২০২৪ সালের ১৬ জুলাই বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অম্লান স্মৃতি হয়ে থাকবে। এই দিনে কোটা সংস্কার আন্দোলনে পুলিশের বর্বরোচিত হামলায় রংপুরসহ সারাদেশে ছয়জন আন্দোলনকারী নিহত হন, যার মধ্যে রংপুরের আবু সাঈদ ছিলেন অন্যতম। এই নৃশংস ঘটনা সারাদেশজুড়ে তীব্র বিক্ষোভ ও সংঘর্ষ ছড়িয়ে দেয় এবং আন্দোলনকে এক নতুন মাত্রা দেয়।

২০২৪ সালের ১৭ জুলাই পুলিশি বাধা পেরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গায়েবানা জানাজা আদায় করে শ্রদ্ধা জানান আন্দোলনকারীরা।

১৬ জুলাইয়ের ঘটনার রেশ ধরে ১৭ জুলাই শিক্ষার্থীদের তীব্র ক্ষোভ ও গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে দিনের শুরু হয়। তবে, তৎকালীন সরকার আন্দোলন দমনের জন্য কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ফেসবুক বন্ধ করে দেওয়া হয়, বিভিন্ন টোলপ্লাজায় আগুন লাগানোর খবর পাওয়া যায়, দেশজুড়ে ধ্বংসযজ্ঞ চলে এবং ইন্টারনেট স্লোডাউন করে দেওয়া হয়। এই দমনের কড়া পদক্ষেপে পুরো দেশ অস্থিরতায় নিমজ্জিত হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকার তাৎক্ষণিকভাবে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে, নির্ধারিত পরীক্ষা স্থগিত করে এবং ছয়টি জেলায় বিজিবি মোতায়েন করে।

রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া ও মানবাধিকারের প্রশ্ন
পুলিশ ও ছাত্রলীগের সহিংসতায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে রক্তক্ষরণের ঘটনা রাজনৈতিক উত্তেজনাকে বহুগুণ বাড়িয়ে তোলে। এই সংকটময় মুহূর্তে আওয়ামী লীগ আন্দোলন দমনে শক্ত অবস্থান নেয় এবং তৎপর হয়। অন্যদিকে, বিএনপি এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন নির্ভীকভাবে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ায় এবং তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার আহ্বান জানায়। এই আন্দোলন শুধুমাত্র কোটা সংস্কারের দাবিতে সীমাবদ্ধ না থেকে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়েও গভীর প্রশ্ন তৈরি করে।

১৬ জুলাইয়ের রক্তাক্ত ঘটনার প্রেক্ষাপট

১৪ জুলাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলনের পরপরই আন্দোলনে নতুন মাত্রা আসে। ১৬ জুলাই সারাদেশে ছাত্রলীগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষে অন্তত ছয়জন নিহত হন।

রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আবু সাঈদ, চট্টগ্রামে ছাত্রদলের নেতা ওয়াসিম আকরাম এবং ঢাকার সায়েন্সল্যাব এলাকায় দুইজনের মৃত্যু আন্দোলনকে আরও তীব্র করে তোলে। আহত হয় শতাধিক মানুষ।

১৭ জুলাই: আন্দোলনকারীদের দিন শুরু গায়েবানা জানাজা দিয়ে

ওই দিন পবিত্র আশুরার সরকারি ছুটি থাকলেও আন্দোলন থেমে থাকেনি। নিহতদের মাগফেরাত কামনায় ঢাকার রাজু ভাস্কর্য, চট্টগ্রামের লালদীঘি মাঠ, বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেইট, এবং অন্যান্য শহরে গায়েবানা জানাজার আয়োজন করা হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জানাজার আগেই পুলিশ আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ার গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার করে। তাতে কফিন মিছিল পণ্ড হয়ে যায়। বিকেল ৪টায় আন্দোলনকারীরা উপাচার্য ভবনের সামনে জানাজা আদায় করেন।

এরপর রাজু ভাস্কর্যের দিকে এগোতে গেলে পুলিশের সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে, শিক্ষার্থীরা ইট-পাটকেল ছুড়ে পাল্টা জবাব দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৪টি হলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের কক্ষ ভাঙচুর করা হয় এবং ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি তুলে শিক্ষার্থীরা প্রাধ্যক্ষদের অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর আদায় করে।

