বৈশ্বিক জ্বালানি অবকাঠামোতে নাশকতা থামছেই না

নর্দস্ট্রিম পাইপলাইনে বিস্ফোরণ ও নাশকতার খবরে মূলধারার পশ্চিমা মিডিয়া ব্যস্ত থাকলেও বৈশ্বিক জ্বালানি অবকাঠামোতে নাশকতা থামছেই না। নর্দস্ট্রিমের আগে-পরে আরও অন্তত দুইটি গুরুত্বপূর্ণ পাইপলাইনে ছিদ্র শনাক্ত হয়েছে। নাশকতা চেষ্টার অভিযোগ পাওয়া গেছে আরেকটি পাইপলাইনে। এসব ঘটনার তদন্তে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।

নর্দস্ট্রিম পাইপলাইনে ছিদ্রের কারণে সমুদ্রে ছড়িয়ে পড়ে গ্যাস। ২৭ সেপ্টেম্বর সকালে ডেনমার্কের বিমান বাহিনীর দেওয়া ছবি

গত ২৫ দিনে বৈশ্বিক গুরুত্বপূর্ণ জ্বালানি অবকাঠামোতে কমপক্ষে চারটি নাশকতার ঘটনায় ভীষণভাবে বিঘ্নিত হয়েছে ইউরোপ ও এশিয়ার অন্তত দেড় ডজন দেশে গ্যাস ও তেল সরবরাহ। প্রথমে ২১ সেপ্টেম্বর মালয়েশিয়া থেকে জাপানে এলএনজি সরবরাহে ব্যবহৃত সাবাহ পাইপলাইনে ছিদ্র শনাক্ত হয়। পাঁচদিনের মাথায় ঘটে রাশিয়া থেকে ইউরোপে গ্যাস সরবরাহে ব্যবহৃত নর্দস্ট্রিমে নাশকতা। এরপর গত মঙ্গলবার ইউরোপে রুশ গ্যাস সরবরাহের আরেক মাধ্যম দ্রুঝবা পাইপলাইনে ছিদ্র শনাক্ত হয়।

রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত তিনদিনে জার্মানি, সুইডেন ও ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূতদের তলব করে নর্দস্ট্রিমে নাশকতার ঘটনা তদন্তে মস্কোকে সংশ্লিষ্ট না করার এবং নিজেদের অনুসন্ধানের ফলাফল রাশিয়ার সঙ্গে শেয়ার না করায় কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে। রুশ কর্মকর্তারা বলেছেন, রাশিয়াকে তদন্তে না রেখে কোনো প্রতিবেদন দিলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। এ তদন্তে যুক্তরাষ্ট্রকে সংশ্লিষ্ট করা হয়েছে এমন খবর রাশিয়ার কাছে এসেছে বলেও তারা উল্লেখ করেন।

জার্মান সংবাদমাধ্যম ডের স্পিগেল গতকাল জানিয়েছে, সুইডেন সরকার নর্দস্ট্রিম পাইপলাইনে বিস্ফোরণের ঘটনায় জার্মানি ও ডেনমার্কের সঙ্গে যৌথ তদন্তের প্রস্তাব নাকচ করেছে। তদন্তে গোপনীয়তার মাত্রা অনেক বেশি হওয়ায় অন্য দেশকে সংশ্লিষ্ট করা সম্ভব নয় বলে সুইডিশ কর্মকর্তারা দাবি করেন।

গত ২৬ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় সুইডেন ও ডেনমার্কে গ্যাসের চাপে আকষ্মিক পতন দেখা দেয়। পরবর্তীতে রাশিয়া থেকে ইউরোপে গ্যাস সরবরাহের অন্যতম মাধ্যম নর্দস্ট্রিম পাইপলাইন সিস্টেমে চারটি ছিদ্র শনাক্ত হয়। সুইডেন ও ডেনমার্কের জলসীমায় যথাক্রমে নর্দস্ট্রিম ওয়ান ও নর্দস্ট্রিম টু পাইপলাইনে শক্তিশালী বিস্ফোরণের মাধ্যমে দুইটি করে মোট চারটি ছিদ্র করা হয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর কর্মকর্তারা।

