দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান: ১১ মাসে অভিযুক্ত ১২৬৪, এক-চতুর্থাংশই সরকারি কর্মকর্তা

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চোখে দুর্নীতির অভিযোগের সিংহভাগই সরকারি কর্মকর্তাদের ঘিরে আবর্তিত হয়। এই বাস্তবতাকে সামনে রেখেই গণঅভ্যুত্থানের পর দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংস্থাটি তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেনের কথায়, ‘দুদক আইনের আওতায় আনতে সরকারি কর্মকর্তাদের অপরাধের বিষয়টিকে আমরা অগ্রাধিকার দিচ্ছি। কারণ, দুর্নীতির মামলাগুলোর অধিকাংশ অভিযুক্তই তারা।’

এই নীতির প্রতিফলন দেখা গেছে গত ১১ মাসের কার্যক্রমে। গত বছরের ৫ আগস্ট থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত দায়ের হওয়া ৩৯৯টি দুর্নীতি মামলায় মোট এক হাজার ২৬৪ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে, যার মধ্যে ২৪৩ জনই সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারী, যা মোট অভিযুক্তের প্রায় ২৭ শতাংশ।

অভিযুক্তের তালিকায় কারা?

দুদকের দায়ের করা মামলায় অভিযুক্তদের তালিকায় রয়েছেন ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ, বোন শেখ রেহানা এবং তার সন্তানেরা। এছাড়াও রয়েছেন সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, বিভিন্ন পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি (৩১ জন), রাজনীতিবিদ (৯২ জন) এবং আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ শতাধিক ব্যবসায়ী (১১৪ জন)। তবে অভিযুক্তদের মধ্যে সবচেয়ে বড় অংশটি হলো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী, যাদের সংখ্যা ৪৪৭।

অভিযোগের ধরন

অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধ সম্পদ অর্জন, বিদেশে অর্থপাচার, সরকারি প্রকল্পে দুর্নীতি এবং প্লট বরাদ্দে অনিয়মের মতো গুরুতর অভিযোগ আনা হয়েছে। অনেকের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন দেশে বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ার অভিযোগও তদন্ত করছে দুদক। এছাড়া চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, শেয়ারবাজার কারসাজি এবং রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ব্যাংক থেকে ভুয়া ঋণ নেওয়ার মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগও রয়েছে মামলাগুলোতে।

তদন্ত নিয়ে উদ্বেগ

গণঅভ্যুত্থানের পর দেশব্যাপী দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে বিপুল সংখ্যক অভিযোগ জমা পড়েছে, তার তদন্ত নিয়ে দুদকের ভেতরেই কিছুটা উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন যে, কিছু মামলার তদন্ত ও অভিযোগপত্র তাড়াহুড়ো করে তৈরি করা হয়েছে। তাদের আশঙ্কা, যথাযথ অনুসন্ধানের অভাবে আদালতে এসব অভিযোগ প্রমাণ করা কঠিন হয়ে পড়তে পারে, যা শেষ পর্যন্ত মামলাগুলোকে দুর্বল করে দেবে।

কর্মকাণ্ডের খতিয়ান

গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দুদক দৃশ্যমানভাবে সক্রিয় হয়। প্রথম তিন মাস মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহর নেতৃত্বাধীন কমিশন দায়িত্ব পালন করে। পরবর্তীতে ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেনের নেতৃত্বে নতুন কমিশন গঠিত হওয়ার পর কার্যক্রমে আরও গতি আসে। নতুন কমিশনের অধীনে চলতি বছরের জানুয়ারিতে এক মাসেই সর্বোচ্চ ৭০টি মামলা দায়ের হয়।

সব মিলিয়ে গত ১১ মাসে দুদকে মোট ১২ হাজার ৮২৭টি অভিযোগ জমা পড়েছে এবং ৭৬৮টি অভিযোগ প্রাথমিক তদন্তের জন্য গৃহীত হয়েছে। এর মধ্যে ৩৯৯টি মামলা দায়েরের পাশাপাশি ২৩১টি অভিযোগপত্র এবং ৯টি চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে। একই সময়ে ২২৩ জনকে সম্পদের হিসাব দাখিলের জন্য নোটিশও পাঠিয়েছে কমিশন।