‘শান্তিপূর্ণ আন্দোলন বা রাজনীতির মাধ্যমে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগকে হটানোর কোনো পথ ছিল না। গণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য যে নির্বাচনী ব্যবস্থা, সেটি আওয়ামী লীগ পুরোপুরি ধ্বংস করে দিয়েছিল। বিরোধী দলের অস্তিত্ব নির্মূল করে তারা আসলে ক্ষমতা থেকে শান্তিপূর্ণভাবে বেরিয়ে যাওয়ার সমস্ত পথ বন্ধ করে দেয়।’— জুলাই অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করতে গিয়ে কথাগুলো বলেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম।

মাহফুজ আলম

জুলাইয়ের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের অন্যতম রূপকার এবং নেপথ্যের এই সমন্বয়ক সম্প্রতি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থাকে (বাসস) দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট, ছাত্র-জনতার আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সাংস্কৃতিক সম্পর্কের মেলবন্ধন এবং একটি আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের বিভিন্ন দিক নিয়ে খোলামেলা কথা বলেন।

মাহফুজ আলম সেইসব ব্যক্তিদের একজন, যারা জুলাই আন্দোলনকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং পেছন থেকে সমন্বয় করে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের মাধ্যমে একে সাফল্যের শিখরে নিয়ে গেছেন। জুলাই অভ্যুত্থানের সময় সরকারের ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ও গণগ্রেপ্তারের মুখেও তিনি আন্দোলনকে বাঁচিয়ে রাখতে কাজ করেন। তার ভূমিকার স্বীকৃতি দিয়ে জাতিসংঘের ৭৯তম সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ লিডার্স স্টেজে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাকে ‘পর্দার পেছনের নায়ক’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন।

যে কারণে অভ্যুত্থান অনিবার্য ছিল

জুলাই অভ্যুত্থান কেন অনিবার্য হয়ে উঠেছিল— এমন প্রশ্নের জবাবে মাহফুজ আলম বলেন, ‘আওয়ামী লীগ মূলত শাপলা-শাহবাগ বিভাজনের মাধ্যমে রাষ্ট্রকে ইসলামপন্থী বা ধর্মনিরপেক্ষ বানানোর একটি চিত্র দাঁড় করিয়েছিল। এই বিভাজনের আড়ালে ২০১৪ সালের নির্বাচন ছিনতাই করা হয়। এরপর ২০১৫ সালে বিএনপির অসহযোগ আন্দোলন এবং সরকারের দমন-পীড়নে বাংলাদেশকে এক প্রকার ‘অস্তিত্বহীন বিরোধী দল’-এর দেশে পরিণত করা হয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘ভ্যাট আন্দোলন ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলন ছিল এসবেরই প্রতিক্রিয়া। ২০১৮ সালের রাতের নির্বাচনের পর ধীরে ধীরে মুজিববাদী সংগঠনের বাইরে তরুণদের একটি গণতান্ত্রিক নতুন গোষ্ঠী তৈরি হচ্ছিল। তারা প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির বাইরে থাকলেও আদতে একটি রাজনৈতিক শক্তি হয়ে উঠছিল, যা আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি।’

মাহফুজ আলমের মতে, ভারতীয় আগ্রাসনের কারণে সীমান্তে প্রতিনিয়ত হত্যাকাণ্ড এবং হাসিনা সরকারের পুতুল সরকারে পরিণত হওয়ার মতো বিষয়গুলো প্রথমবারের মতো জনগণের সামনে নিয়ে আসে সীমান্ত হত্যাকাণ্ড বিরোধী আন্দোলন। অন্যদিকে, আবরার ফাহাদের শাহাদাতের ঘটনা আমাদের মধ্যে একটি বড় সংবেদনশীলতা তৈরি করে। তার কথায়, ‘একদিকে আওয়ামী লীগ যেমন দানব হয়ে উঠছিল, তেমনই অন্যদিকে তাদের বয়ানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তৈরি হচ্ছিল। এসব মিলিয়ে একটি নাগরিক অভ্যুত্থান অনিবার্য হয়ে পড়ে।’

