরের জুনে, একটি দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে একজন চীনা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা জানান, আমেরিকা এবং চীন আফ্রিকান সিডিসি তৈরির জন্য এইউকে সাহায্য করার পরিকল্পনা করছে এবং ওই বছর সেপ্টেম্বরে যখন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন, তখন দুই দেশ আফ্রিকায় সিডিসি নির্মাণে আফ্রিকান ইউনিয়নকে সহযোগিতা করতে সম্মত হয়।
পরে ২০১৬ সালে চীন-এইউ এর মাঝে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যেখানে চীন তাদের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ প্রদান করতে সম্মত হয়। কিন্তু যখন মার্কিন সরকার তাদের বিদেশি সাহায্য কমানোর পরিকল্পনা করলে এই মার্কিন-চীন চুক্তি বাতিল হয়ে যায়।
ট্রাম্পের আমলে দুই দেশের প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেড়ে যাওয়ায় দুই পরাশক্তির মধ্যে সহযোগিতা ভেঙে পড়ে। ফলে চীনের সামনে সুযোগ আসে, এককভাবে এই প্রকল্পটি নির্মাণ করার। ২০২০ সালের জুনে শি জিন পিং এক ঘোষণায় জানান, ‘চীন এই বছর আফ্রিকান সিডিসির সদর দপ্তরের নির্মাণকাজ নির্ধারিত সময়সূচির আগেই শুরু করবে।’
আফ্রিকার সিডিসি সদর দপ্তর কে তৈরি করবে, তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক ছিল। এর মাঝেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনকে, ‘আফ্রিকার জিনোমিক ডেটা’র ওপর গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে অভিযুক্ত করে- ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে একজন মার্কিন কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে এমনটাই জানিয়েছিল ফিনান্সিয়াল টাইমস।
অন্যদিকে, চীনের ওইসব প্রতিবেদনগুলোকে ‘হাস্যকর’ বলে অভিহিত করে। তৎকালীন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মুখপাত্র হুয়া চুনয়িং সে সময় বলেছিলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কিছু ব্যক্তি সবসময় তাদের নিজস্ব অনুমানের ভিত্তিতে ভ্রান্ত কথা বলে।
এদিকে, জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের এলিয়ট স্কুল অফ ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের অধ্যাপক এবং আদ্দিস আবাবার প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিড শিন জানান, আফ্রিকান সিডিসিকে সমর্থন করার বিষয়ে মার্কিন-চীন অংশীদারিত্ব সেই সময় শুরু হয়েছিল যখন তাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও সৌহার্দ্যপূর্ণ ছিল। তখন ইউএস সিডিসি ও বিল এবং মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন বেশিরভাগ সহায়তা প্রদান করেছিল। তবে ২০১৮ সালে যখন মার্কিন-চীন সম্পর্কের অবনতি হয়, রখন এইউ-চীন এই বিষয়ে সম্মত হয় যে চীন সরকার এই আফ্রিকান সিডিসির সদর দপ্তর তৈরি করবে।
শিন জানান, ওয়াশিংটন দৃঢ়ভাবে এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিল, কিন্তু সে সময় চীনকে তারা আটকাতে পারেনি।
এ প্রসঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার স্টেলেনবোশ ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড কমপারেটিভ পলিটিক্সের গবেষণা ফেলো টিম জাজন্টজ বলেছেন, কোভিড-১৯ মহামারি চীনকে জনস্বাস্থ্য খাতকে তার নতুন শক্তির জায়গা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করেছে।
জাজন্টজ জানান, গত বছরের ডাকারে অনুষ্ঠিত চীন-আফ্রিকা সহযোগিতা ফোরামে যখন চীন স্বাস্থ্য খাতে সহযোগিতা আরও বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তখন তিনি মোটেও অবাক হননি।
জার্মানির ফ্রেইবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রভাষক জাজন্টজ আরও বলেন, আফ্রিকান ইউনিয়নে সিডিসির সদর দপ্তর বেইজিংয়ের আরেকটি সুনির্ধারিত লক্ষ্যপূরণের উদাহরণ মাত্র। এই প্রকল্প এটা প্রমাণ করছে যে- শুধুমাত্র আফ্রিকান সরকারই নয়, আঞ্চলিক সংস্থাগুলোও তাদের অংশীদারদের খুব বাস্তবসম্মতভাবে বেছে নেয়।
চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে দীর্ঘকাল ধরে ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা চলে আসছে। তারা একটা লম্বা সময় আফ্রিকান আঞ্চলিক সংস্থাগুলোকে অর্থায়ন করেছে।
প্রাক্তন মার্কিন কর্মকর্তা এবং বর্তমানে সিএসআইএস আফ্রিকা থিঙ্ক ট্যাঙ্কের একজন সিনিয়র সহযোগী ক্যামেরন হাডসন জানিয়েছেন, যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই চুক্তিটি জেতার করার চেষ্টা করেছে, তবুও ওয়াশিংটন আফ্রিকায় চীনা অবকাঠামো নির্মাণের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে সফল হতে পারেনি।
হাডসন বলেছেন, আফ্রিকান সিডিসিকে একটি ব্যতিক্রমী প্রকল্প হিসাবে দেখা হয়েছিল কারণ ওয়াশিংটনের একটি প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যেই প্রচুর সময়, মনোযোগ, অর্থায়ন এবং এমনকি কর্মীদেরকেও এই কাজের জন্য আফ্রিকায় পাঠিয়েছিল। এটি নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ থেকেও একটি চ্যালেঞ্জ ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, অনেক মার্কিন সরকারী কর্মচারী আফ্রিকান সিডিসিতে কাজ করছিল ।
হাডসন জানান, যেহেতু চীনের নজরদারি ডিভাইস ব্যবহার করার ইতিহাস রয়েছে, তাই তাদের নির্মিত একটি ভবনে মার্কিন কর্মীদের কাজ করানো এবং ওই প্রকল্পে ওয়াশিংটন তাদের অপারেশনাল সম্পর্ক চালিয়ে যেতে সক্ষম হবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। তবে ওয়াশিংটন তার আফ্রিকান অংশীদারদের এটাও জানিয়েছিল যে, তাদের চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র- যে কোন এক দেশের সঙ্গে কাজ করার মধ্যে কোনটি বেছে নেওয়ার প্রয়োজন নেই।
এদিকে, ওয়াশিংটনের জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির ও’নিল ইনস্টিটিউট ফর ন্যাশনাল অ্যান্ড গ্লোবাল হেলথ ল’-এর পরিচালক লরেন্স গোস্টিন, চীন কীভাবে তার বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অংশ হিসেবে আফ্রিকার অবকাঠামোতে অর্থায়ন করছে তার দিকে ইঙ্গিত করেছেন।
গোস্টিন জানান, চীন আফ্রিকায় তার ভূ-কৌশলগত স্বার্থের কারণে স্বাস্থ্য অবকাঠামো প্রকল্পগুলোকে ব্যবহার করে আফ্রিকায় নিজেদের অবস্থান শক্ত করার চেষ্টা করছে।
এই বিশেষজ্ঞ জানান, আফ্রিকার জনস্বাস্থ্য খাত বদলে দেওয়ার পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি লম্বা ইতিহাস রয়েছে। আফ্রিকান সিডিসির পুরো ধারণা তৈরি করার পরেও, চীনকে এই সদর দপ্তর নির্মাণের সুযোগ করে দেওয়া এবং তা নিয়ে চীনকে বড়াই করতে দেওয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বড় ভুল ছিল। এটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব লক্ষ্য হওয়ার কথা ছিল।
গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...
খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর
Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.
Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.