ইউরোপে কয়লা এখন স্বর্ণ, লাকড়িও মহার্ঘ

গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটে জেরবার ইউরোপের মানুষ আসন্ন শীতে ঘরদোর উষ্ণ রাখার কথা ভাবতেই দিশেহারা বোধ করছে। মরিয়া হয়ে অনেকে অগতির গতি হিসেবে পরিচিত জ্বালানি কয়লা ও লাকড়ি মজুতের চেষ্টা করছেন। লাকড়ির দাম বেড়েছে বেশ কয়েকটি দেশে। দুর্লভ হয়ে পড়া কয়লাকে কেউ কেউ ‘নতুন স্বর্ণ’ অভিহিত করেছেন। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এসব চিত্র উঠে এসেছে।

ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে লাকড়ির দাম ও সংকট বেড়েছে বলে ওয়াশিংটন পোস্ট জানিয়েছে

ড্যানিশ দৈনিক পলিটিকেন জানিয়েছে, ডেনমার্কের কয়েকটি ব্যাংক শীত মৌসুমের প্রস্তুতি হিসেবে কর্মী ও গ্রাহকদের মাঝে ইলেকট্রনিক ব্ল্যাংকেট বিতরণ শুরু করেছে। শীত মৌসুমে ব্ল্যাকআউটের জন্য প্রস্তুত থাকতে গ্রাহকদের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে ডেনমার্কের বিতরণ সংস্থা। একই ধরনের আহ্বান এসেছে ফিনল্যান্ডের বিতরণ সংস্থার পক্ষ থেকে।

সাউথ চায়না মর্নিং নিউজ জানিয়েছে, বিগত দুই মাসে চীন থেকে ইউরোপে ইলেকট্রনিক ব্ল্যাংকেট রপ্তানি বেড়েছে। নতুন কার্যাদেশের চাপ সামলাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন চীনা সরবরাহকারকরা।

স্পেনিশ দৈনিক এল পেইস জানিয়েছে, বিদ্যুৎ নিয়ে অনিশ্চয়তার প্রেক্ষিতে ফায়ার প্লেস, লাকড়ি ও কয়লা কেনার দিকে ঝুঁকেছে বহু মানুষ। রিকোসন ন্যাচারাল এনার্জি ওয়্যারহাউসের এক কর্মী বলেন, গত বছরের তুলনায় এবার বিক্রি অনেক বেড়েছে। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় মানুষ বসতবাড়ি বাসযোগ্য রাখতে প্রাকৃতিক সমাধানের দিকে ঝুঁকেছে। মাদ্রিদের কাছে মাহাদাহোন্দায় রিকোসনের আউটলেটে এক ক্রেতা বলেন, লাকড়ি, ফায়ার প্লেস ও পেলেটের দাম হু হু করে বাড়ছে। কোম্পানিগুলো পরিস্থিতির সুযোগ নিতে দাম বাড়িয়েছে।

ইউক্রেনের সংবাদ পোর্টাল স্ত্রানা জানিয়েছে, ইভানো-ফ্রাঙ্কভিস্কের মেয়র শহরের অধিবাসীদের বৈদ্যুতিক হিটার মজুতের পরামর্শ দিয়েছেন। সিটি হলের পক্ষ থেকে শহরের মানুষদের উষ্ণ রাখতে বিভিন্ন জায়গায় হিটিং পয়েন্ট চালু করা হচ্ছে। বিদ্যুৎ ও হিটিং সিস্টেম সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় তথ্য নিয়ে নিয়মিত বুলেটিন প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিটি হল।

এর আগে জুলাই মাসে উক্রেইনাস্কায়া প্রাভদার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আসন্ন শীতে সিটি হল ও সংলগ্ন অফিসগুলো উষ্ণ রাখতে পর্যাপ্ত লাকড়ি মজুত করা হয়েছে। লাকড়ি মজুত বাবত সিটি হল ২৬ লাখ রিভনিয়া ব্যয় করেছে বলে খবরে উল্লেখ করা হয়।

