জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞ: আধুনিক ইতিহাসের অন্যতম নিষ্ঠুর গণহত্যা চালাচ্ছে ইসরায়েল

ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে ‘আধুনিক ইতিহাসের অন্যতম নিষ্ঠুর গণহত্যা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন জাতিসংঘের একজন শীর্ষ বিশেষজ্ঞ। বৃহস্পতিবার জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে নিজের সর্বশেষ প্রতিবেদন উপস্থাপনকালে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডবিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ দূত ফ্রান্সেসকা আলবানিজ এই বিস্ফোরক মন্তব্য করেন। তিনি অভিযোগ করেন, তেল আবিব গাজাকে অস্ত্র পরীক্ষার ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করছে এবং এর বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা ও বাণিজ্য সম্পর্ক স্থগিতসহ আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান।

ফ্রান্সেসকা আলবানিজ

পরিষদে ফ্রান্সেসকা আলবানিজ বলেন, “অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের পরিস্থিতি ভয়াবহ। গাজায় ফিলিস্তিনিরা কল্পনাতীত দুর্ভোগ সহ্য করে চলেছে। ইসরায়েল আধুনিক ইতিহাসের অন্যতম নিষ্ঠুর একটি গণহত্যার জন্য দায়ী।”

তিনি জানান, সরকারি হিসাবে ২ লাখের বেশি ফিলিস্তিনি হতাহত হয়েছেন, তবে শীর্ষ স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি। ইসরায়েলের নতুন সাহায্য বিতরণ ব্যবস্থা ‘গাজা মানবিক সহায়তা সংস্থা’-কে তিনি একটি ‘মৃত্যুফাঁদ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তার মতে, এই ব্যবস্থাটি ক্ষুধার্ত, বোমাবিধ্বস্ত এবং শীর্ণকায় এক জনগোষ্ঠীকে হত্যা বা দেশত্যাগে বাধ্য করার জন্য তৈরি করা হয়েছে, যার সঙ্গে ইতোমধ্যে শত শত মানুষের মৃত্যু জড়িত।

গণহত্যা থেকে মুনাফা অর্জন

ফ্রান্সেসকা আলবানিজ তার প্রতিবেদনে যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত অর্থনৈতিক মুনাফার বিষয়টি বিশেষভাবে তুলে ধরেন। তিনি উল্লেখ করেন, গত ২০ মাসে অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো ইসরায়েলকে অস্ত্র সরবরাহ করে বিপুল মুনাফা অর্জন করেছে, যা দিয়ে গাজায় বোমাবর্ষণ করা হয়েছে।

তিনি বলেন, “অস্ত্র কোম্পানিগুলো ইসরায়েলকে সর্বাধুনিক অস্ত্র দিয়ে প্রায় রেকর্ড পরিমাণ মুনাফা করেছে। এসব অস্ত্র ব্যবহার করে গাজায় ৮৫ হাজার টন বিস্ফোরক নিক্ষেপ করা হয়েছে, যা হিরোশিমায় ব্যবহৃত বোমার চেয়ে ছয় গুণ বেশি শক্তিশালী।”

প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে তেল আবিব স্টক এক্সচেঞ্জে শেয়ারের দাম ২১৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বৈপরীত্য তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়: “এক জাতি হচ্ছে সমৃদ্ধ, অন্য জাতি হচ্ছে নিশ্চিহ্ন।”

অস্ত্র পরীক্ষার গবেষণাগার

ফ্রান্সেসকা আলবানিজ অভিযোগ করেন, ইসরায়েল এই যুদ্ধকে “নতুন অস্ত্র, বিশেষায়িত নজরদারি ব্যবস্থা, প্রাণঘাতী ড্রোন এবং রাডার ব্যবস্থা পরীক্ষার” জন্য ব্যবহার করছে। তিনি সতর্ক করে বলেন, ফিলিস্তিনিদের প্রতিরক্ষাহীন অবস্থা এটিকে “ইসরায়েলি সামরিক-শিল্প খাতের জন্য একটি আদর্শ গবেষণাগারে” পরিণত করেছে।

তিনি তার প্রতিবেদনে ৪৮টি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করেন, যার মধ্যে অস্ত্র নির্মাতা, ব্যাংক, প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান, জ্বালানি সংস্থা এবং এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। তার অভিযোগ, এই প্রতিষ্ঠানগুলো সরাসরি ‘দখলদারিত্বের অর্থনীতির’ সঙ্গে যুক্ত, যা ইসরায়েলি রাষ্ট্রের কর্মকাণ্ডকে টিকিয়ে রাখছে। প্রতিবেদনে উল্লিখিত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে অ্যামাজন, মাইক্রোসফট, বিএনপি পারিবাস, বুকিং ডটকম এবং কোরীয় প্রতিষ্ঠান এইচডি হুন্দাই।

জেনেভায় এক সংবাদ সম্মেলনে আলবানিজ জানান, তিনি তার প্রতিবেদনে উল্লিখিত সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে আনুষ্ঠানিকভাবে অবহিত করেছেন এবং আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের প্রমাণগুলো তাদের সামনে তুলে ধরেছেন। এর মধ্যে ১৮টি প্রতিষ্ঠান জবাব দিয়েছে, যার মধ্যে মাত্র কয়েকটি সরল বিশ্বাসে আলোচনা করেছে, বাকিরা তাদের অন্যায়ের কথা অস্বীকার করেছে।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান

ফ্রান্সেসকা আলবানিজ বলেন, আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে এই দখলদারিত্বের অর্থনীতির সঙ্গে ন্যূনতম সংযোগও স্পষ্ট দায়বদ্ধতা তৈরি করে। তিনি জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর প্রতি সাহসী পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, “সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে অবশ্যই ইসরায়েলের ওপর পূর্ণাঙ্গ অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে, সমস্ত বাণিজ্য চুক্তি ও বিনিয়োগ সম্পর্ক স্থগিত করতে হবে এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।”

একই সঙ্গে তিনি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, “কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে অবশ্যই ফিলিস্তিনি জনগণের মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং আন্তর্জাতিক অপরাধের সঙ্গে যুক্ত সমস্ত ব্যবসায়িক কার্যক্রম অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।”

ফ্রান্সেসকা আলবানিজ তার বক্তব্য শেষ করেন এই বলে যে, “একটি গণহত্যা যখন এতটা দৃশ্যমান এবং সরাসরি সম্প্রচারিত, তখন বিশ্বজুড়ে নিষ্ক্রিয়তার জন্য অজ্ঞতা বা আদর্শগত ভিন্নতাকে আর অজুহাত হিসেবে দাঁড় করানো যায় না। এরপর কী ঘটবে, তা আমাদের সকলের ওপর নির্ভর করছে।”

সূত্র: আনাদোলু এজেন্সি