মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের উত্থানটা খেয়াল করছেন তো? বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ‘হিরো’ বলতেই মানুষের সামনে যখন কেবল তামিম-সাকিব বা মুশফিক-মাশরাফির ছায়া ভেসে উঠে, ঠিক তখনই কিভাবে কিভাবে যেনো সমস্ত শক্তি দিয়ে জেগে উঠলেন তিনি। তাও বিশ্বকাপের মতো বর্ণাঢ্য মঞ্চে। তার প্রতিভা নিয়ে কখনোই সন্দেহ ছিলো না। কিন্তু প্রতিভার কতোটুকু তিনি দেখাতে পারছেন, তা নিয়ে সংশয় ছিলো সব সময়।

সেই সংশয় রিয়াদ দূর করে দিলেন কী দারুণ প্রতাপে! বিশ্বকাপে পরপর দুই ম্যাচে সেঞ্চুরি করে কাঁপিয়ে দিলেন ইতিহাস। যে কাঁপুনিতে ধসে পড়লো ইংলিশ সম্রাজ্য। বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্ব থেকেই ছিটকে গেলো ইংলিশরা। মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ ময়মনসিংহের তারকা থেকে রাতারাতি বনে গেলেন বিশ্ব তারকা। তামিম-সাকিব বা মুশফিক- মাশরাফির মতোই দ্যুতিময় হয়ে উঠলেন রিয়াদ। এভাবে সবটুকু আলো দিয়ে জ্বলে উঠার জন্যই যেনো প্রতীক্ষায় ছিলেন তিনি। তার প্রতীক্ষার অবসান হয়ে গেলো বিশ্বকাপে। বাংলাদেশ দলের চার তারকার সাথে তিনিও এখন সমান উজ্জ্বল, সমান আলোর খনি।

ক্রিকেটার হিসবে রিয়াদের উত্থান যেভাবে, তার শুরুটা কিন্তু সে রকম ছিলো না। তাকে নিরীহ প্রজাতির অলরাউন্ডার হিসেবে ধরা হতো। মনে করা হতো, রিয়াদ ভালোই খেলেন। ব্যাট হাতে ২৫-৩০ রান। বল হাতে চার-পাঁচ দুই একটা উইকেট; ব্যস, এই-ই যেনো রিয়াদ। মাঝে মাঝে ব্যাট হাতে বা বল ঘুরিয়ে একটু আধটু ঝলকানি। যে ঝলকে হয়তো জয় অথবা জয়ের খুব কাছ থেকে বাংলাদেশের ফেরা। এভাবেই রিয়াদের টিকে থাকা। এভাবেই তার বিশ্বমঞ্চে পৌঁছে যাওয়া।

অথচ ক্যারিয়াদের শুরুতে রিয়াদ ছিলেন ক্লিন হিটার। কিন্তু ক্রমান্বে কিছুটা বদলে যান তিনি। ব্যাটিংয়ে সেট হতে একটু সময় লাগে তার। সাকিব বা মুশফিকের মতো চার মেরে ইনিংস শুরু করার মতো ব্যাটসম্যান ছিলেন না তিনি। এখনো তেমন নন। কিন্তু রিয়াদের যা আছে, তা হলো একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাটিং ধরন। সেই ধরনে রিয়াদ যখন ধরা দেন, তখন কেবলই ব্যাটিং-শিল্পের একজন পুরোধা। যা শান্ত চোখে দেখতে দেখতে কাটিয়ে দেওয়া যায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা।

কিন্তু রিয়াদের এই শিল্পী রূপটা অপ্রকাশিত ছিলো বহুকাল। সব মনে হয়েছে রিয়াদ পারবেন, তার ক্ষমতা আছে। কিন্তু কেনো যেনো তা বাস্তবে অনূদিত হচ্ছিলো না। ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বাজে সময় যা তার ২০১২ শেষ থেকে পরের দুই বছর। ২০১২ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত সময়ে তার ব্যাট থেকে এসেছে মাত্র তিনটি ওয়ানডে হাফ সেঞ্চুরি। ২০১৩ এর মার্চ থেকে এক বছর তার ব্যাটে কোনো টেস্ট হাফ সেঞ্চুরিই ছিলো না। এই সময়ে তার দলে টিকে থাকাই ছিলো বিস্ময়কর। সে সময়ের অধিনায়ক মুশফিকুর রহিমও পড়ছিলেন নানা সমালোচনায়। পারিবারিক সম্পর্কের কারণে নিন্দুকরা বলছিলো, মুশফিকের কারণেই টিকতে পারছেন রিয়াদ।

