‘মৃতপ্রায়’ ব্যাংক বন্ধের আহ্বান, ৯২ হাজার কোটি টাকা লুটের তথ্য

দেশে বেশকিছু ‘মৃতপ্রায়’ ব্যাংক কেবলমাত্র আর্থিক সাহায্যের মাধ্যমে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এসব ব্যাংক বন্ধ করে দেওয়ার জোর দাবি জানিয়েছে। ‘ব্যাংকিং খাতের সুশাসন ফিরিয়ে আনতে করণীয়’ শীর্ষক এই সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, পতনের দ্বারপ্রান্তে থাকা এসব ব্যাংক বন্ধের পূর্বে আমানতকারীদের অর্থ সুরক্ষার জন্য একটি 'এক্সিট পলিসি' প্রণয়ন করা জরুরি।

ছবি - সংগৃহীত

সিপিডির গবেষণায় উঠে এসেছে, ২০০৮ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ২৪টি বড় ব্যাংক কেলেঙ্কারিতে প্রায় ৯২,২৬১ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এই অঙ্কটি ২০২৪ সালের জাতীয় বাজেটের ১২ শতাংশ এবং ২০২৩ সালের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ শতাংশের সমান।

সিপিডি তাদের প্রতিবেদনে অবৈধ আর্থিক অর্থ প্রবাহের উদ্বেগের কথাও উল্লেখ করেছে। গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) রিপোর্ট ২০০৫-২০১৪ অনুসারে, ২০০৭ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ৪৭ বিলিয়ন থেকে ৬৭ বিলিয়ন ডলার অবৈধভাবে বিদেশে পাচার হয়েছে।

২০১৪ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে এবি ব্যাংকের অফশোর ব্যাংকিং ব্যবস্থা ব্যবহার করে প্রায় ২৩৬ কোটি টাকা পাচার করা হয়েছে। ২০২২ সালে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড থেকে প্রায় ৩০,০০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে এস আলম গ্রুপ। ২০০৯ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে ভুয়া কোম্পানি এবং সন্দেহজনক হিসাব ব্যবহার করে বেসিক ব্যাংক থেকে ৪,৫০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে ব্যাংক নিয়ন্ত্রণে দ্বৈত কর্তৃত্ব বন্ধের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ (এফআইডি) অবিলম্বে বন্ধ করার দাবি জানানো হয়। একইসঙ্গে, এফআইডির বর্তমান ও সাবেক সকল কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনিয়মের তদন্তের দাবি করেছে সংস্থাটি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নর নিয়োগের ক্ষেত্রে সিপিডি সুপারিশ করেছে, তারা যেন কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত না থাকেন। সংস্থাটির মতে, ২০০৩ সালের বাংলাদেশ ব্যাংক (সংশোধনী) আইনে স্পষ্টভাবে বলা আছে, গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নর কোনো বর্তমান বা সাবেক সরকারি কর্মকর্তা হতে পারবেন না।

ব্যাংকিং খাতের সংকট নিরসনে সিপিডি একটি স্বাধীন ব্যাংকিং কমিশন গঠনের জোর দাবি জানিয়েছে। তাদের মতে, সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য, সময়সীমা, স্বচ্ছতা এবং নিরপেক্ষতার ভিত্তিতে গঠিত এই কমিশন ব্যাংকিং খাতের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দিতে পারবে, সমস্যার মূল কারণ চিহ্নিত করতে পারবে এবং স্থায়ী সমাধানের জন্য বিশ্বাসযোগ্য পদক্ষেপ প্রস্তাব করতে পারবে।

প্রধান প্রবন্ধে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, 'গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। সরকারি ও বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, পরিচালনার ত্রুটি, নীতিগত অসঙ্গতি ইত্যাদি কারণে এই ক্ষেত্রটি গুরুতর সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। '

সিপিডি আরও জানায়, ২০১৩ সালে রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের জন্য নয়টি নতুন বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের লাইসেন্স অনুমোদন করেছিল সরকার।

সংস্থাটির মতে, অর্থনীতির চাহিদার বাস্তবসম্মত মূল্যায়ন ছাড়া রাজনৈতিক কারণে আর কোনো নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়া উচিত নয়। যেসব ব্যাংক পতনের ঝুঁকিতে না থাকলেও ভালো করছে না, তাদের ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা পর্ষদ পরিবর্তনের জন্য সুপারিশ করেছে সিপিডি।

এছাড়াও, অবৈধ অর্থ প্রবাহ রোধে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে (বিএফআইইউ) আরও গতিশীল করতে হবে। পাশাপাশি, পূর্বে পাচার হওয়া অর্থ যাতে দেশে ফিরে এসে নতুন করে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে না পারে সেজন্য কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়।

সংবাদ সম্মেলনে সিপিডির বিশিষ্ট ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান, গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, সিনিয়র গবেষণা ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।