ইসরায়েলের অত্যাধুনিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ফাঁকি, ১২ দিনে ৫০ ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাত!

ইসরায়েলের অত্যাধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিয়ে সাম্প্রতিক সংঘাতে ইরানের ছোড়া অন্তত ৫০টি ক্ষেপণাস্ত্র সরাসরি বিভিন্ন লক্ষ্যে আঘাত হেনেছে। ইরানের ওপর ইসরায়েলি হামলার মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া এই ১২ দিনব্যাপী তীব্র সংঘাতে দুই পক্ষেই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় একটি যুদ্ধবিরতির পর ধীরে ধীরে প্রকাশ পাচ্ছে।

ছবি - সংগৃহীত

ইসরায়েলি হামলার জবাবে ইরানের প্রতিশোধমূলক আক্রমণের মধ্য দিয়ে এই সংঘাতের সূচনা হয়। গত ২৪ জুন মার্কিন মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার আগে পর্যন্ত দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা ছিল চরমে। সরকারি সূত্রের ওপর ভিত্তি করে তুরস্কের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা আনাদোলু এই ১২ দিনের সংঘাতের একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে ধরেছে।

সংঘাত চলাকালে ইসরায়েল স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের ওপর ব্যাপক বিধিনিষেধ আরোপ করে। বিশেষ করে সামরিক ও নিরাপত্তাজনিত স্থাপনায় হামলার ছবি ও বিস্তারিত তথ্য প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। ফলে, ইসরায়েলের সামরিক ক্ষয়ক্ষতির সম্পূর্ণ চিত্র এখনো অস্পষ্ট।

তেল আবিব-ভিত্তিক ইনস্টিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্টাডিজ (আইএনএসএস) ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং অন্যান্য সরকারি দপ্তরের তথ্য উদ্ধৃত করে জানায়, ইরান মোট ৫৯১টি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে, যার মধ্যে অন্তত ৫০টি সরাসরি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম হয়। এছাড়া, ইরান ১,০৫০টির বেশি চালকবিহীন বিমান (ড্রোন) ব্যবহার করে, যার মধ্যে ৫৭০টি ইসরায়েলের আকাশসীমায় প্রবেশ করে। তবে ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের দাবি, তারা ৮৫% থেকে ৯০% ক্ষেপণাস্ত্র এবং ৯৯% ড্রোন হামলা প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়েছে। এই সময়ে দেশজুড়ে প্রায় ১৯,৫০০ বার বিপদসংকেত বেজে ওঠে।

হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি

ইরানের হামলায় ইসরায়েলে ২৯ জন নিহত এবং ৩,৪৯১ জন আহত হয়েছে। আহতদের মধ্যে অনেকেই আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার সময় বা মানসিক আতঙ্কের কারণে অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রায় ১১,০০০ বাসিন্দাকে হামলার শিকার এলাকাগুলো থেকে সরিয়ে নেওয়া হয় এবং ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে ৩৮,০০০-এর বেশি অভিযোগ জমা পড়ে।

এর জবাবে ইসরায়েলি বাহিনী ইরানে ১,৪৮০টিরও বেশি সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর তথ্যমতে, এই হামলায় ইরানের ২০টি যুদ্ধবিমান, প্রায় ১,০০০টি দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র এবং কয়েক ডজন ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপক অকেজো করে দেওয়া হয়েছে। তেহরান, তাবরিজ, কেরমানশাহ এবং মাশহাদসহ অন্তত ২০টি ইরানি শহরে বিমান হামলা চালানো হয়।

ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইসরায়েলি হামলায় তাদের দেশে ৬২৭ জন নিহত এবং অন্তত ৪,৮৭০ জন আহত হয়েছে। নিহতদের মধ্যে ইরানের অন্তত ২৫ জন জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তা ছিলেন, যার মধ্যে দেশটির সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান মোহাম্মদ বাঘেরি এবং ইসলামি বিপ্লবী রক্ষীবাহিনীর (আইআরজিসি) মহাকাশ বাহিনীর কমান্ডার আমির আলী হাজিজাদেহ-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন।

এই সংঘাতে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ ইরানের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের লক্ষ্য করে হত্যাকাণ্ড পরিচালনায় মূল ভূমিকা রাখে এবং প্রথমবারের মতো তাদের অভিযানের ভিডিও প্রকাশ করে। ইরান ১১ জন পরমাণু বিজ্ঞানীর মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করলেও ইসরায়েলের দাবি এই সংখ্যা অন্তত ১৫।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল যৌথভাবে ফোরদো, নাতাঞ্জ এবং ইসফাহানে অবস্থিত ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতেও হামলা চালায়। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে জানানো হয়, ফোরদোর পারমাণবিক কেন্দ্রটি সম্পূর্ণ অকার্যকর করে দেওয়া হয়েছে এবং এর ফলে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি উল্লেখযোগ্যভাবে পিছিয়ে গেছে।

সামরিক স্থাপনার বাইরেও ইসরায়েল ইরানের বিভিন্ন বেসামরিক অবকাঠামোতে আঘাত হেনেছে। এর মধ্যে রয়েছে রেড ক্রিসেন্ট, তেহরানের পানি সরবরাহ ব্যবস্থা, একটি বিদ্যুৎ বিতরণ কেন্দ্র এবং রাজনৈতিক বন্দীদের কারাগার এভিন প্রিজন।

ইরান জানিয়েছে, ইসরায়েলের সঙ্গে সহযোগিতার সন্দেহে তারা ৭০০ জনেরও বেশি ব্যক্তিকে আটক করেছে এবং গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত পাঁচজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে। তেহরান তিনটি ইসরায়েলি হার্মিস ড্রোন এবং একটি এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার দাবি করলেও ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ শেষোক্ত দাবিটির সত্যতা নিশ্চিত করেনি।

যুদ্ধবিরতি সত্ত্বেও ইরানের বিভিন্ন অংশে এখনো বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যাচ্ছে এবং ড্রোনের আনাগোনার কারণে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সক্রিয় রয়েছে।