শরীয়তপুরের মাহমুদপুর ইউনিয়নবাসীর খোঁজ রাখে না কেউ

দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে পদ্মা সেতুর কাজ। দেশের দক্ষিণ অঞ্চলসহ শরীয়তপুরের মানুষের ভাগ্যের চাকা ঘুরতে শুরু করছে এর মধ্যেই। অল্প সময়ের মধ্যে পৌঁছে যাবে রাজধানীতে। দক্ষিণাঞ্চল সংযুক্ত হবে ট্রেন, গ্যাস ও দ্রুত গতির ইন্টারনেট সেবার সঙ্গে। সবাই যখন দ্রুত গতির সম্ভাবনায় বিভোর তখন শরীয়তপুর সদর উপজেলার মাহমুদপুর ইউনিয়নের গ্রামবাসীরা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। বিনোদপুর-মাহমুদপুর যাতায়াত করার মূল সড়কটি ভেঙ্গে হয়ে গেছে ব্যবহার অনুপযোগী। রিকশা-ভ্যান পর্যন্ত চলছে পারছে না। পাশের অন্য একটি ইউনিয়ন ঘুরে বিকল্প পথে যেতে হয় জেলা শহরে।

শুধু শহরের সাথে যোগাযোগ করার মূল সড়কই নয় ইউনিয়নের মূল সড়কের অবস্থা আরো করুণ। মাহমুদপুর ইউনিয়নের ৮ ও ৯ নং ওয়ার্ডের কদমতলী ও পূর্ব মাহমুদপুর গ্রামের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া খালের উপর নির্মিত পর পর দুটি সেতুর দুই পাশে কোনো রাস্তা তৈরি না হওয়ায় সেতু দুটি কোনো কাজেই আসছে না। বিগত ৬ বছর আগে সেতু দুটির নির্মাণ কাজ শেষ হলেও, মাত্র চার কিলোমিটার সংযোগ সড়কের অভাবে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে ছয় গ্রামের মানুষকে। প্রধান সড়কও দখল হয়ে আছে অনেকদিন ধরে। ফলে কোন ধরনের যানবাহন চলাচল করার সুযোগ নেই ওই সড়কে। বর্ষায় নৌকায় করে আর বাকি সময়ে পায়ে হেটেই পথ চলে গ্রামবাসী।

শাহ জালার সজিব নামে একজন জানান, আমি কয়েক মাসে আগে ওই গ্রামটিতে ঘুরতে গিয়েছিলাম বাইক নিয়ে। কিন্তু আমাকে বাধ্য হয়ে ফিরে আসতে হয়েছে কারণ সেখানকার ব্রিজে ওঠার কোন উপায় নেই। সংযোগ সড়ক নির্মাণ না করায় ব্রিজ হয়ে আছে উঁচু টিলার মত। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্থানীয় লোকজনের দাবির মুখে কয়েক বছর আগে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের (এলজিইডি) অর্থায়নে সেতুটি নির্মাণ করা হয়। কিন্তু সেতু নির্মাণ করা হলেও সেতুর দুই পাশের রাস্তা উঁচু করা এবং সংযোগ সড়কের ব্যবস্থা করেনি কর্তৃপক্ষ। ফলে সেতু তৈরি হলেও কমেনি ভোগান্তি। একাধিক বার আশ্বাসের পরেও সংযোগ সড়ক তৈরি হয়নি অর্ধযুগেও।

সরেজমিনে দেখা গেছে, দ্রুতগতির এ যুগে গ্রামবাসীর চলার গতি মন্থর করে রেখেছে পরপর বিচ্ছিন্ন ওই ব্রিজ দুটি। বেশ কয়েক বছর আগে জেলা শহরের সঙ্গে সহজে যোগাযোগ বাড়ানোর লক্ষ্যে মাহমুদপুর ইউনিয়নের কদমতলী ও পূর্ব মাহমুদপুর গ্রামের মাঝ দিয়ে বয়ে চলা মাহমুদপুর খালটির উপর পরপর দুটি ব্রিজ নির্মাণ করা হয়। নির্মাণের ৬ বছর পরেও ব্রিজ দুটি কোন উপকারে আসেনি বরং দুর্ভোগ বাড়িয়েছে পদে পদে। সেতুর উভয় পাশে পাকা সড়ক নির্মাণ না করায় কোনো কাজেই আসেনি সেতু দুটি। ফলে এ সেতুই যত দুর্গতি ডেকে এনেছে গ্রামবাসীর ভাগ্যে। শিক্ষা, চিকিৎসা, অর্থনীতি সব কিছু থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তারা। ওই সড়কের এক স্থানে দেখা গেছে মানুষ যাতায়াতের জন্য বিকল্প হিসেবে সাঁকো বানিয়ে রাস্তা পার হচ্ছে। ফলে মূল সড়ক থেকে বিছিন্ন এ ব্রিজ দুটি বর্তমানে ব্যবহৃত হচ্ছে শুধু ধান ও পাট শুকানোর কাজে।

