চাঞ্চল্যকর নজির, এস আলম ও নাসার ২,৫৪৪ কোটি টাকা মওকুফ!

দেশের ব্যাংকিং খাতে ক্ষমতার অপব্যবহারের এক চাঞ্চল্যকর নজির স্থাপন করেছে এস আলম ও নাসা গ্রুপ। সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে কেমন করে তারা ব্যবহার করে তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এই ঘটনায়। ব্যাংকিং নীতিমালা কে পদদলিত করে চোখে আঙ্গুল দিয়ে ২,৫৪৪ কোটি টাকার সুদ মওকুফের সুবিধা পেয়েছে এই দুই প্রভাবশালী শিল্পগোষ্ঠী। আরও বিস্ময়কর বিষয় হলো, সমগ্র প্রক্রিয়া জুড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত সন্দেহজনক এবং প্রশ্নবিদ্ধ।

এস আলম এবং নাসা গ্রুপের লোগো

১৯৮৫ সালে আওয়ামী লীগ নেতা আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু এবং সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর আত্মীয় সাইফুল আলম কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এস আলম গ্রুপ বর্তমানে দেশের শীর্ষ শিল্পগোষ্ঠীর একটি। আটটি ব্যাংকে তাদের নিয়ন্ত্রণ অংশীদারিত্ব রয়েছে।

অন্যদিকে, ২০০৮ সাল থেকে এক্সিম ব্যাংক এবং বেসরকারি ব্যাংক মালিকদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ ব্যাংকস’-এর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন নাসা গ্রুপের প্রধান নজরুল ইসলাম মজুমদার।

এই দুই প্রতিষ্ঠানের মালিকদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার কথা সর্বজনবিদিত।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্পষ্ট নীতিমালা অনুযায়ী, কেবলমাত্র ঋণগ্রহীতার মৃত্যু, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারী, বন্যা অথবা প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেলে সুদ মওকুফের সুযোগ রয়েছে। এমনকি, ২১ এপ্রিল ২০২২ তারিখে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক নোটিশে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, আয় খাতে স্থানান্তরিত সুদ মওকুফ করা যাবে না। অথচ, এস আলম ও নাসা গ্রুপের যেসব কোম্পানিকে সুদ মওকুফের সুবিধা দেওয়া হয়েছে, সেগুলো সক্রিয়ভাবে ব্যবসা পরিচালনা করছে এবং ঋণ গ্রহণের সময় কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগও ঘটেনি।

এস আলম গ্রুপের ক্ষেত্রে ন্যাশনাল ব্যাংক এবং নাসা গ্রুপের ক্ষেত্রে জনতা ব্যাংক আয় খাত বন্ধ করে সুদ মওকুফ করেছে যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

২০২১ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক সাতটি পত্রের মাধ্যমে জাতীয় ব্যাংককে এনওসি প্রদান করে যাতে ২০০৩ সালে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ শাখা এবং ঢাকার গুলশান শাখা থেকে নির্যাতিত জাতীয় ব্যাংকের ঋণের ক্ষেত্রে সুদ মওকুফের সুবিধা প্রদানের অনুমোদন দেওয়া হয়। এই সাতটি পত্র ইস্যুর মাধ্যমে এস আলম গ্রুপের আটটি কোম্পানির ঋণের ক্ষেত্রে জাতীয় ব্যাংক ২,২৮৩ কোটি টাকা সুদ মওকুফ করে।

এর মধ্যে রয়েছে এস আলম সুপার এডিবল অয়েল (৭১৫ কোটি), এস আলম এন্ড কোম্পানি (৪৫৬ কোটি), এস আলম ভেজিটেবল অয়েল (৩২২.৭৭ কোটি), এনএএফ ট্রেডিং (২৪৯.৯৬ কোটি), আদিল কর্পোরেশন (১৮৫.২৩ কোটি), পুষ্টি ভেজিটেবল ঘি (১৫৮ কোটি), ফ্যারি ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল (১২২.৮৭ কোটি) এবং এস আলম ব্রাদার্স (৭৩.১৪ কোটি)।

ফলে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, এস আলম গ্রুপ কেবল ৪,৯২৮ কোটি টাকা মূল ঋণ পরিশোধ করেছে এবং কোনো সুদ প্রদান করেনি।

অন্যদিকে, ২০২১ সালে জনতা ব্যাংকের ৬৫৪তম বোর্ড সভায় নাসা গ্রুপের দুটি কোম্পানি ‘নাসা তাইপে স্পিনার্স’ এবং ‘নাসা স্পিনার্স’ -কে ২৬১ কোটি টাকা সুদ মওকুফের সুবিধা অনুমোদন করা হয়। প্রথমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকিং নীতিমালা লঙ্ঘনের কারণ দেখিয়ে সুদ মওকুফের সুবিধা প্রত্যাখ্যান করলেও পরে তারা তাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে।

এই সুদ মওকুফের ফলে ন্যাশনাল ব্যাংককে ২০২২ সালে ৩,২৬০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে এবং ব্যাংকটি এখনও এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারেনি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, নিয়মবহির্ভূত এই সুবিধা ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের পরিপন্থী। এই ধরনের ঘটনা ভবিষ্যতে ঋণখেলাপিদের উৎসাহিত করবে এবং এতে সমগ্র ব্যাংকিং খাত ঝুঁকির মুখে পড়বে।

ডেইলি স্টার অবলেম্বনে