২০২৪ সালের ১৪ জুলাই: কোটা বাতিলের এক ঐতিহাসিক গণবিস্ফোরণ
- Details
- by ২৪ ডেস্ক
২০২৪ সালের ১৪ জুলাই বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। এদিন সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান বৈষম্যমূলক কোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ রাজপথে বিস্ফোরিত হয়। রাজধানী ঢাকাসহ বিভাগীয় শহর, জেলা এমনকি উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত ছাত্রসমাজ একযোগে "কোটা সংস্কার নয়, কোটা বাতিল চাই" স্লোগানে মুখরিত করে তোলে।

শুরু থেকেই জমে থাকা এই অসন্তোষ সেদিন এক নতুন মাত্রা পায়। শিক্ষার্থীরা কেবল রাজপথে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেই ক্ষান্ত হয়নি, বরং রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি প্রদান, শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন এবং সরকারের প্রতি কোটা বাতিলের এক দফা দাবি জানিয়েছিল। পাঁচ বছর আগে সংগঠিত কোটা সংস্কার আন্দোলনের পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল সেদিন, তবে এবারের আন্দোলন ব্যাপকতা ও সংহতির দিক থেকে ছিল অনেক বেশি সুসংহত ও ঐক্যবদ্ধ।
বঙ্গভবন অভিমুখে পদযাত্রা
রাজধানী ঢাকার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান নেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। ওই দিন রবিবার সকাল থেকেই ঢাকার বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঢাবির কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে জড়ো হতে থাকেন। বেলা ১২টায় শুরু হয় পূর্বঘোষিত ‘বঙ্গভবন অভিমুখে পদযাত্রা’ শাহবাগ, মৎস্য ভবন, হাইকোর্ট এলাকা হয়ে পদযাত্রাটি গুলিস্তান জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত পৌঁছায়।
পথে একাধিকবার পুলিশ ব্যারিকেড সৃষ্টি করে পদযাত্রা থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা ব্যারিকেড ভেঙে এগিয়ে যেতে থাকে। জিরো পয়েন্টে কয়েক ঘণ্টা অবস্থান শেষে দুপুর ১টা ৪০ মিনিটে শিক্ষার্থীরা ফের ব্যারিকেড ভেঙে গুলিস্তান পাতাল মার্কেট অতিক্রম করে বঙ্গভবনের দিকে অগ্রসর হন।
সেখানে পুলিশ জলকামান ও এপিসি কারসহ নিরাপত্তা জোরদার করে। তবে বিকেল ২টা ৩০ মিনিটে আন্দোলনকারীদের ১২ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল বঙ্গভবনে প্রবেশ করে রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিবের কাছে একটি স্মারকলিপি হস্তান্তর করে। বিকেল ৩টায় তারা বের হয়ে আসেন।
স্মারকলিপির মূল দাবি
স্মারকলিপিতে শিক্ষার্থীরা বলেন, ২০১৮ সালের আন্দোলনের পর কোটা সংস্কারের নামে নবম থেকে ত্রয়োদশ গ্রেড পর্যন্ত কোটার বিলুপ্তি ঘোষণা করা হয়। কিন্তু শিক্ষার্থীরা চেয়েছিলেন সব গ্রেডেই বৈষম্যমূলক কোটা সংস্কার করা হোক। তারা সংবিধানে উল্লিখিত অনগ্রসর গোষ্ঠীর জন্য সর্বোচ্চ ৫% কোটা রেখে সংসদে আইন পাসের মাধ্যমে কোটাব্যবস্থা সংস্কারের দাবি জানান।
এছাড়া স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয়, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার নিন্দা জানানো হয় এবং তাদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত ‘অজ্ঞাতনামা’ মামলা প্রত্যাহারেরও দাবি জানানো হয়। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া হলে কর্মসূচি আরও কঠোর হবে বলেও জানানো হয়।
সারাদেশে স্মারকলিপি ও বিক্ষোভ
বঙ্গভবনের পাশাপাশি দেশের প্রায় সব জেলা শহরেও একইদিনে স্মারকলিপি দেওয়া হয়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়: দুপুর ১টায় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের (রাজস্ব) কাছে স্মারকলিপি দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়: বিকেল ৩টায় জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি জমা দেন শিক্ষার্থীরা।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়: সকাল ১১টায় পদযাত্রা শেষে জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়: ক্যাম্পাস থেকে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে গিয়ে সংহতি সমাবেশ করেন শিক্ষার্থীরা।
বরিশাল: বিএম কলেজ, সিটি কলেজ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়সহ একাধিক প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে স্মারকলিপি জমা দেন।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (কুষ্টিয়া): বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যৌথভাবে স্মারকলিপি প্রদান।
এছাড়া পাবনা, রংপুর, টাঙ্গাইল, কুড়িগ্রাম, ঝিনাইদহ, নেত্রকোনা, নাটোরে পদযাত্রা, বিক্ষোভ ও স্মারকলিপি কর্মসূচি পালিত হয়।
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলন
১৪ জুলাই বিকেল ৪টায় গণভবনে চীন সফর নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সংবাদ সম্মেলনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘কোটা বিষয়ে আমার কিছু করার নেই। সমাধান হবে আদালতে।’
এ সময় কোটা নিয়ে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের নাতিপুতিরা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতিপুতিরা চাকরি পাবে?’
