ফিল্ম সোসাইটির ভাইভায় অশ্লীল প্রশ্ন: ঢাবিতে তোলপাড়

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফিল্ম সোসাইটিতে নতুন সদস্য পদ নিতে আসা আবেদনকারীদের ভাইভায় অশ্লীল প্রশ্ন করা নিয়ে ঢাবিতে তোলপাড় চলছে। সদস্য পদ নিতে আগ্রহী একাধিক নারী শিক্ষার্থীর অভিযোগ তাদেরকে চরম অশ্লীল প্রশ্ন করে ভাইভায় লজ্জা দেওয়া হয়েছে। তাদেরকে প্রশ্ন করা হয়েছে, তারা পর্ণ দেখেন কিনা? বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কয়েকজন পর্ণ তারকার নাম বলতে পারবেন কিনা বা বাংলা চটি নিয়মিত পড়েন কিনা? এ ঘটনায় সমালোচনার ঝড় বইছে সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে।

দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের পুরাতন এই সংগঠনটির বিরুদ্ধে এমন এক সময় এ অভিযোগ আসলো যখন মন্ত্রিসভায় জাতীয় চলচ্চিত্র নীতিমালা ২০১৭-এর খসড়ার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। খসড়া নীতিমালায় বলা হয়েছে, 'চলচ্চিত্রে সরাসরি ধর্ষণের কোন দৃশ্য দেখানো যাবে না এবং অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ ভাষা পরিহার করতে হবে। একই সাথে শিশু ও নারীর প্রতি সহিংসতা, বৈষম্যমূলক আচরণ ও হয়রানিমূলক কর্মকাণ্ড উদ্বুদ্ধ করে এমন দৃশ্য বা ঘটনা চলচ্চিত্রে প্রদর্শন করা যাবে না।'

ঢাকা ইউনিভার্সিটি ফিল্ম সোসাইটি (ডিইউএফএস)‘র ২০১৭-১৮ সেশনের ভাইভায় অংশ নিয়েছিলেন স্যার এ এফ রহমান হলের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী আলমগীর হোসেন। টোয়েন্টিফোর লাইভ নিউজপেপারকে তিনি বলেন, 'দুই ধাপে আমার ভাইভা নিয়েছে। প্রথম ধাপে একটা ভাইয়া আর আপু ছিল। তারা আমাকে প্রশ্ন করে, 'তুমি কি মাস্টারবেট কর? তুমি কি নিয়মিত পর্ণ দেখ? আমি না বললে তারা পাল্টা প্রশ্ন করে কেন কর না, কেন দেখ না? তুমি মাস্টারবেট লিখে গুগলে সার্চ দিবা। বাংলা চটি পড়?'

শিক্ষা ও গবেষণা বিভাগের এক শিক্ষার্থী নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, 'আমাকে তারা চরম লজ্জাজনক প্রশ্ন করেছে। তারা আমার গায়ের বর্ণ নিয়ে ঠাট্টা করে প্রশ্ন করেছে। 'তোরে দেখতে তো মনে হচ্ছে রিক্সাওয়ালার মত। তোরে দেখে স্টুডেন্ট মনে হয়না, গুন্ডার মত লাগে। হস্তমৈথুন করছ? প্রেম করস নাকি পরকীয়া প্রেম করস? তোরে দেখে তো মনে হয় পরকীয়া প্রেম করছ। পাঁচটা পর্ণ স্টারের নাম বল?' এসব প্রশ্ন করে তারা আমাকে চরমভাবে লজ্জা দিয়েছে। ক্ষোভে ক্রোধে আমি তখন ভিতরে ভিতরে ফেটে পড়েছিলাম। প্রথম বর্ষের ছাত্র বলে আমি কাউকে আমার অপমানের কথা বলতে পারিনি।

ভাইভায় অংশ নেয়া লিজা নামে একজন নারী শিক্ষার্থী বলেন, 'ছেলেদের যেসব অশ্লীল প্রশ্ন করা হয়েছে, আমাদেরকেও ওই একই প্রশ্ন করেছে। কখনো ভাবিনি ফিল্ম সোসাইটির নামে ওখানে পুরুষ সদস্যরা অশ্লীল প্রশ্ন করে এমন বিব্রত করবে। অপর একজন নারী শিক্ষার্থী বলেন, 'এ ধরনের বাজে মানসিকতা পোষণ করে কিভাবে টিএসসির মত জায়গায় তারা একটি রুম নিয়ে থাকতে পারে। ব্যাপারটা এমন নয় যে, তারা দুই এক জনকে এই ধরনের প্রশ্ন করেছে। তারা ভাইবায় অংশ নেয়া সবাইকে এমন বাজে, অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করেছে। এত বুঝা যায় তারা পরিকল্পিতভাবেই মজা লোটার উদ্দেশ্যে এসব প্রশ্ন করেছে।'

হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের ছাত্র নাঈম আহমেদ বলেন, 'ভাইভার সময় সেখানে থাকা এক আপুকে দেখিয়ে অশ্লীল ইঙ্গিত দিয়ে আমার থেকে জানতে চাওয়া হয়েছে, আপুর প্রতি আমার ইন্টারেস্ট আছে কিনা? আমার প্রেমিকার সাথে ফিজিক্যাল রিলেশন করেছি কিনা করলে সর্বশেষ তারিখ কত? তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি এই সংগঠন করবো না। তারা চলচ্চিত্র চর্চার নামে অশ্লীলতার চর্চা করে বেড়ায়।

নাম প্রকাশ অনিচ্ছুক ইংরেজী বিভাগের এক শিক্ষার্থী বলেন, 'আমাকে ভাইবা বোর্ড থেকে সিগারেট আনতে পাঠিয়েছে। সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের এক ছাত্র বলেন, 'আমাকে প্রশ্ন করা হয়েছে আমি বাথরুম পরিষ্কার করতে পারবো কিনা ও বড় ভাইদের জন্য সিগারেট এনে দিতে পারব কিনা? ফিল্ম সোসাইটিতে কি আমরা এগুলো শিখতে আসবো।'

সমাজ কল্যাণ মোহাম্মাদ মশিউর রহমান বলেন, 'তুমি কলকাতার বাংলা চটি পড়ছো কখনো? তুমি পর্ণ ভিডিও দেখছো?'

চলচ্চিত্র সম্পর্কিত কোনো প্রশ্ন না করে নানা ধরনের অবান্তর ও অশ্লীল প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করায় ক্ষুব্ধ তারা। জগন্নাথ হলের এক ছাত্র বলেন, 'আমি সিনেমা ভালবাসি তাই ফিল্ম সোসাইটির প্রতি আমার দুর্বলতা ছিল। ভাইভায় আমাকে বলা হয়, মাস্টারবেশনের সময় আমি কাকে কল্পনা করি!' ক্ষোভের সাথে এ শিক্ষার্থী জানান, তাকে কোনো ধরনের ফিল্ম রিলেটেড প্রশ্ন করা হয়নি।'

এত্ অভিযোগ যে সংগঠনের বিরুদ্ধে সে সংগঠনের সভাপতি এস এম আরিফ রায়হান শোভনের সাথে যোগাযোগ করা কলে তিনি মুঠোফোনে কোন উত্তর দিতে রাজি হননি। সরাসরি সাক্ষাতে তিনি এ বিষয়ে কথা বলবে বলে জানিয়ে দেন।

এত অভিযোগের পরেও বেশ ভাবলেসহীন ফিল্ম সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন তাহা। যেন অনেকটা গর্ব করেই তিনি বলেন, 'নেতিবাচক প্রশ্নগুলো নতুন সদস্যদের রিক্রুট করতে করা হয়। আমরা তাদের ম্যাচিউরিটি পরীক্ষা করার জন্য এ ধরনের প্রশ্ন করি। তারা কতটা বিব্রত হয় সেটা আমরা লক্ষ করি। তাদের মেন্টালিটি যাচাই করে আমরা প্রায় ১হাজার ২০০জন আবেদনকারী থেকে মাত্র ৩০ জন সদস্য নেব।'

ফিল্ম সম্পর্কিত কোনো প্রশ্ন না করার বিষয়ে তিনি বলেন, 'সদস্য হওয়ার পর আমরা তাদেরকে ফিল্ম সম্পর্কে জানাবো, শেখাবো। কিন্তু এসব বিষয়ে তাদেরকে কখনো শিখাতে পারবো না। তাই ভাইভার সময় আমরা তাদেরকে নানাভাবে প্রশ্ন করে যাচাই করি। তারা আমাদের সাথে খাপ খাওয়াতে পারবে কিনা জানার চেষ্টা করি। করো চুলকানি থাকলে তার আমাদের এখানে আসার দরকার নাই।' সিগারেট টানা, বাথরুম পরিষ্কার করার বিষয়ে তিনি জানান, সিনিয়রদের সিগারেট সব সময় জুনিয়ররা এনে দেয়। ঢাবিতে এটাই নিয়ম। হলেও সিনিয়রা জুনিয়রদের দিয়ে সিগারেট আনায়। সদস্য হতে হলে এসব সামান্য কাজ করার মানসিকতা থাকতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফিল্ম সোসাইটির উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। এ বিষয়ে তিনি বলেন, 'এভাবে টিএসসি কেন্দ্রীক কোন সংগঠনের অশ্লীলতা চর্চা করার সুযোগ নেই। সাধারণ সম্পাদকের দেওয়া উত্তর উপাচার্যকে জানালে তিনি বিস্ময় প্রকাশ বলেন, 'একটি সংগঠনের সাধারণ সম্পাদকের তো এভাবে কথা বলা উচিত না। বিশ্ববিদ্যালয়ে ধূমপান করা নিষিদ্ধ। আমি তাদের সাথে কথা বলব এবং এ বিষয়ে খোঁজ নেব।'