সাবেক আইজিপির রাজসাক্ষী হওয়া: আইন কী বলে, শর্তই বা কী?

অপরাধ জগতের এক চরম নাটকীয় মুহূর্ত হলো যখন কোনো অপরাধী তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নিজেই সব ফাঁস করে দেয়। এই ব্যক্তিকে বলা হয় ‘রাজসাক্ষী’ বা ‘অ্যাপ্রুভার’। এটি এক ঝুঁকিপূর্ণ পথ, যেখানে একদিকে থাকে ক্ষমার হাতছানি, অন্যদিকে প্রতিশ্রুতি ভাঙলে রয়েছে আরও কঠোর শাস্তির খড়্গ। সম্প্রতি জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন রাজসাক্ষী হওয়ায় এই বিষয়টি আবারও আলোচনায় এসেছে।

কে এই রাজসাক্ষী এবং কীভাবে তা হওয়া যায়?

সহজ কথায়, রাজসাক্ষী হলেন এমন একজন আসামি, যিনি নিজের অপরাধ স্বীকার করে নেন এবং ওই অপরাধের সঙ্গে জড়িত অন্য সবার পরিচয় ও কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আদালতে পুরোপুরি সত্য তথ্য দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। আইনজ্ঞদের মতে, এটি এক ধরনের শর্তসাপেক্ষ ক্ষমা।

এই প্রক্রিয়ার কয়েকটি ধাপ রয়েছে। ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৩৭ ধারা অনুযায়ী, প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট বা বিচারক তদন্ত বা বিচার চলাকালীন যেকোনো পর্যায়ে কোনো আসামিকে রাজসাক্ষী হওয়ার প্রস্তাব দিতে পারেন। শর্ত থাকে একটাই— অপরাধ সম্পর্কে যা কিছু জানা আছে, তার সবকিছু সততার সঙ্গে প্রকাশ করতে হবে। আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩-এর ১৫ ধারায়ও ঠিক একই ধরনের বিধান রাখা হয়েছে।

রাজসাক্ষী হিসেবে ঘোষিত হওয়ার পর বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত ওই ব্যক্তিকে কারাগারে বিশেষ নিরাপত্তায় আটক রাখা হয়, যাতে অন্য কোনো আসামি বা বাইরের কেউ তাকে প্রভাবিত করতে না পারে।

শর্ত ভাঙলে কী হবে?

রাজসাক্ষীর পথটি পিচ্ছিল। যদি আদালত মনে করেন যে, ওই ব্যক্তি সত্য গোপন করছেন বা মিথ্যা সাক্ষ্য দিচ্ছেন, তাহলে তার ক্ষমার প্রতিশ্রুতি বাতিল হয়ে যায়। তখন তিনি রাজসাক্ষীর মর্যাদা হারিয়ে পুনরায় আসামিতে পরিণত হন। এক্ষেত্রে তার বিরুদ্ধে মূল অপরাধ এবং মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য পৃথক মামলা হতে পারে। অর্থাৎ, ক্ষমা পাওয়ার বদলে তাকে আরও বড় শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়।

আইন অনুযায়ী, একজন রাজসাক্ষীর সাক্ষ্যের ভিত্তিতেই অন্য আসামিদের সাজা দেওয়া সম্ভব, এমনকি যদি সেই সাক্ষ্যকে সমর্থন করার মতো অন্য কোনো প্রমাণ নাও থাকে। সাক্ষ্য আইনের ১৩৩ ধারায় এই বিধান স্পষ্ট করা আছে।

আবদুল্লাহ আল-মামুনের ভবিষ্যৎ কী?

চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রথম রাজসাক্ষী হিসেবে ইতিহাস তৈরি করলেন। তিনি নিজের অপরাধ স্বীকার করে এখন প্রকাশ্য আদালতে সাক্ষ্য দেবেন। তবে তিনি কি চূড়ান্তভাবে ক্ষমা পাবেন? এ বিষয়ে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম জানিয়েছেন, বিষয়টি সম্পূর্ণ ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ার। যদি তার বক্তব্যে ঘটনার পূর্ণাঙ্গ ও সত্য চিত্র উঠে আসে, তবে ট্রাইব্যুনাল তাকে ক্ষমা করতে পারেন অথবা কোনো লঘু দণ্ডও দিতে পারেন।

বাংলাদেশে রাজসাক্ষীর অতীত নজির

বাংলাদেশে রাজসাক্ষী হওয়ার ঘটনা বিরল হলেও একেবারে নতুন নয়। প্রায় দুই দশক আগে, ২০০৪ সালে, কুখ্যাত সন্ত্রাসী এরশাদ সিকদারের দেহরক্ষী নূরে আলম রাজসাক্ষী হয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। তিনি আদালতে এরশাদ সিকদারের সব অপরাধের বিবরণ তুলে ধরেন এবং ব্যবসায়ী আবদুল আজিজ হত্যা মামলায় রাজসাক্ষী হওয়ায় শেষ পর্যন্ত খালাস পেয়েছিলেন।