ওই ঘোর দুঃসময়ে বড় একা হয়ে পড়েছিলেন তিনি। সতীর্থ ও পরিবার ছাড়া কেউ জানতো না, ঠিক কতোটা কষ্টে দিন যেতো রিয়াদের। মিডিয়ার সামনে খুব একটা আসতেন না তখন। আসলেই কথা বলতেন নিতান্তই কম। তাকে দেখে বোঝা যেতো না ঠিক কেমন ঝড় বয়ে যাচ্ছে তার ভিতরে।

ওই ভয়াবহ দুর্বিপাক শেষে ২০১৪-এর সেপ্টেম্বরে সেন্ট ভিনসেন্ট টেস্টে ৬৬ রানের একটি ইনিংস খেলেন রিয়াদ। তখন অনেকই মনে করা শুরু করে দিয়েছে, বাংলাদেশ ১০ জনের দল। রিয়াদ কোনো ক্রিকেটারই না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে তাকে নিয়ে না কৌতুকে ছেয়ে গেছে। ঠিক সে সময় নিজের সঙ্গে সাথে করে  ১৫১ বলে ৬৬ রানের ইনিংসটি খেলেন তিনি।

ওই একটা ইনিংসই রিয়াদের মনোজাগতিক ভাবনা বদলে দেয়। তিনি সিদ্ধান্ত নেন নিজেকে ভেঙে গড়ার। রিয়াদ বলেন, ‘ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ওই ইনিংস আমাকে মানসিকভাবে চাঙা করে দেয়। আমি সিদ্ধান্ত নেই, বোলারদের সামনে সরাসরি আক্রমণে যাবো। আমি নিজেকে বলি, ছোট্ট থাকতে যেভাবে খেলতাম, এখনো সেভাই আবার খেলবো। আমার সামনে কে, কে বোলিং করছে, সে সবে খেয়াল না করে আমি বলটা খেলে যাবো। আউট হলে হবো! ওই ইনিংসের পর আমার চিন্তা বদলে যায়। যা হওয়ার তাই হবে, এমন ভাবনা থেকে আমার আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়ে যায়।’

ওই ম্যাচের প্রথম ইনিংসে রিয়াদের ব্যাট থেকে আসে মাত্র ৭ রান। পরের ইনিংসে প্রথম ৪০ বল খেলার পরও নিজেকে খুঁজে পাচ্ছিলেন না তিনি। এক পর্যায়ে স্পিনার সুলেমান বেনকে ড্রাইভ করে একটি চার মারার পর থেকেই খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসতে থাকেন রিয়াদ। দারুণ সব ড্রাইভ ও পুল থেকে তুলে নেন টেস্ট হাফ সেঞ্চুরি, দীর্ঘ ১২ মাস পর। ওই ম্যাচে তার সাড়ে তিন ঘণ্টার ব্যাটিংয়ে মুশফিকের সাথে গড়ে উঠে দারুণ এক জুটি। ওই জুটিই বাংলাদেশকে ইনিংস হার থেকে বাঁচায়।

পরের ঘরের মাঠে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেও আত্মবিশ্বাসে টইটম্বুর রিয়াদকে দেখেন সমর্থকরা। যা তাকে সুযোগ করে দেয় বিশ্বকাপের দলেও। পরের ঘটনা তো সবারই জানা। প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে বিশ্বকাপ সেঞ্চুরি। পরপর দুই ম্যাচে সেঞ্চুরি। সেরা দশ ব্যাটসম্যানের একজন হিসেবে বিশ্বকাপ শেষ করা। তার ব্যাটের আঘাতে ইংলিশদের বিদায়, বাংলাদেশের প্রথম বিশ্বকাপ নকআউট-পর্ব এবং আরো কতো কী। রিয়াদ প্রস্ফুটিত হয়ে উঠেন যাদুর মতো। তিনি হয়ে উঠেন বাংলাদেশের নতুনতম সুপারস্টার।