গত ১৬ সেপ্টেম্বর ব্লুমবার্গের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিদ্যুৎ খাতে বিশৃঙ্খলা ও অনিয়ন্ত্রিত লোডশেডিং এড়াতে ইউরোপের দেশগুলো পর্যায়ক্রমিক ব্ল্যাকআউট পরিকল্পনা প্রণয়ন করছে। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পর রাশিয়া ও পার্শ্ববর্তী দেশগুলোকে এ কৌশল অবলম্বন করতে হয়েছিল। এবার ইউরোপকে একই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় ইউরোপিয়ান কমিশন (ইসি) রাশিয়ার কয়লার উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের কথা ভাবছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

কয়লার সংকটও তীব্র হয়ে উঠেছে। চলতি সপ্তাহের শুরুতে কাজাখস্তান সরকার কয়লা রপ্তানিতে সাময়িক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। আসন্ন শীতে অভ্যন্তরীণ বাজারে যাতে সংকট না হয়, সেজন্য এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে কর্মকর্তারা জানান।

ব্রিটেনের এক্সপ্রেস জানিয়েছে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকটের কারণে শীত মৌসুমে কর্মীদের হোম অফিসের নির্দেশ দেওয়ার কথা ভাবছে ব্রিটিশ ব্যাংকগুলো। এতে করে জ্বালানি সাশ্রয় ও অফিস হিটিং সংক্রান্ত ব্যয় নিরসন হবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন।

ভিসেগ্রাদ টুয়েন্টিফোর জানিয়েছে, শীতকালীন হিটিং সংকট এড়াতে মলদোভা সরকার লাকড়ি বিক্রির বিশেষ ওয়েবসাইট চালু করেছে। এতে জ্বালানি কাঠ সংগ্রহের সুবিধাজনক স্থান, বন বিভাগের নিকটবর্তী বিক্রয়কেন্দ্র, কাঠের মূল্য সংক্রান্ত তথ্য থাকছে।

স্পুৎনিক জানিয়েছে, সংকট নিরসনে রাশিয়ার সহায়তার আশ্বাস পেলেও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাধার কারণে কাজ হচ্ছে না মলদোভার। শীত মৌসুমে গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে মলদোভাগ্যাজের প্রধান ভাদিম চেবান গত সপ্তাহে সেন্ট পিটার্সবার্গে গ্যাজপ্রমের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। আগস্ট মাসের বিল বাবদ তিনি ৯৭ লাখ ডলারের সমপরিমাণ অর্থ গ্যাজপ্রমকে পরিশোধ করেন।

গ্যাজপ্রমের সঙ্গে ইতিবাচক আলোচনা শেষে ভাদিম চেবান দেশে ফিরে সেপ্টেম্বর মাসের অগ্রিম বিল পরিশোধের উদ্যোগ নেন। এ সময় ইউরোপিয়ান ব্যাংক ফর রিকনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টপ (ইবিআরডি) জানায়, মলদোভাকে ইবিআরডির দেওয়া তহবিলের অর্থ রাশিয়ার গ্যাস ক্রয়ে ব্যয় করা যাবে না।

‘কোল স্টোভস অ্যান্ড ফায়ারউড থিভস’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে ওয়াশিংটন পোস্ট জানিয়েছে, ইউরোপে জ্বালানি কাঠের সংকট ও মূল্য বেড়ে গেছে। পরিস্থিতির সুযোগ নিতে তৎপর হয়েছে চোর ও প্রতারকের দল। বিভিন্ন জায়গায় ট্রাক ও ট্রাক্টর থেকে জ্বালানি কাঠ চুরি হচ্ছে। কাঠ বিক্রেতার ছদ্মবেশে ওয়েবসাইট খুলে অগ্রিম বুকিংয়ের নামে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে কিছু প্রতারক। ন্যাপলস থেকে ন্যুরেমবার্গ পর্যন্ত বহু শহরে লাকড়ি জ্বলানোর উপযোগী স্টোভ ও ফারনেসের মজুত শেষ হয়ে গেছে। জার্মানির ব্রেমেনের অধিবাসী ফ্রানয লুনিংহেক বলেন, কয়লা এখন নতুন স্বর্ণ।