ছাত্র-জনতার ঐক্য ও কৌশল

পূর্ববর্তী আন্দোলনগুলোর ব্যর্থতার একটি বড় কারণ ছিল ‘অনৈক্য’। কিন্তু জুলাই আন্দোলনে সম্পূর্ণ ভিন্ন মতাদর্শের মানুষেরা কীভাবে একত্রিত হলেন? এই প্রশ্নের উত্তরে উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা জানতাম কোথায় কোথায় আপসের সুযোগ তৈরি হতে পারে, কারণ আমরা ৭-৮ বছর ধরে ক্যাম্পাসে সক্রিয় ছিলাম। কারা বিভেদ তৈরি করতে পারে, তাদের আমরা চিনতাম। তাই এবার আমরা শুরু থেকেই বিষয়টি নিয়ে সচেতন ছিলাম এবং সম্ভাব্য বিভেদের জায়গাগুলো আগে থেকেই সামলে নিয়েছিলাম।’

তিনি জানান, আন্দোলনের পুরোভাগে থাকা অধিকাংশ শিক্ষার্থীর একটি সাংস্কৃতিক বোঝাপড়া ছিল। এই বোঝাপড়ার গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘শাপলা-শাহবাগ মূলত একটি সাংস্কৃতিক বিভাজন ছিল। এই বিভাজন ভাঙার জন্য এমন একটি গোষ্ঠীর প্রয়োজন ছিল, যারা ইসলামবিদ্বেষী নয়, আবার ইসলামপন্থীও নয়। এই মধ্যপন্থা আমরা খুঁজে পেয়েছিলাম মাদ্রাসা, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং গ্রাম-শহরের সাধারণ মানুষের মধ্যে। এর মাধ্যমেই বৈচিত্র্যময় মানুষের ঐক্য তৈরি হয়।’

মাহফুজ আলম জানান, আন্দোলনের একেক পর্যায়ে একেকজনকে সামনে নিয়ে আসাটা ছিল তাদের কৌশলের অংশ। তিনি বলেন, ‘নাহিদ ইসলাম তখন রাজনৈতিকভাবে একটি নতুন মুখ ছিল। তার শহুরে বিদ্যালয়ে পড়ার অভিজ্ঞতা মধ্যবিত্ত তরুণদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন সহজ করে দিয়েছিল। অন্যদিকে আমি পেছন থেকে সব ধরনের বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছিলাম। আমাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল স্বপ্নটাকে বাঁচিয়ে রাখা। কে সামনে এলো আর কে পেছনে থাকলো, তা মোটেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল না।’

বিচার ও রাজনৈতিক সংস্কার নিয়ে আশাবাদ

জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার নিয়ে ‘সত্য ও জবাবদিহি’ (ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন) পদ্ধতির কার্যকারিতা প্রসঙ্গে মাহফুজ আলম বলেন, ‘অপরাধীকে বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শাস্তি দেওয়া যায়। কিন্তু পাপীকে কি সাজা দিয়ে নিষ্পাপ করা যায়? যায় না। তাকে পাপ স্বীকার করে ক্ষমা চাওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আসতে হবে। যেমন— পুলিশ বা র‍্যাব প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চেয়েছে এবং নিজেদের পুনর্গঠন করে একটি মীমাংসা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। এর বাইরে আর কোনো পথ আমি দেখি না। আমি ব্যক্তিগতভাবে খুবই আশাবাদী।’

তবে তিনি স্বীকার করেন, স্বৈরাচারের সময় বিচার ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় বিচার প্রক্রিয়া প্রত্যাশার চেয়ে ধীরগতিতে এগোচ্ছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এবং তিনি দ্রুতই একটি দৃশ্যমান বিচার দেখতে পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী।

নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বিরোধী দলকে সমীহ না করলে, তাদের শক্তিশালী অবস্থান তৈরিতে সুযোগ না দিলে রাষ্ট্র সঠিকভাবে দাঁড়ায় না। দুর্ভাগ্যবশত, এই সংস্কৃতি বাংলাদেশে গড়ে ওঠেনি। জনগণের অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোকেও বিদ্যমান প্রথাগত রাজনৈতিক চর্চার বাইরে এসে নতুন সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে।’

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর

Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.

Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.