ব্যাংকিং খাতে অস্থিরতা: কার্যক্রম ব্যাহত, বড় ঋণগ্রহীতাদের অন্তর্ধান

সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তনের জের ধরে ব্যাংকিং খাতে উত্তেজনা বিরাজ করছে। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিদায়ের পর নতুন শাসনতন্ত্রের আওতায় একদল অসন্তুষ্ট কর্মকর্তার অস্থিরতার কারণে শুধু ব্যাংকিং কার্যক্রমই নয়, নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকাও ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের লোগো

বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তারা, এমনকি গভর্নর পর্যন্ত, চলমান অস্থিরতার কারণে কার্যালয়ে অনুপস্থিত থাকায় নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। অন্যদিকে, বৃহস্পতিবার বেশ কয়েকটি বাণিজ্যিক ব্যাংকে প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়েছে এবং আশঙ্কা করা হচ্ছে অন্যান্য ব্যাংকেও এমন বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়তে পারে।

ব্যাংক কর্মকর্তারা অবৈধ নিয়োগ বাতিল, অর্থপাচার ও অনিয়মে জড়িত ব্যাংক মালিকদের শাস্তি এবং বিগত কয়েক বছরে চাকরিচ্যুতদের পুনর্বহালের দাবি জানিয়েছেন।

একইসঙ্গে, শাসন পরিবর্তনের পরপরই বেশ কয়েকজন বড় ঋণগ্রহীতা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া বা আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় ব্যাংক খাতে আরও খেলাপি ঋণের আশঙ্কা বেড়েছে বলে ব্যাংক কর্মকর্তা ও ব্যাংকাররা জানিয়েছেন।

অর্থবাজার বিশ্লেষকরা আর্থিক খাতের এই পরিস্থিতিকে ‘অত্যন্ত উদ্বেগজনক’ বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং তারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ব্যাংকিং কার্যক্রমে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা জানান, চলমান অস্থিরতার কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর, চার ডেপুটি গভর্নর, নীতি উপদেষ্টা এবং বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান কার্যালয়ে যোগ দিচ্ছেন না।

তিনি বলেন, ‘তাদের অনুপস্থিতির কারণে নিয়ন্ত্রক বিষয়গুলো মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হয়েছে। আশা করছি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর পরিস্থিতির উন্নতি হবে এবং স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে।’

এদিকে, বৃহস্পতিবার (৮ আগস্ট) ১ লাখ টাকার বেশি নগদ উত্তোলন না করার জন্য দেশের সব সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংককে নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

নামবিহীন অনেক চেক ব্যাংকে আসতে শুরু করায় এই জরুরি নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। অন্যদিকে, শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগের কারণে ব্যাংক ও এটিএম বুথগুলোতে নিরাপত্তার অভাব দেখা দিয়েছে।

এছাড়াও, বেশ কয়েকটি ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বিক্ষোভের কারণে ব্যাংকগুলোতে উত্তেজনা অব্যাহত রয়েছে, যা ব্যাংকিং কার্যক্রম ব্যাহত করছে বলেও ওই বিবি কর্মকর্তা জানান।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, কিছু ব্যাংকে চলমান প্রতিবাদের কারণে ব্যাংকিং শিল্প একটি উত্তেজনাপূর্ণ সময় পার করছে।

তবে সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, শাসন পরিবর্তনের পরপরই অনেক বড় ঋণগ্রহীতা দেশ ছেড়ে চলে গেছেন বা আত্মগোপনে চলে গেছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা ঋণের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জানি না। এটি নিঃসন্দেহে তারল্যের ওপর আরও চাপ সৃষ্টি করবে।’

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন মনে করেন, এ ধরনের পরিস্থিতি তখনই সৃষ্টি হয় যখন নিয়ন্ত্রক সংস্থা কাজ করে না।

তিনি ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে আনা পরিবর্তনের কিছু বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেন। তিনি বলেন, কোনো সরকার ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা না থাকায় ছাত্ররা রাস্তায় নেমে যান চলাচল ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নেয় এবং এটি ভালোভাবে কাজ করছে।

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তাদের অনুপস্থিতিতে একটি নিয়ন্ত্রক শূন্যতা তৈরি হয়েছে যা ছাত্ররা পূরণ করতে পারবে না।’

তিনি পরামর্শ দেন যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শূন্যতা পূরণের মাধ্যমে ব্যাংকিং কার্যক্রমে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে প্রথম দিন থেকেই দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা ব্যাংকগুলোতে যা দেখছি তা হলো এই সরকারবিহীন সময়ের একটা বিশৃঙ্খলা।’