নর্দস্ট্রিম পাইপলাইনে বিস্ফোরণের জন্য পরোক্ষভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন শনিবার রাশিয়া এনার্জি উইকে দেওয়া বক্তৃতায় বলেছেন, জ্বালানি বাজারের কোনো কোনো খেলোয়াড় প্রতিযোগী দেশের অবকাঠামো ধ্বংস করছে। নর্দস্ট্রিমে হামলা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ। পুরো ইউরোপ মহাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা বিপন্ন করাই এর উদ্দেশ্য। কারা এটা ঘটিয়েছে তা স্পষ্ট। অনেক বেশি দামে জ্বালানি কিনতে ইউরোপকে বাধ্য করা হচ্ছে। এ হামলার পেছনে তারাই রয়েছে যারা ইউরোপ ও রাশিয়ার মধ্যকার সম্পর্ক নষ্ট করতে চায়।

এদিকে গতকাল রুশ প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেছেন, রাশিয়া থেকে ইউরোপে গ্যাস সরবরাহে ব্যবহৃত টার্কিশ স্ট্রিম পাইপলাইনে সন্ত্রাসী হামলার চেষ্টাকালে কয়েকজন নাশকতাকারীকে আটক করা হয়েছে।

এর আগে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রাশিয়া থেকে ইউরোপে তেল সরবরাহে ব্যবহৃত দ্রুঝবা পাইপলাইনে ছিদ্র পাবার কথা জানায় পোল্যান্ডের পাইপলাইন অপারেটর কোম্পানি পারন (পিইআরএন)। দ্রুঝবা অয়েল পাইপলাইনের উপর ভীষণ নির্ভরশীল দেশ সার্বিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রী জোরানো মিহাইলোভিচ এ ঘটনাকে নাশকতা বলে অভিহিত করেছেন।

সাইবেরিয়া থেকে বাল্টিক সাগর হয়ে ইউক্রেন, বেলারুশ, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, স্লোভাকিয়া, চেক প্রজাতন্ত্র, অস্ট্রিয়া ও জার্মানির বিভিন্ন পয়েন্টে তেল পৌঁছে দেয় দ্রুঝবা পাইপলাইন সিস্টেম। দ্রুঝবা সিস্টেমে মোট ৮০ হাজার কিলোমিটার পাইপলাইন রয়েছে। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় দ্রুঝবার যে অংশটিতে ছিদ্র শনাক্ত হয় সেটির অবস্থান পোল্যান্ডের মধ্যাঞ্চলীয় প্লক শহর থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে। দ্রুঝবা সিস্টেমের ওয়েস্টার্ন সেকশনের এ পাইপ দিয়ে তেল পরিবাহিত হয় জার্মানিতে।

নর্দস্ট্রিমে নাশকতার পাঁচ দিন আগে ২১ সেপ্টেম্বর আকষ্মিকভাবে ছিদ্র শনাক্ত হয় সাবাহ এলএনজি পাইপলাইনে। মালয়েশিয়া থেকে জাপানে এলএনজি সরবরাহে ব্যবহৃত পাইপলাইনটিতে ছিদ্র পাবার ঘটনায় অনেকে বিষ্ময় প্রকাশ করেন।

একের পর এক নাশকতার ঘটনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত রাশিয়া। এছাড়া জরুরি জ্বালানি না পাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এশিয়া ও ইউরোপে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র বলে পরিচিত দেশগুলো। সস্তা রুশ জ্বালানি না পেয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বেশি দামে গ্যাস কিনতে বাধ্য হচ্ছে অনেক দেশ। বিষয়টি নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করে শনিবার সন্ধ্যায় এক অনুষ্ঠানে ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ বলেছেন, বাজারদরের চেয়ে চারগুণ বেশি দামে গ্যাস কিনতে হলে সেটা আর যা-ই হোক বন্ধুত্ব নয়।