মাত্র চার কিলোমিটার সড়কের জন্য ৬ গ্রামের মানুষ দুর্বিষহ জীবন-যাপন করছেন। বর্ষাকাল এলে গ্রাম থেকে উৎপাদিত খাদ্যশস্য, সবজি, পাট বাজারে বিক্রি করতে সড়ক দিয়ে নিয়ে যেতে না পারায় নৌকা দিয়ে বাজারে নিয়ে যান গ্রামবাসী। গ্রামের বেশির ভাগ মানুষের পেশা কৃষি। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় মাথায় করেই পরিবহন করতে হয় কৃষিপণ্য। স্থানীয় কৃষক বশির মিয়া বলেন, 'আমাদের এ দিকে ধান, পাট চাষ বেশি হয়। কিন্তু এগুলো বিক্রি করার জন্য আমরা শহরে যেতে পারি না। বস্তা ভরে মাথায় করে গ্রামের হাটে নিয়ে কম টাকায় বিক্রি করি।'

এ ব্যাপারে মাহমুদপুর ইউনিয়নের ৭, ৮ ও ৯ নং ওয়ার্ডের সংরক্ষিত নারী সদস্য নুরুন্নেছা বেগম বলেন, 'আমরা সদরের কাছের একটি ইউনিয়নবাসী হয়েও বিচ্ছিন্ন। আমাদের এখানে কোন সাংবাদিক আসে না। আমাদের খবর কেউ পায় না। এখানে বড় কোন মারামারি বা দুর্ঘটনা ঘটলেও প্রশাসনের গাড়ি আসতে পারে না। কেউ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে গ্রাম থেকে শহরে নেয়ার নিতে নিতে রোগী মারা যায়। একটা ভ্যানও চলাচল করতে পারে না। অন্য গ্রামের মানুষ আমাদের সীট মহলবাসী বলে ডাকে।'

সরকার যায় সাংসদ বদলায়, কিন্তু দুর্দশা কাটে না দক্ষিণ মাহমুদপুর, পূর্ব মাহমুদপুর, কদমতলী ও কুঠির বাজারসহ আশপাশের গ্রামবাসীর। কদমতলী গ্রামের স্থানীয় বাসিন্দা নুরু সরদার, রেবা বেগম, শিকিম আলী মোল্যা ও চাঁন মিয়া সরদারের সাথে কথা বলে জানা যায়, ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে ছয় থেকে সাত বছর আগে। অনেক বলার পরেও সংযোগ সড়ক তৈরি করে যায়নি তারা। ফলে কয়েকবছর আগে বাধ্য হয়েই স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে গ্রামবাসী একত্রিত হয়ে ব্রিজের ঢালে মাটি দিয়েছিল। সে মাটি বর্ষায় আর বৃষ্টিতে ধুয়ে নিয়ে গেছে। ফলে সংযোগকারী ব্রিজই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে কয়েক গ্রামের মানুষকে।

শুধু তাই নয়, কাছাকাছি নেই কোনো মাধ্যমিক বিদ্যালয়। একমাত্র কদমতলী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উপর ভর করেই চলে শিক্ষা গ্রহণ। দূরের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যাওয়ার যোগাযোগ ব্যবস্থাও নেই। এ ব্যাপারে মাহমুদপুর ইউনিয়নের ইউপি ৮নং ওয়ার্ডের সদস্য মো. আজম সরদার বলেন, 'দীর্ঘ দিন ধরে আমরা ব্রিজের ঢালে মাটি দেয়া এবং রাস্তা পাকা করার দাবি করে আসলেও আমাদের দাবি কেউ শোনে না। এখানে বিদ্যুৎ নেই। টিভির খবর আমরা দেখতে পাই না। আর পত্রিকা এখানে আসে না। কারণ রাস্তা দিয়ে হকারের সাইকেল চলার উপায় নেই। ছেলে-মেয়েরা প্রাইমারী পর্যন্ত পড়াশুনা করার পর আর পড়ার সুযোগ পায় না। কারণ কাছাকাছি কোন মাধ্যমিক বিদ্যালয় নেই। যেখানে আছে সেখানে যাওয়ার কোন উপায় নেই। অত দূরে পায়ে হেটে ছেলে মেয়েরা যেতে চায় না।'

মাহমুদপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শাহজাহান ঢালী বলেন, 'শুধু এই ব্রিজটাই নয় ইউনিয়নের অনেক রাস্তা ও ব্রিজের কাজ করা দরকার। বরাদ্দ পেলে রাস্তা ও ব্রিজের কাজ করা যাবে।' স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের (এলজিইডি) শরীয়তপুরের উপসহকারী প্রকৌশলী শাহাবুদ্দিন বলেন, 'সংযোগ সড়কটির টেন্ডার দেয়া আছে। ওই সংযোগ সড়কের কাজ এক সপ্তাহের মধ্যে ধরা হবে।'

গ্রামের মানুষ দীর্ঘ দিন ধরে ভোগান্তীর শিকার হলেও উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানেন না কিছুই। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. জিয়াউর রহমান বলেন, 'আমার এ বিষয়ে জানা নেই। আপনার কাছ থেকেই জানতে পারলাম। আমি খোঁজ নিয়ে দেখব।' স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের (এলজিইডি) শরীয়তপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী সাজ্জাদ আহমেদও জানালেন সেতু সমস্যার বিষয়ে তার জানা নেই।