বসুন্ধরা গ্রুপের মালিকদের বিদেশি সম্পত্তি জব্দের নির্দেশ

ঢাকা মেট্রোপলিটন সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালত বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান ও তার পরিবারের ৬টি দেশ এবং ২টি অফশোর এলাকায় থাকা কোটি কোটি ডলারের বিদেশি সম্পত্তি জব্দের নির্দেশ দিয়েছেন।

আহমেদ আকবর সোবহান ও সায়েম সোবহান আনভীর

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপ-পরিচালক নাজমুল হোসেনের দায়ের করা আবেদনের শুনানি শেষে ২১ নভেম্বর আদালত এই আদেশ জারি করেন।

আদালতের রায়ে বলা হয়, সোবহান ও তার পরিবার অবৈধভাবে আয়ের উৎস গোপন করে বিপুল সম্পদ অর্জন করেছেন এবং পরবর্তীতে সেই অর্থ পাচার করে সংযুক্ত আরব আমিরাত, স্লোভাকিয়া, সেন্ট কিটস ও নেভিস, সুইজারল্যান্ড, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডস, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর এবং সাইপ্রাসসহ বিভিন্ন স্থানে পাঠিয়েছেন।

আবেদনে আহমেদ আকবর সোবহান, তার স্ত্রী আফরোজা বেগম, তাদের ছেলে সায়েম সোবহান আনভীর, সাফিয়াত সোবহান, সাফওয়ান সোবহান এবং আনভীরের স্ত্রী সাবরিনা সোবহান, সাদাত সোবহানের স্ত্রী সোনিয়া ফেরদৌসী সোবহান এবং সাফওয়ানের স্ত্রী ইয়াশা সোবহানের বিদেশি সম্পত্তির বিস্তারিত তথ্য উল্লেখ করে অর্থপাচারের অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে তাদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি জব্দের আদেশ চাওয়া হয়।

এই সম্পত্তির মধ্যে রয়েছে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, স্থাবর সম্পত্তি এবং ব্যবসায়িক হোল্ডিং।

আদালত জানায়, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০২২ অনুযায়ি জারি করা এই আদেশ পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বলবৎ থাকবে।

আদালতের আদেশের কপি পারস্পরিক আইনগত সহায়তা চুক্তি অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য স্লোভাকিয়ার স্টেট রেজিস্টার, সেন্ট কিটস ও নেভিসের সিটিজেন্স ইন্টারন্যাশনাল, সুইজারল্যান্ডের চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডসের মিনিস্ট্রি অফ ফিনান্সিয়াল সার্ভিসেস, লেবার অ্যান্ড ট্রেড, যুক্তরাজ্যের বিজনেস অ্যান্ড ট্রেড, সিঙ্গাপুর এক্সচেঞ্জ, সংযুক্ত আরব আমিরাতে হাবিব ব্যাংকের চেয়ারম্যান এবং সাইপ্রাসের মিনিস্ট্রি অফ ইন্টেরিয়র ও ডিপার্টমেন্ট অফ ল্যান্ডস অ্যান্ড সার্ভের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে পাঠানো হয়েছে।

আদালত নাগরিকদের অবগতির জন্য সরকারি গেজেট ও ব্যাপক প্রচারিত সংবাদপত্রে এই আদেশ প্রকাশের নির্দেশ দিয়েছেন।

আদালত দুদক এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিবদের কাছে আদেশের কপি পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন যাতে পারস্পরিক আইনগত সহায়তা চুক্তি অনুযায়ী আদেশ কার্যকর করা যায়।

কমিশন আকবর সোবহান ও তার পরিবারের নামে বিদেশে অর্জিত সম্পত্তির বিস্তারিত তথ্য আদালতে প্রদান করেছে।

তাদের তদন্তে দেখা গেছে, তারা বিভিন্ন ব্যাংক থেকে তাদের কোম্পানির নামে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়েছেন, ঋণের এক অংশ বিদেশে পাচার করে ঐসব দেশ এবং অফশোর এলাকায় সম্পত্তি ক্রয় এবং বিভিন্ন কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেছেন।

বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে তাদের বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নিয়ে বিদেশে অর্থ স্থানান্তর করার কথা ছিল, কিন্তু তারা তা করেননি বলে আবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

এছাড়াও, তাদের সকল আইনসম্মত আয় এবং সম্পদের বিবরণ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে আয়কর রিটার্নে দাখিল করার কথা ছিল, কিন্তু তারা তাও করেননি বলে আবেদনে বলা হয়েছে।

বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীর স্লোভাকিয়ায় ৩০ লাখ ইউরো বিনিয়োগ করে নাগরিকত্ব পেয়েছেন এবং ইয়াশা সোবহান সাইপ্রাসে ২০ লাখ ইউরো ব্যয় করে নাগরিকত্ব পেয়েছেন। আহমেদ আকবর সোবহান ও তার স্ত্রী আফরোজা সেন্ট কিটস ও নেভিসে ২.৫ কোটি ডলার বিনিয়োগ করে নাগরিকত্ব পেয়েছেন বলে আবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

