সিইসি: নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ জানি না, তবে শাপলা প্রতীক কেউ পাচ্ছে না

দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন—জাতীয় নির্বাচন কবে? এই প্রশ্নের উত্তর যখন খোদ সরকারপ্রধানের কাছ থেকেও স্পষ্ট নয়, তখন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন জানালেন, তিনিও নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ জানেন না। তবে একইসঙ্গে তিনি দিয়েছেন বেশ কিছু কঠোর ও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো—বহুল আলোচিত শাপলা ফুল প্রতীক কোনো রাজনৈতিক দলকেই বরাদ্দ দেওয়া হবে না।

বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক একান্ত সাক্ষাৎকারে সিইসি নির্বাচনের প্রস্তুতি, কমিশনের নিরপেক্ষতা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধনসহ বিভিন্ন বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন।

দিনক্ষণ নিয়ে ধোঁয়াশা, ফেব্রুয়ারির জন্য প্রস্তুত কমিশন

নির্বাচন কবে হতে পারে—এমন প্রশ্নের সরাসরি উত্তরে সিইসি বলেন, “সঠিক তারিখটি আমি নিজেও জানি না।” তিনি জানান, গণমাধ্যমে আসা খবরের মতোই তিনি শুনেছেন যে, নির্বাচন ফেব্রুয়ারির শুরুতে অথবা এপ্রিলে হতে পারে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো সময়সীমা কমিশনকে জানানো হয়নি।

নাসির উদ্দিন বলেন, “সরকার যখনই তারিখ চূড়ান্ত করবে, আমাদের তফসিল ঘোষণার জন্য কমপক্ষে দুই মাস সময় প্রয়োজন হবে। তবে আমরা প্রস্তুত। সরকার ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন করতে চাইলে আমাদের পক্ষ থেকে কোনো সমস্যা নেই। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন উপহার দেওয়াই আমাদের লক্ষ্য।”

তিনি আরও জানান, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে তার সাম্প্রতিক বৈঠকটি ছিল একটি সৌজন্য সাক্ষাৎ, যা তিনি নিজেই উদ্যোগ নিয়ে করেছিলেন। বৈঠকে তিনি কমিশনের প্রস্তুতি সম্পর্কে প্রধান উপদেষ্টাকে অবহিত করেছেন।

চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত: বিতর্কের শাপলা প্রতীক পাচ্ছে না কেউ

রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতীক বরাদ্দের ক্ষেত্রে একটি বড় বিতর্কের অবসান ঘটিয়েছে নির্বাচন কমিশন। সিইসি নিশ্চিত করেছেন, জাতীয় ফুল হওয়ায় এবং আইনি দিক বিবেচনা করে কমিশন সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, শাপলা প্রতীক কোনো দলকেই দেওয়া হবে না। নতুন দল এনসিপি এবং পুরোনো দল নাগরিক ঐক্য উভয়ই এই প্রতীকের জন্য আবেদন করেছিল। সিইসি বলেন, “আমরা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে পর্যালোচনা করেছি। শাপলাকে আমরা নির্বাচনী প্রতীক হিসেবে রাখছি না।”

একইসঙ্গে তিনি জানান, আদালতের নির্দেশে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন ও প্রতীক ‘দাঁড়িপাল্লা’ তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

‘বিচারকের আসনে বসেছি, নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন নেই’

কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে কিছু দলের তোলা অভিযোগ সরাসরি নাকচ করে দিয়েছেন সিইসি। তিনি বলেন, “আমরা অবশ্যই নিরপেক্ষ। আমি এই চেয়ারকে বিচারকের আসন মনে করি। আমার হাত দিয়ে যেন অবিচার না হয়, সেভাবেই কাজ করতে চাই।”

বিএনপির প্রতি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগকে ‘রাজনৈতিক বক্তব্য’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, “অনেকে আমাকে জামায়াতও বলে। কিন্তু আমাদের কাজই আমাদের নিরপেক্ষতার প্রমাণ দেবে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবার আস্থা ফিরে আসবে।”

আওয়ামী লীগ, আইনশৃঙ্খলা ও অন্যান্য প্রসঙ্গ

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দলটির রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকায় কমিশন তাদের নিবন্ধনও স্থগিত করেছে। তিনি স্বীকার করেন, দেশের অন্যতম বৃহৎ একটি দল নির্বাচনে অংশ নিতে না পারলে নির্বাচন কতটা ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ হলো, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে।

নির্বাচনের সময় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি একটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে বলে স্বীকার করলেও সিইসি আত্মবিশ্বাসী। তিনি বলেন, “জনগণ সঙ্গে থাকলে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করলে কোনো ‘মব’ বা বিশৃঙ্খলা সমস্যা তৈরি করতে পারবে না।”

এছাড়া, জাতীয় নির্বাচনের আগে বিপুল সংখ্যক স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজন বাস্তবসম্মত নয় বলেও তিনি মন্তব্য করেন। নিবন্ধনের জন্য আবেদন করা প্রায় দেড়শ নতুন দলের আবেদন যাচাই-বাছাই চলছে এবং শর্ত পূরণ করলেই কেবল নিবন্ধন দেওয়া হবে বলে তিনি জানান।

জীবনের শেষভাগে এসে এই দায়িত্বকে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে বর্ণনা করে সিইসি নাসির উদ্দিন বলেন, “দেশের এই ক্রান্তিকালে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিয়ে আমি হাসিমুখে বিদায় নিতে চাই। এর জন্য দেশবাসীসহ সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন।”