দেশজুড়ে ভারী বৃষ্টিতে পানিবন্দি লাখো মানুষ, বিপর্যস্ত জনজীবন

বাংলাদেশের উপকূলীয় ও দক্ষিণাঞ্চলজুড়ে মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে টানা ভারী বর্ষণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। বরিশাল, ফেনী, পটুয়াখালী, বান্দরবান, চট্টগ্রাম ও চাঁদপুরসহ একাধিক জেলায় ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে নদনদীর পানি বৃদ্ধি, বাঁধ ভাঙন, পাহাড় ধসের আশঙ্কা এবং চরম জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। দুর্ভোগে পড়েছেন লাখো মানুষ।

ফেনী: বাঁধ ভেঙে প্লাবিত নতুন নতুন এলাকা

ফেনীতে গত তিন দিনের টানা বর্ষণ ও উজানের পানিতে মুহুরী, সিলোনিয়া ও কহুয়া নদীর পানি বিপৎসীমার অনেক ওপরে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে পরশুরাম ও ফুলগাজী উপজেলার ১৪টি স্থানে বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে অসংখ্য গ্রাম।

মঙ্গলবার (৮ জুলাই) থেকে পানিতে নিমজ্জিত ফেনী শহরের অনেক জায়গায় বুধবার কিছুটা পানি নামলেও, নতুন এলাকায় পানি ঢুকছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। বন্যায় হাজারো পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, এখনো বিপৎসীমার ৯৫ সেন্টিমিটার ওপরে নদীর পানি প্রবাহিত হচ্ছে।

বরিশাল: রেকর্ড বৃষ্টিপাতে ডুবেছে শহরের সড়ক

বরিশালে বুধবার (৯ জুলাই) সকাল ৯টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় ১৫৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। মৌসুমি বায়ুর সক্রিয়তার ফলে গত কয়েক দিনের মতো বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে।

এতে শহরের কলেজ রোড, পলাশপুর, বটতলা, চৌমাথা, রাজাবাহাদুর সড়ক, টিটিসি এলাকা, বিএম কলেজের চারপাশে হাঁটু থেকে কোমরসমান পানি জমে গেছে। কর্মজীবী মানুষ, শিক্ষার্থী এবং ছোট ব্যবসায়ীরা পড়েছেন চরম বিপাকে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, কীর্তনখোলা নদীর পানি এখনও বিপৎসীমার নিচে থাকলেও ড্রেনেজ ব্যর্থতায় পানি জমে জলাবদ্ধতা তীব্র হয়েছে।

টানা বর্ষণ ও উজানের ঢলে ফুলে-ফেঁপে উঠেছে কুমিল্লার গোমতী নদী। বাড়ছে বন্যার আশঙ্কা

কুমিল্লা: গোমতীর পানি বাড়ছে, বন্যার আশঙ্কা

টানা ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে হু হু করে বাড়ছে কুমিল্লার গোমতী নদীর পানি। বুধবার বিকেল ৩টা নাগাদ গোমতীর পানি ৮.৫৬ সেন্টিমিটারে পৌঁছায়, যা বিপৎসীমার ৩ মিটার নিচে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় পানি প্রায় ৫ মিটার বেড়েছে। ভারতের ত্রিপুরায়ও ভারি বৃষ্টিপাত হওয়ায় গোমতীতে পানি বাড়ছে।

আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, ১২৯.৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে এবং আরও বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে।

জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, বন্যা মোকাবিলায় ৫৮৬টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রয়েছে এবং পর্যাপ্ত ত্রাণ মজুত রাখা হয়েছে।

পটুয়াখালী: ইতিহাসের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত

পটুয়াখালীতে মঙ্গলবার রাত ৯টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় রেকর্ড করা হয় ২৭৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত, যা জেলার ইতিহাসে একদিনে সর্বোচ্চ। এতে শহর ও গ্রামের অসংখ্য রাস্তা, বসতবাড়ি, মাছের ঘের ও কৃষিজমি তলিয়ে গেছে।

বিশেষ করে ধান ও মাছচাষে বড় ক্ষতির শঙ্কা দেখা দিয়েছে। উপকূলীয় এলাকায় তিন নম্বর সতর্ক সংকেত বহাল রয়েছে। বঙ্গোপসাগর উত্তাল থাকায় মৎস্যজীবীরা ৫ দিন ধরে ঘাটে অবস্থান করছেন।

মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা শেষে এভাবে সমুদ্রে যেতে না পারায় ক্ষতির মুখে পড়েছেন জেলে ও ট্রলার মালিকরা।

বান্দরবান: পাহাড় ধসের ঝুঁকি, নদীর পানি বৃদ্ধি

বান্দরবানে গত ২৪ ঘণ্টায় ১০৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। বৃষ্টিপাতের ফলে সাঙ্গু নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। লাঙ্গিপাড়া, বালাঘাটা, সাইঙ্গা এলাকায় পাহাড় ধসের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

রুমা উপজেলায় এক পাহাড় ধসের ঘটনাও ঘটেছে, তবে হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। অনিয়ন্ত্রিত পাহাড় কাটার কারণে ঝুঁকি বেড়েছে। জেলা প্রশাসন সাতটি উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তাদের সতর্ক অবস্থানে থাকতে নির্দেশ দিয়েছে।

চট্টগ্রাম: টানা বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা, পাহাড় ধসের সতর্কতা

চট্টগ্রাম নগরীতে মঙ্গলবার থেকে বুধবার পর্যন্ত ১৫৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। আগ্রাবাদ, চকবাজার, বহদ্দারহাটসহ বহু এলাকায় সড়ক ও অলিগলি পানিতে তলিয়ে গেছে।

পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিস পাহাড় ধসের সতর্কতা জারি করেছে। কাটা পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

চাঁদপুর: দুই দিনের বৃষ্টিতে তলিয়েছে শহরের নিচু এলাকা

চাঁদপুরে গত ৪৮ ঘণ্টায় ১৩৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। বিষ্ণুদী মাদ্রাসা রোড, পালপাড়া, রহমতপুর কলোনি এলাকায় পানি ঢুকে পড়েছে বসতঘরে।

দোকানদার ও শ্রমজীবী মানুষজন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। শহরের পাশাপাশি ফরিদগঞ্জ ও শাহরাস্তি উপজেলাতেও জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে।

এদিকে , আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, মৌসুমি বায়ুর সক্রিয়তা অব্যাহত থাকায় আগামী কয়েক দিন দেশের দক্ষিণাঞ্চল ও উপকূলজুড়ে মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকবে। সব সমুদ্রবন্দরকে ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে মানুষকে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় সতর্ক অবস্থানে থাকতে বলা হয়েছে।