এমন সুসময়ের আগে নিজের ফর্মহীনতার জন্য রিয়াদ দুষেন নিজেকেই। তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয়, ওই সময়টাতে আমি যথেষ্ট পরিশ্রম করছিলাম না। দক্ষতা কমে আসছিলো। মানসিক অবস্থান যতোটা উঁচুতে থাকার কথা, ততোটা ছিলো না। যার ফলে ফলাফল ঠিক ছিলো না। আমি নিজেকে বলেছি, আরো কঠিন কষ্ট করতে হবে। শারীরিক ও মানসিকভাবে আরো প্রস্তুত হতে হবে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর থেকে আমি ট্রেইনারের কথা অনুযায়ী চলেছি। নিজের নীতি বজায় রেখেছি। দীর্ঘ সময় ধরে ব্যাটিং করেছি। কোচও আমার বাড়তি যত্ন নিয়েছেন, সুবিধা দিয়েছেন, আমার মনে হয় এসব আমার দারুণভাবে কাজে লেগেছে।’

মাহমুদুল্লাহর এমন পরিণত হওয়া বিষয়ে তার দীর্ঘদিনের উপদেষ্টা, সাবেক অধিনায়ক ও বর্তমান ম্যানেজার খালেদ মাহমুদ সুজন বলেন, ‘রিয়াদ এখন চার নম্বরে খেলে। এখানে সুযোগ পেয়ে সে একটু বেশি সময় পাচ্ছে। যা তাকে নির্ভার রাখছে এবং সুযোগ কাজে লাগানোর সময় করে দিচ্ছে। পাঁচ নম্বরে কিংবা তার চেয়ে নিচের দিকে খেললে সে এতো সুযোগ পেতো না। আমি নিজে লোয়ার অর্ডারে খেলেছি। আমি জানি সেখানে নিয়মিত রান করে যাওয়া কতোটা কঠিন। জাতীয় দলে দীর্ঘ দিনের জন্য নিজের জায়গা পাকা করার জন্য এখনই সুযোগ।’

রিয়াদও চাইছেন তা-ই। ১৭ এপ্রিল থেকে পাকিস্তানের বিপক্ষে শুরু হতে যাওয়া সিরিজে নিজের ফর্মটা ধরে রাখতে চান রিয়াদ। তিনি বলেন, ‘বিশ্বকাপে আমি আমার সক্ষমতার সর্বোচ্চটুকু দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু সেটা এখন অতীত। বিশ্বকাপ আমার কাছে দারুণ স্মৃতি হয়ে থাকবে। তবে সামনে এখন নতুন সময়। এটি আমার ক্যারিয়ারের নতুন মোড়। আরো উন্নতি করার সুযোগ আছে আমার। আমি সব সময় আরো উন্নত ক্রিকেট খেলতে চাই।’

তিনি আরো বলেন, ‘পাকিস্তানের বিপক্ষে খেলাটা সব সময়ই চ্যালেঞ্জিং। বিশ্বকাপের ফর্মটা এখানেও ধরে রাখা আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। এ বছর অনেক দলের সাথে খেলতে হবে। অনেক ম্যাচ খেলতে হবে। প্রতিটি ম্যাচই নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসবে।’

এর মধ্যে নিজের ব্যাটিং দক্ষতা উন্নতির কথা বলতে গিয়ে বিশ্বকাপের আগে দেশের মাটিতে করা অনুশীলন ক্যাম্পের কথা উল্লেখ করেন রিয়াদ। তখন গ্রানাইটের স্ল্যাবের উপর বল করা হতো, সেই বল খেলতেন ব্যাটসম্যানরা। তখনই নাকি ব্যাকফুটে ভালো খেলাটা রপ্ত করে ফেলেছেন রিয়াদ। তিনি বলেন, ‘ওই অনুশীলন আমাকে অস্ট্রেলিয়া- নিউজিল্যান্ডে ভালো খেলার দক্ষতা এনে দিয়েছিলো। পাকিস্তান সিরিজ সামনে রেখেও আমি ওই অনুশীলন করছি। কারণ তাদের দলে বেশ কয়েক পেসার আছে। তারা আমাদের এখানকার উইকেটেও ভালো বাউন্স পেতে পারে।’

রিয়াদ আরো বলেন, ‘আমাদের দলের তামিম, সাব্বির ও নাসির ব্যাকফুটে এসে দারুণ পাঞ্চ খেলতে পারে। এই কৌশলটি আসলে গতি ও বাউন্সের সাথে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার ব্যাপার।’

