মঙ্গলবার স্কুল ছুটির পর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ প্রাঙ্গণ যখন কিছুটা শান্ত, ঠিক তখনই এক বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে পুরো এলাকা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটি প্রশিক্ষণ বিমান আছড়ে পড়ে স্কুলটির দোতলা ভবনে। মুহূর্তে আগুন ও কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে যায় চারপাশ। ভবনের দোতলায় আটকা পড়া সাত-আটজন শিক্ষার্থীর জীবন যখন সংকটাপন্ন, ঠিক তখনই নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে আসেন তাদের শিক্ষক মোহাম্মদ সায়েদুল আমীন।

সায়েদুল আমীন

এই ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে দোতলার একটি কক্ষে আটকা পড়েন ইংরেজি শাখার জ্যেষ্ঠ শিক্ষক মোহাম্মদ সায়েদুল আমীন ও তার সঙ্গে থাকা অষ্টম শ্রেণির কয়েকজন শিক্ষার্থী। আগুনের লেলিহান শিখা আর ধোঁয়ার কুণ্ডলী যখন শ্রেণিকক্ষের দিকে এগিয়ে আসছিল, তখন তিনি ছাত্রদের নিয়ে আশ্রয় নেন পাশের ওয়াশরুমে। কিন্তু সেটিও নিরাপদ ছিল না। বাঁচার পথ খুঁজতে গিয়ে তার মনে পড়ে বারান্দার শেষ মাথায় থাকা একটি ছোট লোহার পকেট গেটের কথা। কিন্তু সেটি সব সময় তালাই থাকে।

জীবন বাঁচানোর সেই মরিয়া মুহূর্তে শিক্ষক সায়েদুল আমীন সিদ্ধান্ত নেন, দেয়াল ভাঙা অসম্ভব, তাই এই গেটটিই ভাঙতে হবে। তার ভাষায়, ‘জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে শেষ চেষ্টা আর কি!’ আতঙ্কিত শিক্ষার্থীরা তখন ‘বাঁচাও বাঁচাও’ বলে চিৎকার করছিল।

উদ্ধারের এই চেষ্টার মধ্যেই ঘটে আরেক হৃদয়বিদারক ঘটনা। গায়ে আগুন লাগা এক ছাত্র ‘স্যার, আমাকে বাঁচান’ বলে ছুটে আসে তার দিকে। মুহূর্তেই সায়েদুল আমীন ওয়াশরুমে থাকা অন্য ছাত্রদের নির্দেশ দেন ছেলেটির গায়ে পানি ঢালতে, আর নিজে সর্বশক্তি দিয়ে লাথি মারতে থাকেন সেই লোহার গেটে। কতক্ষণ বা কত জোরে লাথি মেরেছিলেন তা তার মনে নেই, কেবল মাথায় ছিল যেভাবেই হোক গেটটা ভাঙতে হবে।

কিছুক্ষণ পর গেটের কয়েকটি চিকন লোহা ভেঙে ও বেঁকে গিয়ে একটি শরীর ঢোকার মতো পথ তৈরি হয়। গেটের পাশেই ছিল একটি আমগাছ। সেই গাছ বেয়েই শিক্ষার্থীরা একে একে নিচে নামতে শুরু করে। ততক্ষণে বাইরে থাকা লোকজনও গাছে উঠে তাদের নামাতে সাহায্য করেন। বিকট শব্দ শোনা থেকে শুরু করে গেট ভেঙে বেরিয়ে আসা পর্যন্ত পুরো ঘটনাটি ঘটেছিল মাত্র মিনিট তিনেকের মধ্যে, যা আটকা পড়াদের কাছে অনন্তকাল বলে মনে হচ্ছিল।

নিচে নামার পরই মোহাম্মদ সায়েদুল আমীন প্রথমবার দুর্ঘটনার ভয়াবহতা পুরোপুরি উপলব্ধি করেন। তিনি বুঝতে পারেন, কোনো বজ্রপাত নয়, একটি বিমান আছড়ে পড়েছে তাদের ভবনে। তিনি দুটি বিকট শব্দের কথা উল্লেখ করেন—প্রথমটি বিমান আছড়ে পড়ার শব্দ এবং দ্বিতীয়টি সম্ভবত জ্বালানি ট্যাংকার বিস্ফোরণের। মাটিতে নেমেই তিনি দুটি ছিন্নভিন্ন লাশ পড়ে থাকতে দেখেন। এছাড়া নিচতলা থেকে বোরকায় আগুন লাগা অবস্থায় একটি মেয়েকে দৌড়ে বের হতেও দেখেন তিনি।

বিমানটি মূলত স্কুলটির দোতলা ভবনের নিচতলায়, সিঁড়ির ঠিক বরাবর অংশে আঘাত হানে। ভবনটির নিচতলায় বাংলা ভার্সন এবং দোতলায় ইংরেজি মাধ্যমের ক্লাস হয়। দুর্ঘটনার কিছুক্ষণ আগেই স্কুল ছুটি হওয়ায় বেশির ভাগ শিক্ষার্থী বেরিয়ে গিয়েছিল। তবে যেখানে বিমানটি আছড়ে পড়ে, তার কাছাকাছি দোতলার একটি কক্ষে একজন শিক্ষক ও কয়েকজন ছাত্র থাকায় তাদের কক্ষে আগুন সবার আগে পৌঁছায় বলে জানা যায়।

মোহাম্মদ সায়েদুল আমীনের সঙ্গে থাকা সব ছাত্র নিরাপদে বের হতে পারলেও ধোঁয়া ও আগুনের তাপে তাদের শ্বাসকষ্ট হয়। গায়ে আগুন লাগা সেই ছাত্রটিও বেঁচে আছে এবং হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

চোখের সামনে সহকর্মী ও শিক্ষার্থীদের হারানোর যন্ত্রণায় মুহ্যমান এই শিক্ষক বলেন, ‘এ এক বিভীষিকা। এমন দিন দেখতে হবে, তা কোনো দিন ভাবিনি। যে ফুলগুলো ঝরে গেছে, তাদের আমরা ফিরে পাব না। যারা বেঁচে আছে, তাদের যেন সৃষ্টিকর্তা ফিরিয়ে দেন—এই প্রার্থনাই করছি।’

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর

Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.

Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.