৪০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছাস ও ব্যাপক প্রাণহানির আশঙ্কা

বর্তমানে অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় হিসেবে পূর্ব বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত মোখা নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করছেন বিভিন্ন দেশের আবহাওয়াবিদরা। প্রায় সবার পূর্বাভাসেই জান-মালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকির কথা আসছে। ঘূর্ণিঝড় মোখার কারণে ৪০ ফুট উঁচু জলোচ্ছাস ও ব্যাপক প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছেন মার্কিন ও ইউরোপীয় আবহাওয়াবিদরা। তারা জানান, ঘূর্ণিঝড়টি রোববার নাগাদ ঘণ্টায় ১৮০ থেকে ১৯০ কিলোমিটার গতিবেগ নিয়ে প্রবল বন্যা ও ভারী বৃষ্টিপাতসহ উপকূলে আঘাত হানবে। 

ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাবে প্রবল জলোচ্ছাস হতে পারে বলে আবহাওয়াবিদরা জানিয়েছেন

যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েস্ট ফ্লোরিডার চিফ মেটেওরলজিস্ট অ্যান্ড ক্লাইমেট সায়েন্টিস্ট জেফ বেরারডেলি বলছেন, রোববার নাগাদ ক্যাটাগরি থ্রি অথবা ফোর সাইক্লোন হিসেবে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উপকূলে আঘাত হানবে ঘূর্ণিঝড় মোখা। এতে করে বঙ্গোপসাগরে ৪০ ফুট উঁচু জলোচ্ছাস সৃষ্টি হতে পারে, যা বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের নিম্নাঞ্চলকে প্লাবিত করবে।

গত অর্ধশতাব্দীতে বিশ্বের সবচেয়ে প্রাণঘাতী তিনটি ঘুর্ণিঝড় এ অঞ্চলে আঘাত হেনেছে উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, ১৯৭০ সালে ঘুর্ণিঝড়ে বাংলাদেশের ভোলায় তিন লাখ প্রাণহানি হয়েছে। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে ১ লাখ ৩৯ হাজার মানুষ ঘূর্ণিঝড়ে মারা গেছে। ২০০৮ সালে ঘুর্ণিঝড় নারগিস মিয়ানমারে প্রায় এক লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটিয়েছে। বর্তমানে এ অঞ্চল অতীতের তুলনায় ঘুর্ণিঝড় মোকাবেলায় অধিকতর প্রস্তুত হলেও প্রায় ১০ লাখ শরণার্থী উপকূলের কাছে জরাজীর্ণ শিবিরে অবস্থান করছে।

ভারতের আবহওয়া অফিস বলছে, বাংলাদেশ সময় শনিবার সকাল ১০টা ৩০ মিনিট নাগাদ ঘূর্ণিঝড় মোখা কক্সবাজার থেকে ৭৩০ কিলোমিটার দক্ষিণ দক্ষিণ-পশ্চিমে, মিয়ানমারের সিতওয়ে থেকে ৬৬০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে ও আন্দামান-নিকোবরের পোর্ট ব্লেয়ার থেকে ৫৭০ কিলোমিটার উত্তর উত্তর-পশ্চিমে অবস্থান করছিল। এটি আরও শক্তি সঞ্চয় করে আগামীকাল রোববার দুপুর নাগাদ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূল ও মিয়ানমারের উত্তর উপকূল অতিক্রম করবে।

পূর্ব বঙ্গোপসাগরে থাকা ঘূর্ণিঝড় মোখা মালয়েশিয়ার উপকূলীয় অঞ্চলের আর্দ্রতা টেনে নিয়ে আসছে জানিয়ে মালয়েশীয় আবহাওয়া দপ্তর বলছে, এর প্রভাবে আগামী কয়েকদিন মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে তীব্র দাবদাহ বিরাজ করবে ও কোনো বৃষ্টিপাত হবে না।

আকুওয়েদারের চিফ ইন্টারন্যাশনাল ফোরকাস্টার ও সিনিয়র মেটেওরলজিস্ট জ্যাসন নিকোলস জানান, অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখা শনিবার ভোর নাগাদ ক্যাটাগরি থ্রি সাইক্লোনে রূপ নিয়েছে, যা আরও শক্তি সঞ্চয় করে ক্যটাগরি ফোর সাইক্লোন হিসেবে স্থানীয় সময় রোববার কক্সবাজার ও কিওকপিউতে (মিয়ানমার) ল্যান্ডফল করবে।

ফ্রান্সের গেনোবলে কর্মরত আবহাওয়াবিদ ও র‌্যাডার ডেটা বিশ্লেষক নেহাল বেলখারাজির মতে, ঘূর্ণিঝড় মোখা গুরুতর উদ্বেগের কারণ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। মোখার চারপাশে বাতাসের গতিবেগ ও জলোচ্ছাসের সম্ভাব্য মাত্রা নির্দেশক একটি রেখাচিত্র সংযোজন করে তিনি লিখেছেন, আমি এটা বলতে চাই না, কিন্তু আমরা সম্ভাব্য বড় ধরনের প্রাণহানির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি।

ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল মেটেওরলজিতে কর্মরত জলবায়ু বিজ্ঞানী রক্সি ম্যাথিউ কোল বলেছেন, প্রাথমিক পূর্বাভাসের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে মোখা। এর মূল আঘাত বাংলাদেশে ও মিয়ানমারে হলেও ভারতের আন্দামান-নিকোবর থেকে ত্রিপুরা, মিজোরাম, মনিপুর, নাগাল্যান্ড ও দক্ষিণ আসাম পর্যন্ত প্রবল ঝড় ও ভারী বর্ষণ হবে।

তিনি আরও বলেন, অতীতের তুলনায় বঙ্গোপসাগরে এখন কম ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হলেও এসব ঘূর্ণিঝড় আগের চেয়ে বেশি প্রাবল্য ও শক্তিধারণের ক্ষমতা নিয়ে আসছে। এক্ষেত্রে ২০২০ সালের ঘূর্ণিঝড় আমপানের কথা বলা যায়। উপকূলে পৌঁছার পরও কয়েকদিন ধরে প্রবল ঘূর্ণিঝড় হিসেবে স্থলভাগে চলাচল করছিল আমপান, যা ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ঘটিয়েছিল। বঙ্গোপসাগরে এখন তাপমাত্রা ৩০-৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এমন তাপমাত্রা ঘূর্ণিঝড় জমাট বাঁধাতে ও ঘূর্ণিঝড়ের অভিঘাত বাড়াতে ভূমিকা রাখে।

এদিকে ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলার জন্য বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশগুলোতেও নানা প্রস্তুতি দেখা যাচ্ছে। মিয়ানমার রেড ক্রস সেদেশের রাখাইন রাজ্যের উপকূল থেকে জনগণকে আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে নিচ্ছে। কিছু অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র তৈরির খবর জানিয়েছে দ্য ইরাওয়াদ্দি পত্রিকা। শ্রীলঙ্কার আবহাওয়া বিভাগ বলছে, ঘুর্ণিঝড় মোখার সরাসরি আঘাত শ্রীলঙ্কায় না হলেও এর প্রভাবে শ্রীলঙ্কার ওয়েস্টার্ন, সাবারাগামুয়া ও নর্দার্ন প্রভিন্সে ৭৫ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত হতে পারে। কিছু সড়ক ও বসতি জলমগ্ন হতে পারে।