বিএনপির আহ্বান: ঐক্য, শান্তি এবং দ্রুত নির্বাচন

গতকাল নয়াপল্টনে বিশাল জনসভায় বিএনপি সকলকে শান্তি, ঐক্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে। ধর্ম, বর্ণ, পরিচয় নির্বিশেষে সকলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি দ্রুত নির্বাচনের দাবিও করেছে দলটি। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নয়াপল্টনে অনুষ্ঠিত বিশাল সমাবেশে এ আহ্বান জানান।

ছবি - সংগৃহীত

প্রায় সাড়ে ছয় বছর পর প্রথম ভাষণে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দীর্ঘ আন্দোলনের মাধ্যমে ‘ফ্যাসিবাদী অবৈধ সরকারকে’ উৎখাত করার জন্য যুবসমাজকে ধন্যবাদ জানান।

তিনি তিন মিনিটের ভিডিও বার্তায় বলেন, ‘যারা দীর্ঘদিনের আন্দোলনের মাধ্যমে এই অর্জন তুলে ধরেছে তাদের আমি আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানাই। আমি শত শহীদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করছি। এই অর্জন জাতির জন্য নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে।’

২০২৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে দুর্নীতির মামলায় কারাগারে যাওয়া খালেদা যে সমাবেশে ভাষণ দেবেন তা আগে থেকে জানতেন না দলের নেতা-কর্মী ও সমর্থকরা। ফলে খালেদার ভাষণ শুরু হলেই হাজার হাজার নেতা-কর্মী ও সমর্থক উল্লাসে ফেটে পড়েন।

খালেদা জিয়া বলেন, ‘এই দেশকে আমাদেরকে দুর্নীতির অভাবনীয় কালো থাবা থেকে, ধ্বংসপ্রাপ্ত গণতন্ত্রের ধ্বংসস্তূপ থেকে তুলে আনতে হবে। ছাত্রসমাজ, তরুণ প্রজন্মই আমাদের ভবিষ্যৎ। যার স্বপ্ন বাস্তবায়নে তরুণরা আজ রক্ত ঝরিয়েছে, মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে জ্ঞাননির্ভর, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তুলে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতেই হবে। শোষণমুক্ত বাংলাদেশ আমাদের গড়তেই হবে।’

তিনি আরও বলেন, সকল ধর্ম ও সম্প্রদায়ের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

খালেদা বলেন, ‘আসুন, শান্তি, অগ্রগতি ও সমতার ভিত্তিতে আগামী দিনের বাংলাদেশ গড়ে তুলতে আমাদের তরুণদের হাতকে শক্তিশালী করি। বিধ্বংসী কাজে, প্রতিশোধ নেওয়ার মনোভাব, প্রতিহিংসার রাজনীতিতে বিশ্বাসী হবো না - ভালোবাসা, শান্তি এবং জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে একটি সুন্দর সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করব।’

সোমবার গৃহবন্দী থেকে মুক্তি পাওয়া খালেদা তার ভাষণের শুরুতে দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন যে তিনি আবার কথা বলতে পারছেন।

তিনি আরও বলেন, ‘আমার কারাভোগের সময়, আপনারা আমার মুক্তি এবং আরোগ্যের জন্য লড়াই করেছেন, দোয়া করেছেন। এর জন্য আপনাদের সকলকে ধন্যবাদ জানাই।’

এর আগে সকাল থেকেই দলের নেতা-কর্মীরা নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ে জমা হতে শুরু করেন। দুপুর ২টা ১৬ মিনিটের মধ্যেই নয়াপল্টন ও পার্শ্ববর্তী এলাকা দলীয় নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে।

নেতাদের বক্তব্য শুরুর আগে কোটা সংস্কার আন্দোলনে নিহতদের স্মরণে এক মিনিটের নীরবতা পালন করা হয়।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্য শেষ হওয়ার পর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান মঞ্চের নিচে স্থাপিত বড় পর্দায় প্রত্যক্ষ হন।

