শেখ হাসিনার ফোনালাপ নিয়ে বিবিসি’র চাঞ্চল্যকর তদন্ত

‘যেখানেই পাবে, গুলি করবে’— চলতি বছরের মার্চে ফাঁস হওয়া একটি ফোনালাপে এই নির্দেশনাই দিতে শোনা যায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া যে আন্দোলন পরে গণঅভ্যুত্থানে রূপ নিয়েছিল, তা দমনে প্রাণঘাতী শক্তি ব্যবহারের অনুমোদন তিনি ব্যক্তিগতভাবে দিয়েছিলেন কি না, সেই বিতর্কের কেন্দ্রে এখন এই অডিও ক্লিপ।

বিবিসি আই-এর একটি গভীর অনুসন্ধানী তদন্তে এই অডিওর সত্যতা যাচাই করার পর বিষয়টি নতুন মাত্রা পেয়েছে। এটি এখন শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (আইসিটি) চলমান মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার অন্যতম ‘মূল প্রমাণ’ হিসেবে ব্যবহৃত হতে যাচ্ছে।

কীভাবে যাচাই হলো অডিওর সত্যতা?

বিবিসি এই রেকর্ডিংটির ফরেনসিক বিশ্লেষণের জন্য বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠান ‘ইয়ারশট’-এর সহায়তা নেয়। তাদের পরীক্ষায় উঠে এসেছে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য:

• অডিওটি আসল: এতে কোনো ধরনের সম্পাদনা বা বিকৃতির প্রমাণ মেলেনি। এটি কৃত্রিমভাবে তৈরি হওয়ার সম্ভাবনাও অত্যন্ত কম।
• কণ্ঠস্বরের মিল: শেখ হাসিনার অন্যান্য অডিওর সঙ্গে মিলিয়ে তার কথা বলার ভঙ্গি, স্বরের ওঠানামা এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের ধরনে সামঞ্জস্য পাওয়া গেছে। এর আগে বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগও (সিআইডি) কণ্ঠটি শনাক্ত করেছিল।
• রেকর্ডিংয়ের পরিবেশ: এটি সম্ভবত স্পিকারফোনে চলা একটি কল থেকে অন্য ডিভাইসে রেকর্ড করা হয়েছিল, কারণ এতে টেলিফোনিক ফ্রিকোয়েন্সির পাশাপাশি বাইরের শব্দও রয়েছে।

মূলত, সরকারের নজরদারি সংস্থা এনটিএমসি (এনটিএমসি) কলটি রেকর্ড করেছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে।

নির্দেশের পরের চিত্র: রাজপথ থেকে আদালত

বিবিসি’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৮ জুলাই গণভবন থেকে দেওয়া ওই নির্দেশের পরই ঢাকার রাজপথে আন্দোলন দমনে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে সামরিক মানের রাইফেল দেখা যায়। জুলাই-আগস্টের সেই দিনগুলোকে ১৯৭১ সালের পর বাংলাদেশের ‘সবচেয়ে ভয়াবহ সহিংসতা’ বলেও আখ্যা দেওয়া হয়েছে।

জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ওই সময়ে ১,৪০০-এর বেশি মানুষ নিহত হয়েছিলেন। শুধু ঢাকার যাত্রাবাড়ীতেই ৫ আগস্ট পুলিশের গুলিতে অন্তত ৫২ জন প্রাণ হারান, যা দেশের ইতিহাসে অন্যতম নৃশংস পুলিশি সহিংসতা। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভিডিও ও সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে বিবিসি দেখিয়েছে, সেনাবাহিনী সরে যাওয়ার পরই পুলিশ আন্দোলনকারীদের ওপর প্রায় ৩০ মিনিট ধরে নির্বিচারে গুলি চালায়।

এই প্রেক্ষাপটে, শেখ হাসিনাসহ ২০৩ জনের বিরুদ্ধে আইসিটিতে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে, যার মধ্যে ৭৩ জন কারাগারে। অভিযোগপত্রে হত্যায় উসকানি, ষড়যন্ত্র এবং সহিংসতা ঠেকাতে ব্যর্থতার মতো গুরুতর বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে।

অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগ

শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগ শুরু থেকেই এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। দলের একজন মুখপাত্র বিবিসিকে বলেছেন, অডিওটি আসল কি না, সে বিষয়ে তারা নিশ্চিত নন। তাদের দাবি, ‘দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা কিংবা প্রধানমন্ত্রী নিজে জনতার বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগের নির্দেশ দিয়েছিলেন–এমন দাবি আওয়ামী লীগ স্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করছে।’ তাদের মতে, প্রাণহানি কমাতেই কর্মকর্তারা ‘ইতিবাচক বিশ্বাস থেকে’ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

অন্যদিকে, ট্রাইব্যুনালের প্রধান কৌঁসুলি টবি ক্যাডম্যান বিবিসিকে বলেছেন, ‘হাসিনার ভূমিকা প্রমাণের জন্য এই রেকর্ডিংগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং মামলার অন্যান্য প্রমাণের সঙ্গেও এগুলো সামঞ্জস্যপূর্ণ।’

বর্তমানে ভারতে অবস্থানরত শেখ হাসিনাকে হস্তান্তরের জন্য বাংলাদেশ সরকার অনুরোধ করলেও ভারত তাতে সাড়া দেয়নি। এদিকে, বাংলাদেশ পুলিশ জানিয়েছে, সহিংসতার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ৬০ জন পুলিশ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং ‘অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের’ ঘটনাগুলোর নিরপেক্ষ তদন্ত চলছে।