দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: সরকারের ভেতরেই আরেক সরকার

অন্তর্বর্তী সরকারের আনুষ্ঠানিক কাঠামোর ভেতরেই আরেকটি অদৃশ্য সরকার সক্রিয় রয়েছে এবং বিষয়টি এখন আর কোনো গোপন বিষয় নয় বলে মন্তব্য করেছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তার মতে, এই অন্তর্নিহিত ক্ষমতার বলয়টি সরকারের নিরপেক্ষতাকে মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

বুধবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে তিনি এই বিস্ফোরক মন্তব্য করেন। দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘এখন মোটামুটি পরিষ্কার হয়েছে যে আমরা সরকার বলতে যাদের দেখি আনুষ্ঠানিকভাবে, আসলে তার ভেতরেও আরেকটা সরকার আছে। এটা এখন আর কোনো গোপন বিষয় নয়। এটা সবার কাছেই প্রকাশ্য।’

এই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে দুটি মৌলিক প্রশ্ন বড় হয়ে উঠেছে বলে মনে করেন এই বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ। প্রথমটি হলো সরকারের নিরপেক্ষতা এবং দ্বিতীয়টি তার সক্ষমতা। তিনি বলেন, একটি প্রকৃত ও অবাধ নির্বাচন আয়োজন করা সরকারের অন্যতম দায়িত্ব। কিন্তু সেই নির্বাচন কোনো ‘আপস, আঁতাত বা সিট ভাগাভাগির’ নির্বাচন হবে না, বরং এমন একটি নির্বাচন হতে হবে যেখানে মানুষ ভোটের পরেও শান্তিতে থাকতে পারবে।

ড. ভট্টাচার্য স্পষ্ট করে বলেন, প্রচলিত প্রশাসনিক ক্ষমতা বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে এমন একটি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব নয়। এর জন্য সেনাবাহিনীর বৃহত্তর ও সক্রিয় অংশগ্রহণ অপরিহার্য। তিনি বলেন, ‘আমার সাধারণভাবে বুঝি যে তিন-চার মাসের জন্য তাদের মাঠে থাকতে হবে এবং তারা আসার পরেই প্রথমে অস্ত্র উদ্ধারের কাজটা করতে হবে।’ তার মতে, এক্ষেত্রে সেনাবাহিনীকে ‘ইন এইড টু সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ বা ‘স্ট্রাইকিং ফোর্সের’ প্রচলিত ভূমিকার বাইরে গিয়ে আরও প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করতে হবে।

তবে সরকারের সঙ্গে সেনাবাহিনীর সম্পর্ক নিয়েও জনমনে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। এই প্রেক্ষাপটে সরকারের নিরপেক্ষতা পুনরুদ্ধারের গুরুদায়িত্ব সরকারের ওপরেই বর্তায় বলে তিনি মন্তব্য করেন। রবীন্দ্রনাথের ‘কাদম্বরী’ চরিত্রের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ‘এখন সরকারের নিরপেক্ষতা পুনর্প্রমাণ করা...কাদম্বরীকেই করিতে হইবে।’

অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার সমালোচনা করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বৈষম্যবিরোধী চেতনা নিয়ে এই সরকারের যাত্রা শুরু হলেও অর্থনৈতিক নীতি ও সংস্কারে তার প্রতিফলন ঘটেনি। দুর্বল ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, যেমন—নারী, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুরা স্বৈরাচারী শাসনামলের মতোই বঞ্চনার শিকার হচ্ছে এবং নিজেদের আরও বেশি বিপন্ন বোধ করছে।

যেহেতু এটি একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের অন্তর্বর্তী সরকার, তাই এর একটি ‘এক্সিট পলিসি’ বা নিষ্ক্রমণ পরিকল্পনা থাকা জরুরি বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি সরকারের সময় হয়েছে একটা ডেস্ক ক্লিয়ারিং লিস্ট করার।’ জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টার উচিত, তিনি কোন কোন সংস্কার কাজ সমাপ্ত করে যেতে চান তার একটি সুস্পষ্ট রূপরেখা দেওয়া।

‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান: এক বছরের অভিজ্ঞতা ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক এই গোলটেবিল বৈঠকটি প্রথম আলো কার্যালয়ে বেলা সাড়ে ১১টায় শুরু হয়। আলোচনার শুরুতে উত্তরায় যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে হতাহতের ঘটনায় এক মিনিট নীরবতা পালন করে শোক প্রকাশ করা হয়।

বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন লেখক ফরহাদ মজহার, পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান, অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সারা হোসেন, লেখক আলতাফ পারভেজ, অধ্যাপক সাঈদ ফেরদৌসসহ দেশের বিশিষ্ট নাগরিকেরা।