পাকিস্তান সিরিজ সামনে রেখে অনুশীলন ক্যাম্পে এক দিন হাথুরুসিংহের সাথে দীর্ঘক্ষণ কথা বলতে দেখা যায় রিয়াদকে। পরে এ প্রসঙ্গে রিয়াদ বলেন, ‘হাথুরুসিংহে অন্য কোচদের চেয়ে আলাদা। বিশেষ করে ব্যাটসম্যানদের জন্য তিনি বিশেষ একজন। কারণ তিনি যে কোনো ধরনের শট খেলার স্বাধীনতা দিয়ে দেন। মাঠে নিজের দক্ষতা প্রয়োগ করার ব্যাপারটা অন্য রকম। আমি যদি বাজে শট খেলে আউট হই এবং বুঝতে পারি যে সেটি বাজে শট ছিলো, তবে কোচ এ নিয়ে গালমন্দ করবেন না।’

এ দিকে চার নম্বরে খেলাটা দারুণ উপভোগ করছেন বলে জানান রিয়াদ। তিনি বলেন, ‘ব্যাটিং অর্ডারে আমার জায়গাটা গুরুত্বপূর্ণ। রান করার পাশাপাশি ইনিংস দীর্ঘ করার দায়িত্ব আমার। চার নম্বরে ব্যাটিং করাটা উপভোগ করছি। এখানেই আমি ধারাবাহিক ভালো খেলতে চাই।’ তিনি আরো বলেন, ‘প্রথম ১০-১৫টি বল যদি ঠিক মতো খেলতে পারি, তবে সেখান থেকে অনেক দূর যাওয়ার চেষ্টা করি আমি। এমনকি এই সময়ে বাজে বল পেলে আমি চার বা ছয় মারবোই। এ ছাড়া আমি যদি একটি ভালো বলে শট খেলতে পারি, তবে তা আমাকে দারুণ আত্মবিশ্বাস যোগায়।’

মাহমুদুল্লাহ এখন পর্যন্ত তার ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংস মনে করেন বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেঞ্চুরিকে। রিয়াদ বলেন, ‘ওটিই আমার সেরা ইনিংস। কারণ ম্যাচটি আমরা জিতেছিলাম। ওই জয়ই আমাদেরকে কোয়ার্টার ফাইনালে নিয়ে গিয়েছিলো; যা আমাদের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিলো। পরের ম্যাচেও সেঞ্চুরি করেছিলাম। তবে ওই ইনিংসে আমি লাইফ পেয়েছিলাম; যদিও তা খেলারই অংশ।’

সেঞ্চুরির পর রিয়াদের স্ত্রী-সন্তানের উদ্দেশ্যে ‘লাভ’ আঁকার দৃশ্য বহুকাল মনে রাখতে এ দেশের দর্শকরা। রিয়াদের নিশ্চয় মনে থাকবে ‘ভায়রা’কে ওই সময় কাছে পাওয়ার কথাও। কারণ মুশফিকই তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বাজে সময়ে ছায়ার মতো স্বস্তি দিয়েছেন। রিয়াদ নিজেও বলেছেন সে কথা, ‘সেঞ্চুরির পর মুশফিক যখন আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো, সেই সময়টা জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সময়।’

নিজের সেরা ব্যাটিংটা ধরে রাখতে চান রিয়াদ। তিনি বলেন, ‘আমি জানি ধারাবাহিকতা ধরে রাখা কতোটা কঠিন।’ এতোটুকু বলে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন রিয়াদ। তারপর আবার বলেন, ‘সফলতার জন্য কঠিন পরিশ্রম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমি সব সময় পরিশ্রম করবো এবং করতেই থাকবো।’

মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের নায়ক হওয়ার গল্প লিখে দিয়েছে বিশ্বকাপ। নায়কের এখন কেবল মহানায়ক হওয়ার পালা!

 

আপনি আরো পড়তে পারেন

১৯৯৯ সালের কথা ভুলেননি ওয়াকার

বোলারদের দিকে তাকিয়ে পাকিস্তানের অধিনায়ক

নিজেদেরকে আবারও ফেভারিট বললেন সাকিব

Stay on top of the latest sports news, including cricket and football, from around the world. Get comprehensive coverage of matches, tournaments, and leagues— along with expert analysis and commentary from our team of sports journalists. Whether you're a die-hard fan or a casual observer, you'll find everything you need to know about your favorite sports here.

Sports, cricket, and football are popular topics in the world of sports. Cricket is a bat-and-ball game played between two teams of eleven players and is particularly popular in South Asian countries. Football, also known as soccer, is a team sport played with a spherical ball between two teams of eleven players and is widely popular worldwide. Sports enthusiasts follow the latest news, matches, tournaments, and leagues in these sports and analyze and comment on the performances of players and teams.