শেখ হাসিনা কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ বলে সম্বোধন করায় শিক্ষার্থীরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন।
‘রাজাকারের নাতিপুতি’ বলায় শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ
প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যের তীব্র প্রদিবাদ জানান শিক্ষার্থীরা। এর প্রতিক্রিয়ায় সেদিন রাতে শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেক মিছিল নিয়ে মধ্যরাতে টিএসসির রাজু ভাস্কর্যের সামনে জড়ো হন।
শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে বের হওয়া শুরু করলে হলগুলোর ফটকে অবস্থান নেয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। কয়েকটি হলের ফটকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা শিক্ষার্থীদের আটকে রাখে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের আটকে রাখতে ব্যর্থ হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের আবাসিক হলগুলোর পাশাপাশি রোকেয়া হল, বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হল, বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল, শামসুন্নাহার হলের শিক্ষার্থীরাও এই বিক্ষোভে যোগ দেন।
এ সময় শিক্ষার্থীরা ‘চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’, ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার, রাজাকার’, ‘মেধা না কোটা, মেধা মেধা’সহ বিভিন্ন স্লোগানে মধ্যরাতে ক্যাম্পাস উত্তাল করে তোলেন।
টিএসসিতে বিক্ষোভ শেষে রাত দেড়টার পর শিক্ষার্থীরা হলে ফিরে যান। এর কিছুক্ষণ পর বুয়েটের কয়েকশ শিক্ষার্থী মিছিল নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আসেন। টিএসসি ঘুরে তারা মিছিল নিয়ে আবার নিজেদের ক্যাম্পাসে ফিরে যান।
ছাত্রলীগের হামলা ও প্রতিবাদ
এদিন কোটা সংস্কারের দাবিতে বিক্ষোভ করায় রাত সাড়ে ১১টার দিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ। পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনজন ছাত্রলীগ নেতা সংগঠন থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দেন।
ওবায়দুল কাদেরসহ আওয়ামী লীগের নেতাদের প্রতিক্রিয়া
এক বিবৃতিতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সরকারের সড়ক পরিবহণ ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, কোটাবিরোধী আন্দোলন একটি অরাজনৈতিক আন্দোলন। অথচ বিএনপি ও তার দোসররা এ আন্দোলনকে সরকারবিরোধী আন্দোলনে রূপ দেওয়ার পাঁয়তারা চালাচ্ছে।
বিবৃতিতে শিক্ষার্থীদের কোটাবিরোধী আন্দোলন নিয়ে বিএনপিসহ একটি চিহ্নিত মহলের ষড়যন্ত্র ও অপকৌশলের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকার জন্য সাধারণ শিক্ষার্থী ও দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
এদিন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, “শিক্ষার্থীরা না বুঝেই কোটা নিয়ে আন্দোলন করছে। কোটা আন্দোলনে উসকানিদাতা রয়েছে। শিক্ষার্থীরা মামলা তোলার যতই আল্টিমেটাম দিক, তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলবে। মেরিট দেখেই মামলা করা হয়েছে।”
তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, “সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার বিষয়ে মন্ত্রিসভায় আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”
১৪ জুলাইয়ের দিনটি ছিল কোটা সংস্কার আন্দোলনের এক বর্ণাঢ্য অধ্যায়, যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে শিক্ষার্থীদের ঐক্য ও দাবি আদায়ের দৃঢ়তা স্পষ্ট করে তোলে।
গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...
খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর
Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.
Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.