ইরান: ইসরায়েলি হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন রয়েছে, পাল্টা আঘাতে কাঁপছে তেল আবিব

ইরানের ওপর ইসরায়েলের সাম্প্রতিক ভয়াবহ হামলার পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি সমর্থন ও সম্মতি রয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাকচি। রবিবার রাজধানী তেহরানে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, এই হামলা যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব ছিল না।

আব্বাস আরাকচি

আব্বাস আরাকচি সাংবাদিকদের বলেন, ‘জায়নবাদী শাসকগোষ্ঠীর এই সামরিক আক্রমণে এ অঞ্চলের মার্কিন ঘাঁটিগুলো থেকে যে সহায়তা দেওয়া হয়েছে, তার সুস্পষ্ট ও অকাট্য প্রমাণ আমাদের হাতে রয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেই জনসমক্ষে স্বীকার করেছেন যে তিনি এই হামলা সম্পর্কে অবগত ছিলেন এবং মার্কিন অস্ত্র ও সরঞ্জাম ছাড়া এটি সম্ভব হতো না। আরাকচির মতে, ‘এর অর্থ হলো, যুক্তরাষ্ট্র এই হামলার একজন অংশীদার এবং তাদের এর দায় স্বীকার করতে হবে।’

ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, ইসফাহানের নাতাঞ্জ পারমাণবিক কেন্দ্রে হামলার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র জড়িত নয় বলে বিভিন্ন মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে ওয়াশিংটন বার্তা পাঠিয়েছে। তবে তেহরান এই দাবি বিশ্বাস করে না, কারণ তাদের কাছে বিপরীত প্রমাণ রয়েছে। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের উচিত অবিলম্বে পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার নিন্দা জানিয়ে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করা।’

যুদ্ধ পরিস্থিতি ও ক্ষয়ক্ষতি

শুক্রবার থেকে শুরু হওয়া ইসরায়েলি হামলায় তেহরানসহ ইরানের একাধিক শহরের আবাসিক ও সামরিক এলাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ইরানি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এই হামলায় বেসামরিক নাগরিকসহ কমপক্ষে ৮০ জন নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে ইরানের সশস্ত্র বাহিনী এবং ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোরের (আইআরজিসি) একাধিক শীর্ষ কমান্ডার, পারমাণবিক বিজ্ঞানী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রয়েছেন।

এর জবাবে ইরানও ইসরায়েলের তেল আবিব ও হাইফা শহরে শত শত ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ব্যবহার করে টানা দুই রাত পাল্টা হামলা চালিয়েছে। এতে অন্তত ১০ জন নিহত এবং কয়েক ডজন মানুষ আহত হয়েছে বলে জানা গেছে। ইরানের তেল শোধনাগার, বিদ্যুৎকেন্দ্র ও তেল রিজার্ভে ইসরায়েল আঘাত হানার পর রবিবার থেকে ইরান ইসরায়েলের জ্বালানি অবকাঠামোকে লক্ষ্যবস্তু করতে শুরু করেছে বলে জানান আরাকচি।

রবিবার ভোরে তেহরানের পশ্চিমে শাহরান এলাকায় একটি জ্বালানি রিজার্ভে ইসরায়েল হামলা চালালে সেখানে ভয়াবহ আগুন লেগে যায়। অন্যদিকে, শনিবার ইরানের দক্ষিণাঞ্চলীয় বুশেহর প্রদেশের আসালুয়েহতে বিশ্বের বৃহত্তম গ্যাসক্ষেত্র সাউথ পার্স-এর ১৪ নম্বর ফেজে হামলা চালানো হয়। আরাকচি এই হামলাকে একটি ‘বড় কৌশলগত ভুল’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি ও জাতীয় ঐক্য

যুদ্ধের আবহে ইরানের সংবাদপত্রগুলো জাতীয় ঐক্যের ওপর জোর দিয়েছে। সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি দ্বারা নিযুক্ত কেইহান পত্রিকার শিরোনাম ছিল, ‘আমরা যুদ্ধ এবং ইসরায়েলকে একসঙ্গেই শেষ করব।’ অন্যদিকে, সংস্কারপন্থী হাম-মিহান পত্রিকা ‘জাতীয় যুদ্ধ’ শিরোনামে প্রতিবেদন ছেপেছে।

প্রায় চার দশক পর ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে শনিবার একটি বিজয় সঙ্গীত সম্প্রচার করা হয়, যা ১৯৮০-এর দশকে ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময় শেষবার শোনা গিয়েছিল। তেহরানের নগর পরিষদের চেয়ারম্যান মেহেদি চামরান জানিয়েছেন, নতুন আশ্রয়কেন্দ্র না থাকায় যুদ্ধের সময় ব্যবহৃত পুরনো বাঙ্কার এবং মেট্রো স্টেশনগুলো ব্যবহারের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।

যুদ্ধের প্রভাবে ইরানের অর্থনীতিতেও বড় ধাক্কা লেগেছে। রবিবার তেহরান স্টক এক্সচেঞ্জ বন্ধ ছিল এবং মার্কিন ডলারের বিপরীতে ইরানি রিয়ালের ব্যাপক দরপতন হয়েছে। ইসরায়েলি হামলার আগে এক ডলারের বিপরীতে রিয়ালের দর ছিল প্রায় ৮ লাখ ৪০ হাজার, যা রবিবার ৯ লাখ ৫৫ হাজারে ঠেকেছে।

ইরানের সরকারি মুখপাত্র ফাতিমা মোহাজেরানি পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সমস্ত ফ্লাইট বাতিলের ঘোষণা দিয়েছেন এবং জনগণকে আশ্বস্ত করেছেন যে সরকার জ্বালানিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করতে কাজ করছে।

সূত্র: আল-জাজিরা