সুজনের প্রশ্ন: শিক্ষার্থীরা সবাই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কেন?

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট পরিস্থিতিকে জনগণের দীর্ঘদিনের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করছেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। তাদের মতে, ভোটাধিকার, আইনের শাসনের মতো মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার পর এটি এখন অধিকার আদায়ের আন্দোলনে রূপ নিয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনের ছবি

বৃহস্পতিবার রাজধানীর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে সুশীল সমাজের সদস্যরা এসব কথা বলেন। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট অচলাবস্থার সমাধান দাবি করে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে।

সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ২০০৯ সালে তরুণ প্রজন্মের ভোটেই আওয়ামী লীগ ভূমিধস বিজয় পেয়েছিল। কীভাবে এটা সম্ভব হয়েছিল, কী এমন ঘটল যে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল স্তরের ছাত্র-ছাত্রীরা আজ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি।

কোটা আন্দোলনকে রোগের লক্ষণ বলে উল্লেখ করে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘আসল রোগটা আরও গুরুতর। জটিল ও ভয়াবহ রোগ হচ্ছে, যারা ক্ষমতার কাছাকাছি নেই তারা সব সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। জনগণ ভোটাধিকার, আইনের শাসনের মতো মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এসব অধিকার একে অপরের সাথে জড়িত। একটি অধিকার হরণের মাধ্যমে অন্য অধিকার হরণ করা হচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এই অধিকারগুলো প্রতিষ্ঠিত না হলে রোগের লক্ষণের চিকিৎসা হবে না। এটি এখন অধিকার আদায়ের আন্দোলন।’

বদিউল আলম মজুমদার বলেন, বর্তমান সংকটের যুক্তিসঙ্গত সমাধান প্রয়োজন এবং এর জন্য শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। তিনি বলেন, এই অপকর্মের বিচার হতে হবে এবং এর রাজনৈতিক সমাধান করতে হবে।

'বিচার' শব্দটি মুছে যাবে দেশ থেকে

এই সংকট নিষ্পত্তির জন্য আন্তরিক ও কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না উল্লেখ করে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সংস্থা (বেলা)'র প্রধান কার্যনির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘সরকার ঘায়ে আঁতেল লাগানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু জাতি যে ক্ষত বয়ে বেরাচ্ছে তা খুবই গভীর। ছাত্রদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যে ঘটনা ঘটেছে তা সমগ্র জাতিকে ক্ষুব্ধ করেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে জনগণ স্বস্তি পাচ্ছে না।’

এত হত্যাকাণ্ডের ক্ষমা নেই উল্লেখ করে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘এবার যদি বিচার না হয়, তাহলে 'বিচার' শব্দটি বাংলাদেশ থেকে মুছে যাবে। সকলকে তাদের নিজ নিজ স্থান থেকে বিচার দাবি করতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, জাতিসংঘের মাধ্যমে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় বিচার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত নীরব থাকার বা শান্ত থাকার কোনো স্কোপ নেই।’

ছাত্রদের আন্দোলন ব্যর্থ হবে না

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস মন্তব্য করেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে একটি গণঅভ্যুত্থান ঘটে গেছে। তিনি বলেন, এই আন্দোলনে সরকার নৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে পরাজিত হয়েছে। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে যেখানে ৬১ জন নিহত হয়েছিলেন, সেখানে ২০২৪ সালের এই আন্দোলনে তার চার গুণ মানুষ নিহত হয়েছেন। তিনি আরও বলেন, নারী, শিশু, চিকিৎসক, শিক্ষক-- সকল পেশার মানুষই এখানে মারা গেছেন।

রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, ‘একসময় আমরা বলতাম এরশাদের হাত ছাত্রদের রক্তে রঞ্জিত, ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় ছাত্রদের আন্দোলন ব্যর্থ হয় না। এই আন্দোলনও ব্যর্থ হবে না। প্রাণবন্ত তরুণরা প্রাণ দিয়েছে।’

রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, ‘অনেকেই বলেন, আওয়ামী লীগ গেলে কি বিএনপি-জামায়াত আসবে? আওয়ামী লীগ ব্যর্থ হয়েছে, আমরা বিএনপিকেও দেখেছি। জামায়াত-জাতীয় পার্টি দেখেছি। সব রাজনৈতিক দলের প্রতি যদি বিদ্বেষ থাকে, তাহলে সবাইকেই বাতিল করতে হবে। নতুন ভাবে গণপরিষদ ডেকে সংবিধান তৈরি করতে হবে।’

বল প্রয়োগে বেড়ে যাবে ক্ষোভ

নাগরিক উদ্যোগের জাকির হোসেন বলেন, ‘যারা আমাদের শাসন করছেন তাদের শাসন করার সবচেয়ে কম যোগ্যতা রয়েছে। তারা ব্যর্থ হয়েছেন। তারা যে প্রশাসন চালাচ্ছেন তার কোনো নৈতিক ভিত্তি নেই। তারা 'উদ্ভাবনী পদ্ধতিতে' তিনটি নির্বাচন দিয়েছেন, তারা সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন। জনগণ একটি শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির মধ্যে আছে। জনগণ প্রতি পদক্ষেপে নির্যাতিত হচ্ছে।’

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে পুলিশের বিবৃতিকে 'ঘৃণ্য' বলে অভিহিত করে জাকির হোসেন বলেন, ‘পুলিশ বলছে তারা কাউকে হত্যা করে নাই, অপরাধীরা হত্যা করেছে। আমরা ছবি ও ভিডিও দেখেছি। পুলিশি তদন্তে কোনো ফলাফল আসবে না। এই সংকটের একটি রাজনৈতিক সমাধান প্রয়োজন,’ তিনি আরও বলেন।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সুজনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক দিলীপ কুমার সরকার।