দেশের বিভিন্ন ক্যাম্পাসে প্রতিরোধ ও সংঘর্ষ

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়: নারীদের হল খালি করার নির্দেশের পর ছাত্রীদের হল ছাড়তে অস্বীকৃতি, প্রাধ্যক্ষকে রুমে আটকে রাখা।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়: রেজিস্ট্রার শিক্ষার্থীদের সামনে ক্যাম্পাস বন্ধের ঘোষণা দিতে গেলে তাকে ঘিরে ফেলে উত্তেজিত ছাত্ররা; রেজিস্ট্রার ভবন ভাঙচুর হয়, উপাচার্য অবরুদ্ধ হন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়: শহীদ হাবিবুর রহমান হলে ছাত্রলীগের কক্ষে হামলা, উপাচার্যকে ৫ ঘণ্টা অবরুদ্ধ রেখে সন্ধ্যায় পুলিশ টিয়ারশেল ছুড়ে সরিয়ে নেয়।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ও বিএল কলেজ: বিকেলে হল ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হলেও শিক্ষার্থীরা অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যান। শহরের বিভিন্ন স্থানে অবরোধ।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়: ব্র্যাক, নর্থ সাউথ, ইন্ডিপেনডেন্টসহ অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভে অংশ নেন।

তথ্যপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ: ইন্টারনেট-ফেইসবুক বন্ধ

ওই দিন বিকেল থেকে মোবাইলে ইন্টারনেট গতি মারাত্মক কমে যায়। রাতে ফেইসবুক, মেসেঞ্জার পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়। তথ্যপ্রযুক্তিবিদরা বলছেন, সরকার আন্দোলন দমন ও তথ্য নিয়ন্ত্রণে ইন্টারনেট শাটডাউনের পথ বেছে নিয়েছে।

সাবেক তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্‌মেদ পলক ওই সময় মন্তব্য করেন, “যদি এসব সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের অফিস ঢাকায় থাকত, তাহলে আমরা গুজব প্রতিহত করতে পারতাম।”

শহীদ আবু সাঈদের জানাজা ও দাফন

১৭ জুলাই সকালে রংপুরের পীরগঞ্জে আবু সাঈদের বাড়ির পাশে জাফরপাড়া কামিল মাদ্রাসা মাঠে তার প্রথম জানাজা হয়। পরে আরও শিক্ষার্থী ও শিক্ষক যোগ দিলে দ্বিতীয় জানাজা শেষে দাফন করা হয়। দুপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়েও গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।

সরকার ও প্রশাসনের অবস্থান

ওই দিন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন সন্ধ্যায়। তিনি বলেন, “আমার বিশ্বাস, ছাত্র সমাজ আদালতের মাধ্যমে ন্যায়বিচার পাবে। এ আন্দোলনের পেছনে উসকানিদাতা আছে। শান্ত থাকুন।”

আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের নেতাকর্মীদের ‘ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে’ প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেন, “আমাদের অস্তিত্বের প্রতি হুমকি এসেছে, শক্ত অবস্থানে যেতে হবে। কোনো অপশক্তির সঙ্গে আপস নয়।””

সাবেক মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, “আন্দোলন এখন স্বাধীনতা বিরোধীদের হাতে। বসে থাকার সময় নেই।”

ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদ বলেন, “হল খালি না করলে ছাড় দেওয়া হবে না। পুলিশের হাতে এখন অনুমতি আছে।”

বিএনপির অবস্থান

বায়তুল মোকাররমে আয়োজিত গায়েবানা জানাজায় অংশ নিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “এই আন্দোলনে বিএনপি সরাসরি জড়িত নয়, তবে নৈতিক সমর্থন রয়েছে। সরকার আলোচনার মাধ্যমে সমাধান না করে মানুষ হত্যা করেছে।”

কমপ্লিট শাটডাউনের ঘোষণা

বিকেলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ঘোষণা দেন, শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের ওপর হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ১৮ জুলাই সারাদেশে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’। হাসপাতাল ও জরুরি সেবা ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠান খোলা থাকবে না

তিনি দেশের প্রতিটি শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও নাগরিককে পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান।

১৭ জুলাই ছিল বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। গায়েবানা জানাজা দিয়ে শুরু হওয়া প্রতিরোধ আন্দোলন সেদিন নতুন করে জমে ওঠে সহিংসতা, ইন্টারনেট শাটডাউন, প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত ও রাজনৈতিক পাল্টা অবস্থানে।

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর

Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.

Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.