প্রশাসনের প্রতি কঠোর হাতে সকলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়ে তারেক বলেন, ‘ধর্ম, বর্ণ, পরিচয় নির্বিশেষে সকলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে আপনারা ঢাল হয়ে দাঁড়ান, নজির স্থাপন করুন।’

তিনি পুলিশ বাহিনী এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার তাৎক্ষণিক থামানোর দাবি জানান।

দেশকে অস্থিতিশীল করার যে চক্র কাজ করে যাচ্ছে তাদের তিনি হুঁশিয়ারি দেন।

তারেক বলেন, ‘আজ থেকে পুলিশ বা ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর হামলা বন্ধ করুন। বিএনপির নাম ব্যবহার করে কেউ যদি কোন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করার চেষ্টা করে, তাদের আইনের আওতায় আনুন।’

পুলিশের ভূমিকার গুরুত্বের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘একটি সভ্য ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় পুলিশ অপরিহার্য। পুলিশ জনগণের শত্রু নয়।’

তিনি আরও বলেন, বিএনপিসহ গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলো মনে করে, পুলিশের মধ্যে কিছু কুচক্রী ছাড়া অধিকাংশ পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্য তাদের কর্মবিধি ও আইন মেনে কর্তব্য পালনের চেষ্টা করেন।

তিনি বলেন, ‘হাসিনা দেশ ছাড়া পালানোর পর এখন একটি চক্র পুলিশকে নিরুৎসাহিত করার ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। কারণ, পুলিশকে যদি অকার্যকর করা যায় তাহলে দেশকে অস্থিতিশীল করা সহজ হবে। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করা সহজ হবে।’

পুলিশের বিরুদ্ধে যদি কোন নির্দিষ্ট অভিযোগ থাকে তাহলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করার জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

তারেক বলেন, ‘আমি সকলের কাছে আবেদন জানাবো, আইন হাতে তুলে নেবেন না এবং প্রতিশোধ স্পৃহা থেকে বিরত থাকুন।’

তিনি বলেন, ‘তাৎক্ষণিকভাবে জাতীয় নির্বাচন দিতে হবে এবং নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।’

শেখ হাসিনার সরকারের পতনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘গত ১৫ বছর যাবত বাংলাদেশ কারাগারে পরিণত হয়েছিল। আজ গণতন্ত্রের দুয়ার উন্মুক্ত হয়েছে। আজ আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম।’

জনগণের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের কারণে হাসিনা দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘আবারও প্রমাণিত হলো, বাংলাদেশ কখনো পরাজয় গ্রহণ করে না, গ্রহণ করবেও না। বাংলাদেশের পক্ষে থাকা শক্তিরা যদি এক হয়, তাহলে কোনো অপশক্তিই বাংলাদেশকে ধরাশায়ী করতে পারবে না। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং ২০২৪-এর মুক্তিযুদ্ধেও জনগণের বার্তা একটাই, স্বাধীনতা কোনো শর্তসাপেক্ষ হতে পারে না।’

তিনি বলেন, ৫ আগস্ট ছাত্র ও জনগণের ঐক্যবদ্ধ বিপ্লবের মাধ্যমে বাংলাদেশ আরেকটি বিজয় অর্জন করেছে।

প্রশাসনকে যোগ্যতা সম্পন্ন করে গড়ে তোলার ওপর গুরুত্বারোপ করে তারেক বলেন, ‘নিয়োগ ও পদোন্নতিতে মেধাকে সর্বাধিক অগ্রাধিকার দিতে হবে।’

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর রাষ্ট্রপতির প্রতি আহ্বান জানান যেন তিনি আর কোনো দেরি না করে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করেন।

তিনি বলেন, ‘এই সরকার তিন মাসের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে। এই প্রক্রিয়ায় জনগণ তাদের পূর্ণ সহযোগিতা করবে।’

ছাত্রদের অবদানের জন্য তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে দলের স্থায়ী কমিটির ছয় জন সদস্য জনসভায় ভাষণ দেন।