তারা এবং তাদের ছেলে ও পুত্রবধূরা এই দেশগুলিতে ১৯টি কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেছেন এবং সাইপ্রাসে বাড়ি কিনেছেন বলে ওই আবেদনে বলা হয়েছে।

সাফওয়ান ও সোনিয়া ফেরদৌসী সংযুক্ত আরব আমিরাতে হাবিব ব্যাংক এবং সাইপ্রাসে ইউরোব্যাংকে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে অবৈধ অর্থ লেনদেন করেছেন বলে ওই আবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

সাফওয়ানের হাবিব ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে ২৮.৭৫ কোটি ইউরো সোনিয়ার হাবিব ব্যাংক অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করা হয়েছে যা পরে সাইপ্রাসে পাঠানো হয়েছে। তাদের অ্যাকাউন্টে ৩,৫৬,৯৭০ ডলার রয়েছে বলে ওই আবেদনে বলা হয়েছে।

দুদকের মতে, সোনিয়া ফেরদৌসী সোবহান ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডসের অ্যাসিমিনা কনসাল্টিং ইনক., ফ্রাঙ্কাটিনা ডেভেলপমেন্ট ইনক., সোমস গ্রুপ এসএ, আকেবিয়া ইউনাইটেড এসএ, নোরিয়া হোল্ডিংস লিমিটেড, এভেলিনা লর্ডানোভা ইভানোভা, স্ট্যাট হোল্ডিংস সার্ভিসেস, ফ্রাঙ্কাটিনা ডেভেলপমেন্ট ইনক. এবং কর্ডাইলাইন ইউনিভার্সাল এসএ সহ বেশ কিছু কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার বা পরিচালক ছিলেন।

এছাড়া, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের সহযোগিতায় দ্য অবজারভার কর্তৃক পরিচালিত এক তদন্তে রবিবার ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ানে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এই তথ্য উন্মোচিত হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আহমেদ আকবর সোবহানের পরিবারের সদস্যরা যুক্তরাজ্যে ১.৩ কোটি পাউন্ড মূল্যের দুটি বিশাল সম্পত্তির মালিক, যা ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডসে রেজিস্ট্রিকৃত গোল্ডেন ওক ভেঞ্চার লিমিটেড এবং কালিয়াকরা হোল্ডিংস লিমিটেড নামক কোম্পানির মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে।

অবজারভারের তদন্তে দেখা গেছে, সোবহানের এক ছেলের মালিকানাধীন ফরাসি শৈলীর একটি অট্টালিকা নির্মাণাধীন বলে মনে হচ্ছে।

লন্ডনের কেনসিংটনে একটি গেটেড এস্টেটে ১ কোটি পাউন্ড মূল্যের একটি অট্টালিকার মালিক সোবহানের ছেলে এবং বসুন্ধরা গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সাফওয়ান সোবহান, যা অস্টিনো লিমিটেড নামক এক কোম্পানির মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

২.৮ কোটি পাউন্ড ব্যয়ে সাফওয়ানের ভাইয়ের মালিকানাধীন ৫৬ লাখ পাউন্ড মূল্যের চেলসির ওয়াটারফ্রন্ট সম্পত্তির ক্ষেত্রেও একই ধরনের ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই অ্যাপার্টমেন্টটি রেড পাইন ট্রেডিং কর্তৃক ক্রয় করা হয়েছে, যা ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডস ভিত্তিক কিন্তু সিঙ্গাপুরের একটি টাওয়ারকে তাদের ঠিকানা হিসেবে দিয়েছে।

দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪ এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ অনুযায়ী আকবর সোবহান ও তার পরিবারের সদস্য এবং তাদের বিভিন্ন কোম্পানিতে তাদের স্বার্থ সংক্রান্ত বিষয়ে তদন্ত চলছে।

বাংলাদেশ অর্থনীতির অবস্থা সংক্রান্ত সাদা পত্র অনুযায়ী, স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগের শাসনামলে ব্যবস্থিত ট্যাক্স চুরি, ছাড়ের অপব্যবহার এবং দুর্বল পরিচালিত সরকারি অর্থের কারণে ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে বার্ষিক গড়ে ১,৬০০ কোটি ডলার অবৈধভাবে পাচার হয়েছে।

রবিবার অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের একটি কমিটি rzLfb উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনুসের কাছে এই শ্বেতপত্র জমা দেয়।

এই পরিমাণ নেট বিদেশি সহায়তা এবং এফডিআই প্রবাহের সম্মিলিত মূল্যের দ্বিগুণের বেশি বলে ওই শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে।

নিউ এজ অবলম্বনে